জামালউদ্দিন বারী : সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি’র পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহনের ইঙ্গিত পাওয়ার পর থেকেই দেশের গণমাধ্যমগুলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সকলের অংশগ্রহণ, পরিবেশ ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয় ও সম্ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে শুরু করেছে। যদিও বিএনপি একই সাথে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথাও যথেষ্ট জোরের সাথেই দাবী করছে। তবে বিএনপি’র এই দাবীর সাথে ক্ষমতাসীনদের কোন বোঝাপড়ার আভাস এখনো পাওয়া যাচ্ছেনা। তারা বরং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের আগে যেমন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বা সংবিধান আনুবর্তিতার কথা বলেছিল এখনো সে পথই আঁকড়ে পড়ে আছে। অতএব নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সম্ভাবনার পাশাপাশি সংশয় সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে। সম্ভবত এ কারণেই এখনো নির্বাচন নিয়ে জনগনের মধ্যে তেমন কোন আস্থাপূর্ণ মনোভাব দেখা যাচ্ছেনা। প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে থাকে। সংবিধানের দোহাই তুলে আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারের নেতারা এ কথাটি বার বার বলে বোঝাতে চাইছেন, বাংলাদেশেও দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। শেখ হাসিনার সরকার সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। কিন্তু তাদের এই পুন:পৌনিক অবিচল অবস্থানের বিপরীতে নির্বাচনের অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার বিএনপিসহ তাদের জোটভুক্ত দল এবং সাধারণ মানুষ ন্যুনতম আশ্বস্ত বোধ করছেনা। এর মূল কারণ হচ্ছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার খাতিরে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কোন মধ্যবর্তি নির্বাচন না দিয়ে পুরো ৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখার পথে অবিচল থাকলেও এ সময়ে বিরোধি জোটের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরী করে একটি অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনের আস্থাপূর্ণ পরিবেশ তৈরীর কোন চেষ্টা বা প্রয়াস গ্রহন করতে দেখা যায়নি। উপরন্তু গত তিন সাড়ে তিন বছর ধরেই বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন মামলায় ব্যস্ত রাখা হয়েছে। অনেকে হয়তো বলবেন, মামলায় ব্যস্ত রাখায় সরকারের হাত নেই। যথাযথ প্রক্রিয়ায় মামলা হয়েছে এবং তা বিচারাধিন আছে বলেই খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজিরা এবং সাক্ষি দিতে হচ্ছে। সাধারণ বিবেচনায় তাদের এ দাবীর যর্থাথতা হয়তো অস্বীকার করা যাবেনা। তবে বিচার বিভাগের উপর সরকারের প্রভাব এবং দুদকের করা একই ধরনের মামলা থেকে আওয়ামিলীগ নেতা শেখ হাসিনাসহ সরকারীদলের নেতাদের প্রায় সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াসহ অন্য নেতাদের মামলাগুলো বহাল থাকা এবং নানা রাজনৈতিক ইস্যুতে নতুন করে মামলা দিয়ে বিএনপি’র হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার, ওয়ারেন্ট ও হয়রানির জালে বন্দি রাখার মধ্যেই সেই দাবীর অসারতা প্রমানীত হয়ে যায়। আমাদের সরকার যখন সংবিধানের দোহাই দিয়ে দেশে রাজনৈতিক বিভাজনকে জিইয়ে রাখার অনৈতিক ও অগ্রহযোগ্য অবস্থান গ্রহন করছে, তখন দলনিরপেক্ষ রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন নাগরিক সমাজ দেশের সংবিধানের গলদগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে তা নিরসনে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষেই কথা বলছেন। যে সংবিধানের আওতায় দেশের মানুষ স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, পেশাদার নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দলনিরপেক্ষ ভূমিকা দেখতে পাবে।
আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার ফলশ্রুতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সরকারী প্রতিষ্ঠানসমুহের রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত ভ’মিকা। সাংবিধানিক দায়-দায়িত্ব অনুসারে সকলের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচারিক আদালতের নিরপেক্ষতা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও সর্বসাধারণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতাই আমাদের আজকের জাতীয় সংকটের মূল কারণ। প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দলীয় সরকারের বশংবদ সংস্থায় পরিনত করার মধ্য দিয়ে আমাদের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কাঠামোকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশের সংবিধান, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার সমুহকে ক্রমাগত ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ৯ বছর আন্দোলন করে বিজয় লাভের পর গত ২৭ বছরেও দেশের মানুষ একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উপনীত হতে না পারার ব্যর্থতা এ দেশের সব রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের সর্মথক সাধারণ মানুষের। যে সব দাবী দাওয়াকে সামনে রেখে এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল এবং চুড়ান্তু পর্যায়ে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে লাখো প্রানের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল, সেই জাতি এখনো একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরীর অপরিহার্য্য শর্তও পুরণ করতে পারছেনা। লক্ষ প্রানের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশের পতাকার সামনে এই বাস্তবতা আমাদের লজ্জিত ও হতবাক করে দেয়। এ দেশের কোটি মানুষ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ বিশ্বের কাছে আমাদের নাগরিকদের লজ্জিত ও অপমানিত হতে বাধ্য করে। যে দেশের তারুন্য লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জনের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের পর গণতন্ত্রের জন্য আবারো ঐকবদ্ধ সংগ্রাম করে গণতন্ত্রকামি মানুষের বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে, সে দেশের হাজার হাজার তরুণ এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে ধুকে ধুকে মরছে। বিপদসংকুল পথে বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মরছে। আমাদের সরকার যখন দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল বলে দাবী করছে, সে সময় জীবন বাজি রেখে হাজার হাজার মানুষের দেশ ছাড়ার বাস্তবতা বিশ্বকে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভিন্ন মেসেজ দিচ্ছে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও উচ্চাকাঙ্খায় তাড়িত হয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি জমায়। সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে যখন আমরা দেখি ইতালীর কারাগারে হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিক। এমনকি মালয়েশিয়া, সউদি আরব বা আরব আমিরাতের মত ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোর কারাগার যখন অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসিতে ভরে যায়, তখন জাতি হিসেবে আমাদের গ্লানীর অন্ত থাকেনা। গত জুলাই’র প্রথম সপ্তায় মালয়েশিয়া সরকার সে দেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান শুরুর প্রথম কয়েক দিনেই হাজার হাজার অবৈধ শ্রমিককে আটক করে। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, আটককৃতদের মধ্যে বেশীরভাগই বাংলাদেশি নাগরিক। তবে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য হাজার হাজার বাংলাদেশি গোপন আস্তানা, জঙ্গলে-পাহাড়ে আত্মগোপণ করছে বলেও খবর পাওয়া যায়। ইতিপূর্বে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে হতভাগ্য বাংলাদেশিদের গণকবর আবিষ্কারের খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হতে দেখেছি। মাত্র পাঁচ দশক আগেও যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে থাইল্যান্ড,মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে এগিয়ে ছিল। সে বাংলাদেশের লাখ লাখ নাগরিক এখন সে সব দেশে অবৈধ অভিবাসি হয়ে অতি সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রমদাসে পরিনত হচ্ছে অথবা কারাগারে-জঙ্গলে মানবেতর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। অগ্রসরমান অর্থনীতির স্বাধীন বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের এমন গøানিকর জীবন মেনে নেয়া যায়না। দেশের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দেশকে এগিয়ে নেয়ার ডুগডুগি বাজাচ্ছেন তা দেশের জনগন এবং বাকি দুনিয়ার কাছে হাস্যকর বিষয়ে পরিনত হয়েছে।
দেশে প্রতিনিয়ত নৃশংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠনের এক শ্রেনীর নেতা-কর্মীরা একেকটি পৈশাচিক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে আর এসব ঘটনার সচিত্র সংবাদগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। একপাক্ষিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করে মানুষকে দলীয় সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে। গণমাধ্যমের সুবাদে কিছু কিছু ঘটনা চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পরিনত হলেও বেঁচে থাকার আশা এবং লোকলজ্জার ভয়ে গুম ও ধর্ষনের অনেক ঘটনাই ভুক্তভোগিরা প্রকাশ করেনা। সে সব ঘটনায় পুলিশের কাছে মামলা হয়না, গণমাধ্যমেও প্রকাশ পায়না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির দেশে কেউ আত্মহত্যা করে কেউ জীবন বাজি রেখে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে বাঁচার শেষ চেষ্টা করছে। এ সপ্তাহে কুমিল্লায় কলেজ ছাত্রী স্মৃতি আক্তার বখাটের অত্যাচার এবং ফটোশপে এডিট করা অশ্লীল ছবি ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। আর বগুড়ায় সরকারী কলেজে ভর্তি করানোর প্রলোভনে বাসায় নিয়ে আরেক ছাত্রীকে ধর্ষনের পর তার বিচার চাওয়ায় মা ও মেয়েকে স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলরের বাসায় ডেকে নিয়ে পিটিয়ে আহত করে মাথা ন্যাড়া করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে সরকারী দলের স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ধর্ষিত-আহত মা ও মেয়ে এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজেদের মৃত্যু কামনা করছে। বগুড়ায় শ্রমিকলীগ নেতার ধর্ষনের প্রতিবাদে শত শত নারীপুরুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। ধর্ষক ও সহযোগিদের কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। অপরাধিকে আওয়ামীলিগ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। এভাবে প্রতিটি ধর্ষণ, গুম-হত্যার ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে যদি হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে হয়, তাহলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আদালত এবং বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজন কি? শুধুমাত্র গণরোষ থেকে বাঁচাতেই যেন এ ধরনের অপরাধিদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। অন্যথায় এরা বিচারের বাইরেই থাকে। এ কারণেই ক্ষমতাবান তুফান সরকারদের হাতে ধর্ষিত হওয়ার পর মাসহ ধর্ষিতাকে পিটিয়ে মাথা ন্যাড়া করে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ জারি হয়। এমন অসংখ্য বদরুল, তুফান সরকার সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দলীয় পরিচয়ে এদের খুন-ধর্ষণ, অপকর্মের বিরুদ্ধে জনরোষ ও গণপিটুনি থেকে বাঁচাতে দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের চেয়ে তথাকথিত উন্নয়নের প্রতি বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। যদিও অপরিকল্পিত ও লুটপাটের উন্নয়ন কর্মকান্ড জাতিকে ভয়াবহ সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। উন্নয়ন হতে হতে ঢাকা শহর ইতিমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট বা বসবাসের অযোগ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় বিশ্বব্যাংক আয়োজিত এক সেমিনারে প্রকারান্তরে ঢাকাকে পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয়েছে। প্রতিদিন যানজটের কারণে ঢাকার নাগরিকদের ৩২ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। গত ১০ বছরে ঢাকায় যানবাহনের গতি ঘন্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে ঘন্টায় ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। শহরের অপরিকল্পিত উন্নয়নের ধারা এবং অনিয়ন্ত্রিত জনবসতি অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার লোকসংখ্যা হবে সাড়ে ৩ কোটি। মানুষের স্বাভাবিক পায়ে হাঁটার গতি ঘন্টায় ৫ কিলোমিটার হলেও যানজটের কারনে ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকায় যান চলাচলের গতি দাঁড়াবে ঘন্টায় ৪ কিলোমিটার। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা শহরকে সংস্কারের বদলে নতুন পরিকল্পনায় ঢাকাকে পূর্বদিকে সম্প্রসারনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা। গত মাসাধিককাল ধরে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহর নজিরবিহন পানিবদ্ধতার শিকার হয়েছে। তথাকথিত উন্নয়নের নামে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো ভরাট ও দখল করে বড় বড় বাণিজ্যিক ভবন নির্মান করা হয়েছে। পরিকল্পিত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় এক সময় এই খালগুলোই ছিল ঢাকার স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার প্রধান গতিপথ। শহরে যখন হাজার হাজার কোটি টাকায় একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মান করে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হচ্ছে তখন ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তাগুলো একদিনের বৃষ্টিতেই কয়েক ফুট পানিতে ডুবে খালে পরিনত হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরী বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে সয়লাব হওয়ার বাস্তবতায় সিটি মেয়র আজম নাছির উদ্দীন বলেছেন অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মানের কারণেই চট্ট্রগাম নগরী জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের অধিকাংশ রাস্তাই জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। তথাকথিত উন্নয়ন যতই দৃশ্যমান হচ্ছে শহরের পানিবদ্ধতা, খানাখন্দ ও জঞ্জালবদ্ধতাও ততই প্রকট আকার ধারণ করছে। সরকারকে বুঝতে হবে এমন উন্নয়ন জনগনের প্রত্যাশিত নয়।
গত বছরের শেষদিকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পুলিশের গুলিতে স্বাধীনতাকামি নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তপ্ত হয়ে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসলেও এখন আরো বড় ধরনের আঞ্চলিক বিরোধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভূটান-ভারত-চীন সীমান্তের দোকলাম মালভূমি এলাকায় ভারত ও চীনের স্থাপনা নির্মান এবং সামরিক উপস্থিতির পাল্টাপাল্টি অভিযোগের প্রেক্ষাপটে এখন উভয় পক্ষ অনড় অবস্থানে থেকে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে চলেছে। তবে গত কয়েকদিনে ভারতের পক্ষ থেকে সংযমের আভাস দিয়েছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর মানে আপাতত: যুদ্ধের আশঙ্কা কমেছে। তবে এখানে ছাড় দেয়া কারো পক্ষেই হয়তো সম্ভব হবেনা। এ কারণে এই উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদি হতে চলেছে ধরে নেয়া যায়। আর ভারত চীন উত্তেজনার উত্তাপ উপমহাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতি তো বটেই বিশ্ব রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলবে। চীনভারত সামরিক উত্তেজনার এই মুহুর্তে পাকিস্তানের হাইকোর্ট প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষনা করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুসলিমলীগ নেতা মিয়া নওয়াজ শরীফ পদত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ পাকিস্তান এবারো একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার ৫ বছর অতিক্রম করতে পারলনা। যে পানামা পেপার্সের অভিযোগের কারণে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে পাকিস্তানের আদালত, সেই একই পানামা পেপার্সে দুর্নীতির দায়ে বাংলাদেশেরও অন্তত চার ডজন ব্যক্তির নাম রয়েছে। বাংলাদেশের দুদক বা বিচার বিভাগ তাদের বিরুদ্ধে বিচার তো দূরের কথা কোন তদন্তও করতে পারেনি। অথচ আমাদের রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছেন। পাকিস্তানে যখন দুর্নীতির অভিযোগে উচ্চ আদালত প্রধানমন্ত্রীকে শুধু অযোগ্য ঘোষনা করেছে তখন বাংলাদেশে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা ও বিচারকদের চাকুরী বিধি নিয়ে নির্বাহী বিভাগের মধ্যে রীতিমত‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়ছে সংশ্লিষ্টরা। সেখানে নির্বাহী বিভাগের কাছে আদালতের অসহায়ত্বই প্রকাশ পেয়েছে। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে চাকুরী বিধি চুড়ান্ত করতে গেজেট প্রকাশের যে নির্দেশনা দেড় দশক আগে উচ্চ আদালত দিয়েছিল তা আজো বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান প্রধান বিচারপতির আমলে গত দেড় বছরে ২২ দফা সময় বাড়ানোর পর সর্বশেষ সরকারের পক্ষ থেকে যে খসড়া দাখিল করা হয়েছে তা’ আদালতের নির্দেশনার বিপরীত বলে আখ্যা দিয়ে প্রধান বিচারপতি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, এই যদি করবেন তাহলে হাইকোর্ট উঠিয়ে দেন। বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তানের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সেখানকার উচ্চ আদালত প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর ১৬ বছরেও নিম্ন আদালতকে স্বাধীন করার আইনগত বিধিমালা হয়না। অর্থাৎ সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে বিচার বিভাগকে নির্বাহী ক্ষমতার গ্যাঁড়াকলে আবদ্ধ রাখতে চাইছে। গণতন্ত্রহীনতা এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতির কারণে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যে কারণে দলীয় পরিচয়ধারি ব্যক্তিরা হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, সরকারী দলের পদধারি সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য সন্ত্রাস-খুন ধর্ষণ ও হল পোড়ানোর ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী দেশ ছেড়ে বিপদসঙ্কুল পথে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। দেশকে এমন বাস্তবতার মুখোমুখি দাড় করিয়ে আমাদের সরকার উন্নয়নের প্রচারনা চালাচ্ছে। দক্ষ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগনের রায়ে নির্বাচিত সরকার ছাড়া আধুনিক বিশ্বে টেকসই উন্নয়ন ও জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন