বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসন ও অমানবিক আচরণ

প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
পাখিদেরও নিজের বাসা আছে। ফিলিস্তিনিদের তাও নেই। পার্শ্ববর্তী জর্ডান কিংবা লেবানন, অথবা আর সব দেশে তো বটেই, এর বাইরের পৃথিবীর বহু দেশেই তারা বছরের পর বছর কাঠিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কোথাও তাদের ঠিকানা উদ্ধাস্ত শিবিরে আবার কোথাও তারা অন্যরকম প্রবাসী। তাদের ফিরে আসার মতো স্বদেশ নেই। অথচ অন্যান্য প্রবাসীর নিজস্ব রাষ্ট্র আছে, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, দালানকোঠা সবই আছে, যা নিয়ে তারা গর্ব করে, স্বপ্ন দেখে। ফিলিস্তিনিরা সংখ্যায় দু-চারশ নয়, পাঁচ-দশ হাজারও নয়, তাদের সংখ্যা বেশ কয়েক লাখে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনিদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক কম নাগরিক নিয়ে গঠিত হয়েছে এমন দেশ বিশ্বে একেবারে কম নয়। ফিলিস্তিন প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জনপদ। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের উত্তরাধিকারী এখানকার আরব মুসলিমরা। তাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য। তাদের পিতৃপুরুষের ভূখ-ে বসবাসের নৈতিক, মানবিক ও আইনগত অধিকারও রয়েছে। অবৈধ ইসরাইল জন্ম নেওয়ার পর অর্ধশতক পার হয়ে গেলেও তারা এই বৈধ অধিকার ফিরে পায়নি।
ফিলিস্তিনিদের অনেকেই আজ দেশছাড়া। এখনো অবশিষ্ট ফিলিস্তিনিরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চাইছে প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে। তারা সর্বক্ষণ একের পর এক হয়ে যাচ্ছে গৃহহারা। নিজ দেশে পরবাসী ফিলিস্তিনের মুসলমানরা কারও ওপর জুলুম করেনি। অন্যের দেশ জবরদখল করে নেয়নি। ভেঙে উড়িয়ে দেয়নি অপরের বসতি। নিরীহ শান্তিÍকামী মানুষকে শিকারে পরিণত করেনি, হত্যা-হামলা-নির্যাতন-গ্রেপ্তার বা ধ্বংস করে বিতাড়িত করেনি। এ সবকিছুই করেছে চরম সাম্প্রদায়িক ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাষ্ট্রশক্তি কট্টরপন্থি সা¤্রাজ্যবাদী শয়তানদের ইঙ্গিতে। এত কিছুর পরও তারা বিশ্ব মোড়ল পাশ্চাত্যের চোখে অপরাধী নয়। ফিলিস্তিনিদের মতো মজলুম ও হতভাগ্য জাতি দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। তবুও জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জগৎ তাদের পক্ষ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। জালিমদের জুলুমকে বরং সমর্থন করে আসছে বছরের পর বছর ধরেই।
১৯৮৯ সালে ফিলিস্তিনে ইন্তিফাদার সূচনা। কয়েক বছর ধরে গণঅভ্যুত্থানের গতি ছিল প্রবল। এরপর জাতীয় আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির টানাপোড়নে উত্তেজনা ও প্রতিরোধ কিছুটা হ্রাস পায়। ২০০২ থেকে আবার প্রতিরোধ প্রচ- হতে থাকে। বিশেষ করে সা¤্রাজ্যবাদীদের মদদপুষ্ট চরমপন্থি শ্যারন পুনরায় সরকারপ্রধান হওয়ার পর ইহুদি রাষ্ট্রশক্তির ঔদ্ধত্য যেমন অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করছে, তেমনি ইন্তেফাও তুঙ্গে। আরব বসতি উচ্ছেদ, ইসরাইলি বাহিনীর গুলি, ফিলিস্তিনিদের শাহাদত, আগুন, বোমা, বুলডোজার ধ্বংস, নাশকতা প্রভৃতি অনবরত ঘটেই চলেছে যুগ যুগ ধরে। এই জালিমদের জুলুম থেকে নিষ্পাপ শিশুরাও রেহাই পায়নি। শিশু-মহিলাদের নির্বিচারে খুন করা হচ্ছে। তাদের হয়ে কেউ কথা বলার নেই এ জগতে। সবাই পশ্চিমা শয়তানদের নিয়ে ব্যস্ত, শয়তানদের কীভাবে খুশি রাখা যায় একই চিন্তা বাকি সবার।
বেশ কয়েক বছর আগে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএলএ) প্রতিষ্ঠা করে কিছু স্বশাসিত এলাকা। তখন মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ সন্তুষ্ট হতে পারেননি একেবারে। তবু অনেকটা সাময়িকভাবে হলেও মেনে নিয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন, যা হোক মন্দের চেয়ে ভালো, সামান্য কিছু পাওয়া গেল। ধারণা করা হয়েছিল দেরিতে হলেও স্বশাসনের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া যাবে স্বাধীনতার দিকে। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে ইসরাইলি ইহুদিদের বেপরোয়া আচরণের ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামও স্বাভাবিকভাবেই হয়ে ওঠে জোরদার। এ অবস্থার মধ্যে চরমপন্থি এরিয়েল শ্যারন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে আসায় ফিলিস্তিনিদের স্বশাসন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। তার ক্ষমতা গ্রহণের পরে আশংকা হতে থাকে ফিলিস্তিনিদের। স্বাধীনতার পথে অগ্রগতি হওয়া তো দূরের কথা আরাফাতের প্রশাসনের বর্তমান অবস্থানটুকু হয়তো ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। এটা গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু ওআইসি এবং প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সরকারসমূহ তাদের দীর্ঘদিনের লিপ-সার্ভিস কাটিয়ে এবারও বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার সূর্যোদয় কবে ঘটবে? এর জবাব কে দেবে? যদি চলমান অবস্থার আলোকে বলেন, তবে বলতে হবে দিল্লি দূর অস্ত। অর্থাৎ এখনো অনেক দূরে, তাহলে তাকে দায়ী করা যায় না। এটা হতাশাবাদীদের কথা নয়। ফিলিস্তিনি ইস্যু আজকের অচলাবস্থায় এসে যাওয়ার পিছনে বিশেষ করে আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের ভীরুতা সুবিধাবাদ, অনৈক্য ও সা¤্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল হয়ে নাচা এবং নিশ্চেতন মনোভাব বেশির ভাগ দায়ী। ২০০৩ সালের গোড়ার দিকে বিখ্যাত সাময়িকী ইমপ্যাক্ট ইন্টারন্যাশনাল দুঃখের সঙ্গে লিখেছে, ‘ফিলিস্তিনি ভুখ-ে ইসরাইলি বুলেটে শহীদের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। মুসলিম বিশ্বের ক্লাসাবাংকা থেকে জাকার্তা পর্যন্ত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সৃষ্টি হয়েছিল জনগণের চাপ, কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। এমনকি আরবদের বাণী ও বিবৃতির ভাষায় আর আগের তেজ নেই অথচ এখনো শহীদের তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।’
২০০০ সালের নভেম্বর মাসে মুসলিম বিশ্বের নেতারা কাতারের দোহায় মিলিত হন শীর্ষ এক বৈঠকে। এ জাতীয় সভা সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে বিধায় উম্মেহার প্রত্যাশা ছিল। অনেকে কিন্তু এ সম্মেলন পর্বতের মুসিক প্রসবের মতো ফলাফল দিয়ে সবাইকে বিস্মিত করল। ফিলিস্তিনি পরিস্থিতির অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে, বাড়ছে জটিলতা। তবুও এই সম্মেলনে প্রস্তাব নেওয়া হলো দুর্বল দায়সারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হানাদার দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে ঘোষণা পর্যন্ত দিতে সাহস পায়নি। সম্মেলনের আগে আরব ও ইরান চাপ দিলেও আয়োজক দেশ কাতার ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ইমপ্যাক্ট সাময়িকীর ভাষায়, ‘উউ সম্মেলনে যোগদানকারী নেতৃবৃন্দের ভূমিকায় মুসলমানদের মর্যাদা রক্ষা না পেয়ে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে।’
যখন মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা এহেন লজ্জাকর দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছেন তখন ইসরাইল তার আধিপত্যকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত ও আগ্রাসনকে আরও অব্যর্থ করার কাজে ব্যস্ত। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই ইসরাইলের নতুন নেতা শ্যারন ঘোষণা দিলেন, ফিলিস্তিনিদের ছাড় দেওয়া হবে না। জেরুজালেম থাকবে ইসরাইলেরই। অধিকৃত এলাকায় আরও ইহুদি বসতি স্থাপিত হবে। এই হলো মার্কিন শয়তানদের দোসর শ্যারনের বক্তব্য। ফিলিস্তিনিদের দেওয়া হবে না আর কোনো ভূখ-। হালকা ভাষায় বলতে গেলেÑ ওআইসিসহ মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলো বসে বসে আঙ্গুল চুষবে, শয়তানের বড় শয়তান যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য শিবির মাঝেমধ্যে আদর দেখিয়ে পিঠ চাপড়াবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত বলেই জালিম শ্যারন এমনভাবে ফিলিস্তিনিদের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পেরেছেন।
পাশ্চাত্যের দুটি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইট ওয়াচ, তাদের প্রদত্ত পরিসংখ্যান রক্ষণশীল হওয়াই স্বাভাবিক বলেই ধরে নিতে হয়। কারণ তারা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার প্রবক্তা নয়। মানবাধিকারের সমর্থক মাত্র। ২০০০ সালে সংগঠন দুটো বলেছে ‘৯ মাসে ইসরাইলি সেনারা ১৪৭০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। তাদের বেশির ভাগই অন্যায় হত্যাকা-ের শিকার।’ এখনো দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে দুজন করে প্রাণ হারাচ্ছেন। এদিকে অ্যামনেস্টি ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ফিলিস্তিনি মানবাধিকার রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। ২০০০ সালের শেষ দিকে ফিলিস্তিনিরা জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানায় শান্তির স্বার্থে। অন্যদিকে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন শান্তি পরিকল্পনার ফর্মুলা পেশ করেন। জাতিসংঘ বাহিনী বিশ্বের বহু অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে। যেসব অঞ্চলে উত্তেজনা ও অহিংসতার মাত্রা ফিলিস্তিনিদের চেয়ে অনেক কম, বলা যায় কোনোভাবে তুলনীয়ও নয়, সেসব স্থানে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষীবাহিনী পাঠানো হয়েছে অথচ রোজদিন গাজায় নিষ্পাপ শিশুদের জীবন বোমার আঘাতে শেষ করে দেয়া হচ্ছে। কী দোষ তাদের? এখানে শান্তি রক্ষীবাহিনী মোতায়েনে অসুবিধা কি? পৃথিবীর কেউ কি তা দেখে না? এত অন্যায়, জুলুম, পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে কি? তার কি কোনো প্রতিকার নেই? আজ কোথায় জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাগুলো? শান্তি রক্ষীবাহিনী ফিলিস্তিনে পাঠানো কী কারণে নাকচ হয়ে যায়? মাত্র এক ভোটের ব্যবধান। প্রস্তাবটা দিয়েছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ন্যাম। ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদের ৮ দেশ অর্থাৎ বেশির ভাগ সদস্যই এর পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু নিয়মমাফিক ৯টি দেশের সমর্থন প্রয়োজন। বাংলাদেশ ও একমাত্র বৃহৎ শক্তি হিসেবে চীন ছিল ৮টি দেশের অন্তর্ভুক্ত। বড় শয়তান যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য ৪টি বৃহৎ শক্তি ভোট না দিয়ে বসে থাকে। এখানেই তাদের হিং¯্রতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। এর পরই ওয়াশিংটনে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা শুরু হয়। সূচনাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় এর অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই। আর থাকবে কেন, তারাই ফিলিস্তিনে এ অশান্তির মূল চাবিকাঠি। কারণ তাদের কারণেই ইসরাইলের একগুঁয়েমি শিথিল হয়নি। তার পর স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের নিধন চলতেই থাকে। মার্কিন সরকারের প্রথম ইহুদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন আলব্রাইট বলেন, ‘মধ্যেপ্রাচ্য শান্তিচুক্তির সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।’ তাদের চুক্তির উদ্দেশ্য আরবদের বেলায় গরু মেরে জুতা দানের মতো কিছু ঘটিয়ে ইসরাইলকে নিরাপদ রাখা কারণ ওদের দরকার। ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়? এটাই ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বন্ধুদের ধারণা। ক্লিনটন-আরাফাত বৈঠকে বসল। আরাফাত ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতায় সম্মতি জানালেন। তবু কোনো লাভ হলো না। অতএব, ক্লিনটন ২০০১ সালের সূচনাতে কোনো কূটনীতির আশ্রয় নিলেন। লিবিয়ার গাদ্দাফি বক্তব্য দিলেন ক্লিনটনের প্রস্তাবে। এটা মেনে নিলে দেখা দেবে চরম বিপর্যয়। একই দিন পত্রিকায় ছাপা হলো কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না।
ক্লিনটনের শান্তি প্রস্তাব বা ফর্মুলায় কী ছিল? তাতে বলা হয়, পুরো গাজা উপত্যকা এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের ৫ শতাংশ ভূখ- নিয়ে গঠিত হবে ফিলিস্তিনি নামক রাষ্ট্র। পশ্চিম তীরের অবশিষ্ট ৫ শতাংশ ভূমিতে ইহুদি বসতি থাকবে। ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমির ক্ষুদ্র এক অংশ পাবে। প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘এ যাবৎ সংঘটিত যুদ্ধে যেসব ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে, বর্তমানে ইসরাইলে অবস্থিত তাদের ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দিতে আরাফাত দাবি জানাতে পারবেন না। ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেম এবং মসজিদুল আকসার অংশবিশেষের ওপর অর্জন করবে সার্বভৌম অধিকার।’ পর্যবেক্ষকদের মতেও ২০০০ সালের জুলাই মাসে ক্যাম্পডেদিডে ক্লিনটন যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন উপরোক্ত প্রস্তাব সে তুলনায় উত্তম। তবে এর বাস্তবায়নে ইসরাইলের আন্তরিকতা থাকবে বলে আরাফাতের বিশ্বাস হয়নি। তখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইহুদ বারাক। এরপর শ্যারন অধিষ্ঠিত হন। শ্যারন বারাকের চেয়ে অধিক জালিম ও উগ্রপন্থি। সুতরাং বর্তমান ইসরাইল সরকারকে বিশ্বাস করা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অসম্ভব। ফিলিস্তিনি ইহুদিদের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বর্বর দমন-পীড়নের পাশাপাশি শান্তির ব্যর্থ অন্বেষার মধ্যে ক্লিনটন বিদায় নেন। একই সঙ্গে তার দল ডেমোক্রেটিক পার্টি মার্কিন সরকার থেকে বিদায় নেয়। ক্ষমতাসীন হয় রিপাবলিকান পার্টির শয়তানের গুরু জর্জ বুশ। ইসরাইলের কথিত উদারপন্থি বারাক আর কট্টরপন্থি শ্যারন যে কেউ ক্ষমতাসীন হোন না কেন ফিলিস্তিনিদের মনোভাব একই। এক্ষেত্রে তাদের আচরণের যে কিঞ্চিৎ ফারাক থাকে তা নীতিগত নয়, কৌশলগতও। তেমনি দেখা যায় ডেমোক্রেটিক আর রিপাবলিকান যারাই সরকার গঠন করুক না কেন ফিলিস্তিন আর মুসলমানদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ নেই বললেই চলে। ফলে কার্যত পরিস্থিতির হেরফের হয় না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ আরাফাতকে বলেছিলেন, শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে শ্যারনকে আরও সুযোগ দিন। বুশ সাহেবের দরদ শ্যারনের প্রতি। অর্থাৎ সুযোগ আরও দাও ফিলিস্তিনিদের হত্যা করতে। এ কথা দ্বারা কি বোঝা যাচ্ছে শ্যারন শান্তির দূত? আর আরাফাত এবং ফিলিস্তিন যত সব অশান্তির জন্য দায়ী? জালিম বুশের এ বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় শান্তির দূত শ্যারন মিসাইল মেরে হত্যা করে অগণিত সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে? মধ্যপ্রাচ্য সফরে আসেন মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল। ফিলিস্তিনে শান্তি প্রক্রিয়ার কথা বললেন বটে, তবে তার এ সফরের দুটি মূল লক্ষ্যের একটি ছিলÑ ইরাকের বিরুদ্ধে অবরোধের পক্ষে সমর্থন আদায়। এই সময়ে ইসরাইল মার্কিন সরঞ্জাম ব্যবহার করে ফিলিস্তিনি ঘাঁটি ধ্বংস করে, যা মার্কিন আইনের লঙ্ঘন। তবুও মার্কিন সরকার পদক্ষেপ নেয়নি ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, এমনকি টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। কারণ এটা তো হচ্ছে তাদের পোষ্যপুত্র? এদের দিয়ে তারা মুসলমান শিকার করবে। অন্যদিকে ইরাক ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করার পরিকল্পনা নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। বারাক সরকারের থেকে শত গুণ বেশি অত্যাচার জুলুম চালায় শ্যারন সরকার। নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার তো আছেই, তদুপরি অমানবিক অবরোধ আরোপ করে ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে বেকার বানিয়ে দেওয়া হয়। কৌশলগত কারণে হলেও বারাকের কিছুটা রাখঢাক ছিল। কিন্তু ধ্বংসাত্মক চরমনীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে শ্যারন লজ্জা ও দ্বিধাহীন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগেও শ্যারনের উস্কানিমূলক ভূমিকা মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ইন্তিফাদায় দলে দলে অংশ নিয়ে ফিলিস্তিনিরা মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইল দিশাহারা হয়ে পড়ে। কারণ ইন্তিফাদার বিজয় মানেই শ্যারনের মৃত্যুঘণ্টা। প্রকৃত সীমানা মোতাবেক স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ ইসরাইলের নাম-নিশানা মুছে যাওয়া। তাই ইহুদিবাদী সরকার মরিয়া হয়ে নিষ্ঠুর দমননীতির আশ্রয় নেয়। কিছু দিন ধরে অবস্থা নজিরবিহীন রূপ ধারণ করে। ইসরাইলের সৈন্যরা গুলি চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের নেতা হাসান আরবিকেও আহত করে। হত্যা করে আলফাতাহ বাহিনীর কামান্ডার ইসলামী জিহাদি নেতা এবং ফিলিস্তিনি প্রশাসনের কর্মকর্তাকে। ইসলামী বিপ্লবে বিশ্বাসী আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘হাসান’ ইসরাইলের বিশেষ টার্গেট ছিল। জেরুজালেমের কাছে বিরাট ইহুদি বসতি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় শ্যারন প্রশাসন। গাজায় বিমান ও ফিলিস্তিনি থানায় রকেট হামলা চালায়। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের গাড়িতে গুলি চালিয়ে হত্যা করে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের। ট্যাঙ্ক ও হেলিকপ্টার গানশিপের সাহায্যেও আক্রমণ চালায়। গাজা ও পশ্চিমতীরে সংঘর্ষে ও বিস্তৃতির মধ্যে আরও সৈন্য প্রেরণ এবং সর্বাত্মক হামলার হুমকি দেয় রক্তপিপাসু শ্যারন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বলেন, ফিলিস্তিনিদের ওপর এই ইসরাইলি নির্যাতন নাৎসি নৃশংসতাকেও ম্লান করে দিয়েছে। শত জুলুম নিষ্পেষণের পরও মুক্তিপিপাসু বুলেটবিদ্ধ ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘পাথর ছুঁড়ে কিছু করতে পারি না। তবে এ কথা বুঝিয়ে দিচ্ছি যে আমরা ওদের দখল মানিনি।’ ইসরাইল ক্রমবর্ধমান দৃষ্টতার ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি গাজায় স্বয়ং আরাফাতের সদর দফতরে জঙ্গি হেলিকপ্টার হামলা চালায়। এমনকি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে। এ সময় কয়েকজন ফিলিস্তিনি পুলিশও ইহুদিদের হাতে প্রাণ দেন। ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদর দফতরে ইসরাইলি হামলায় ১২ জন রক্ষী নিহত ও ৯০ জন আহত হন।
এসব ঘটনার পর আরব লীগ সিদ্ধান্ত নেয় ইসরাইলের সঙ্গে সব রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার। ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য জরুরি বৈঠকের আয়োজন করতে আহ্বান জানানো হয় জাতিসংঘের প্রতি। সাম্প্রতিককালে ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের বাহিনী বা আন্তর্জাতিক সৈন্য নিয়োগের জন্য প্রথমে ফিলিস্তিনিরা আহ্বান জানিয়েছিল। তখন শয়তানের গুরু যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। এরপর একই আহ্বান জানান আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এবার জাতিসংঘের ভোটাভুটির সময় যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। চীন, রাশিয়া ছিল প্রস্তাবের পক্ষে। মার্কিন ভোটের ফলে ফিলিস্তিনিদের রক্ষার্থে আন্তর্জাতিক বাহিনী প্রেরণের উদ্যোগ নেয়া গেল না। আরাফাত বলেছিলেন, ‘ইসরাইল পবিত্র ভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের মুছে ফেলতে চায়।’ এ ছাড়াও তিনি ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনিকে ধ্বংস করার জন্য ইসরাইল বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করছে।’
২০০১ সালের মে মাসের শেষে মার্কিন মধ্যস্থতায় আবার ফিলিস্তিনি-ইসরাইল আলোচনা শুরু হতে না হতে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। জুন মাসে অস্ত্রবিরতির মাঝেও শ্যারনের রক্তপিপাসু সৈনিকরা গুলি চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা অব্যাহত রাখে। এদিকে ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসন প্রতিরোধে ইসলামী সংগঠন হামাস জিহাদের গতিবেগ বৃদ্ধি করে। এখন আরাফাতের চেয়ে তারাই ইসরাইলের জন্য বড় বিপদের কারণ। মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিশেল রিপোর্টে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিলÑ ‘এখনই রক্তপাত বন্ধ না হলে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে লড়াই চলতে থাকবে বছরের পর বছর।’ পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, সদ্য বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের শান্তি ফর্মুলা ব্যর্থ হওয়ার পর পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বুশের সামনে ছিল কঠিন পরীক্ষা। চরম সাম্প্রদায়িক ও গোঁড়া আগ্রাসী শ্যারনকে ঠেকাতে না পারলে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বলন্ত মাইনফিল্ডে বুশ ‘সমাহিত’ হবেন। ১৯৮২ সালে ইসরাইল ভয়াবহ হামলা চালিয়েছিল লেবাননে। ধ্বংস করেছিল বৈরুতের সাবরা ও শাতিলা ক্যাম্প। তখনো নিষ্ঠুর গণহত্যার শিকার হয়েছিল ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুরা। এ হত্যাকা- ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রধান কলঙ্ক। এ হত্যাকা-ের পরিচালনায় ছিলেন ইসরাইলের জালিম নেতা এরিয়েল শ্যারন।
বসনিয়ায় গণহত্যার দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন যুগোশ্লাভিয়ান প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট স্লোবেদান মিলোসেভিচ। তাকে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়েছিল। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় ও সুবিচারকামী জনগণ এ বিচারে আনন্দিত হয়েছিল। বসনিয়ায় গণহত্যা ঘটানো ১৯৯০-এর পরপরই শুরু হয়। ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা বেশ ক’বছর আগে থেকে চলে আসছে। ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধে এবং তাদের আজাদী নিশ্চিত করতে মিলোসেভিচের মতো রক্তপিপাসু শ্যারনকেও আসামির কাঠ গড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এ দায়িত্ব নিতে হবে আরব বিশ্বসহ মুসলিম দেশসমূহ, জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাসমূহকে। অন্যথায় বিশ্বে শান্তি বিনষ্ট হবে এবং সা¤্রজ্যবাদী শক্তিরা দুর্বল জাতিসমূহকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস অব্যাহত রাখবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন