মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

ষষ্ঠ কাউন্সিল : বিএনপি কি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে?

মেহেদী হাসান পলাশ | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্ম ১৯ জানুয়ারি। তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির মূলভিত্তি ১৯ দফা। ১৯ সংখ্যাটিকে শুভ ধরেই হয়তো আগামী ১৯ মার্চ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি তাদের ৬ষ্ঠ কাউন্সিলের দিন নির্ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে কাউন্সিলের লোগো উন্মোচন করা হয়েছে। এবারের কাউন্সিলের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’।
৭ বছর আগে ২০০৯ সালে ৮ ডিসেম্বর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত পঞ্চম কাউন্সিলের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘নানা মানুষ নানা মত, দেশ বাঁচাতে ঐক্যমত’। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা গ্রিনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন। তার মৃত্যুর পর ১৯৮৪ সালে তার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেন। সেই থেকে টানা ৩২ বছর বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বেগম খালেদা জিয়া।
আগামী ১৯ মার্চ সকাল ১০টায় রাজধানীর রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। কাউন্সিলের প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে। কাউন্সিলে যোগদানের জন্য ইতোমধ্যে সারাদেশ থেকে আসা বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজধানীমুখী হতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে প্রবাসী নেতারা আরো আগেই ঢাকায় পৌঁছে সিনিয়র নেতাদের বাড়ি, অফিসে তদবির শুরু করেছেন। দুই/তিন মাস আগেও যে বিএনপি কার্যালয় খাঁ খাঁ করতো, সেই কার্যালয় এখন নেতাকর্মীর সমাগমে মুখর। গুলশান অফিসের কথা তো বলাই বাহুল্য। গত ৭ বছর ধরে একের পর এক কর্মসূচি দিয়েও যেসব নেতাকর্মীদের রাজপথে দেখা যায়নি এখন দলীয় পদ পেতে তারাই কাউন্সিল প্রস্তুতির কার্যক্রমে ন্যূনতম ভূমিকা রাখার জন্য উন্মুখ।
ইতোমধ্যেই বিএনপি’র চেয়ারপার্সন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান পুনর্নিবাচিত হয়েছেন। দলের ভেতর তারেক রহমানকে কো-চেয়ারম্যান করার দাবি উঠেছে। সেক্ষেত্রে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদটি কী হবে- এই বিতর্কের সঠিক সুরাহা না হলে তিনি এ পদেই থেকে যেতে পারেন। তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়ইদা রহমানকে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজনীতিতে নিয়ে আসার প্রস্তাবও অনেকে দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি জিয়া পরিবারের সিদ্ধান্তের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। মহাসচিব পদে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নাম শোনা গেলেও আরো বেশ কয়েকজন এই পদের প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন বলে জানা গেছে। যাদের মধ্যে চট্টগ্রামের আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নাম বেশ জোরের সাথেই শোনা যাচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, এবারের কাউন্সিলে বিএনপি’র গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা হবে। জানা যায়, বিষয় ও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কমিটিগুলোর মধ্যে থাকছে- পররাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি, যোগাযোগ, সুশাসন, পানি, পরিবেশ ও বন, বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি, স্থানীয় সরকার ও সমবায়, প্রতিরক্ষা, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ, নির্বাচন কমিশন, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু এবং নারী বিষয়ক। প্রতিটি কমিটিতে একজন করে সম্পাদক থাকবেন, যার পদমর্যাদা নির্বাহী কমিটির সম্পাদকের মতো। আরেকজন সহ-সম্পাদক ও ১০ জন করে সদস্য থাকবেন। সবাই নির্বাহী কমিটির মতোই মর্যাদা পাবেন। ১৭ সেক্টরে সর্বমোট ২০৪ জন সদস্য রাখার চিন্তাভাবনা রয়েছে। যুব মহিলা দল নামে একটি সহযোগী সংগঠন সৃষ্টির প্রস্থাব রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস উইংয়ের পাশাপাশি কমিউনিকেশন নামে পৃথক একটি বিভাগ থাকবে। কমিউনিকেশন বিভাগের অধীনে থাকবে ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া। তবে বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে স্থায়ী কমিটির অবস্থান থাকছে আগের মতোই। মহাসচিব থাকছেন একজনই। একাধিক নাম প্রস্তাবও আছে। বিএনপির উপদেষ্টা ও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা নামে উপদেষ্টা পরিষদকে দুই ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। বিএনপির উপদেষ্টারা নির্বাহী কমিটিতে যথাযথ মর্যাদা পাবেন। চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টারা বিশেষ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাবেন। যথারীতি ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, দফতর সম্পাদক, অর্থ সম্পাদক ও প্রচার সম্পাদক থাকবেন। সব মিলিয়ে সাংগঠনিক নেতা থাকবেন ১৭০ জনের মতো। তাছাড়া জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদাধিকারবলে নির্বাহী কমিটির সদস্য হবেন। এ সংখ্যা হতে পারে ১৫০ জন। তবে তাদের কেউই কেন্দ্রের অন্য কোনো দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। সর্বস্তরে এক নেতার এক পদ রাখার জোর চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ৩৫১ সদস্যের বেশি হবে না। তবে জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নির্বাহী কমিটির সদস্যের মর্যাদা দেয়া হলে এর সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০১-এ। বিষয়ভিত্তিক কমিটিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের প্রাধান্য থাকবে।
সারা দেশে বিএনপির আসন্ন কাউন্সিলকে ঘিরে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে নেতাকর্মীদের মাঝে। গণতন্ত্রকামী জনগণ যারা দেশের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতি দেখতে চায় তারাও বিএনপির এই কাউন্সিল নিয়ে আগ্রহী। নানা কারণে বর্তমান রাজনৈতিক শ্রোতধারায় কিছুটা পিছিয়ে পড়া বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেশের মধ্যে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চায় ভারসাম্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টি করবে এ প্রত্যাশা তাদের। বিএনপির কাউন্সিলের প্রতিপাদ্যের দিকে তাকালেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। এবারের কাউন্সিলের প্রতিপাদ্য- ‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’। এছাড়াও বিএনপির সকল অঙ্গ-সংগঠনের প্রতিপাদ্যগুলোও বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন- যুবদল তাদের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘তারুণ্যে যারা অকুতোভয়, তারাই আনবে সূর্যোদয়’। কৃষক দলের প্রতিপাদ্য, ‘ফলাবো ফসল, গড়বো দেশ, গণতন্ত্রে বাংলাদেশ’। মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রতিপাদ্য, ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র, মুক্ত করো গণতন্ত্র’। শ্রমিক দলের প্রতিপাদ্য, ‘শ্রম দিয়ে শিল্প গড়বো, দেশের আঁধার ঘুচিয়ে দেবো’। মহিলা দলের প্রতিপাদ্য, ‘চেতনায় নারী, বিপ্লবে নারী, গণতন্ত্র ফেরাতে আমরাই পারি’। ছাত্রদলের প্রতিপাদ্য, ‘বাঁচতে চাই, পড়তে চাই, দুর্নীতি মুক্ত দেশ চাই’। স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিপাদ্য, ‘আলোর দিন দূরে নয়, করতে হবে আঁধার জয়’। জাসাসের প্রতিপাদ্য, ‘গাইবো মোরা গণতন্ত্রের গান, দুঃশাসনের হবেই অবসান’। তাঁতী দলের প্রতিপাদ্য, ‘শক্ত হতে বাঁধো তাঁত, কাটাতে হবে আঁধার রাত’, মৎস্যজীবী দলের প্রতিপাদ্য, ‘জালের টানে ঘুচবে আঁধার, বাংলাদেশ হবে সবার’ এবং ওলামা দলের প্রতিপাদ্য, ‘জিয়ার আদর্শে দেশ গড়বো, ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রাখবো’। এই প্রতিপাদ্যগুলো বিশ্লেষণ করলেও দেখতে পাওয়া যায়, বিএনপি নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানো ও দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাকে আসন্ন কাউন্সিলে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু শুধু কাউন্সিলের মাধ্যমে তা কতোটা সফল হওয়া সম্ভব হবে বিএনপির পক্ষে সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির বর্তমান সঙ্কট যতোটা না সাংগঠনিক তার চেয়ে অনেক বেশি আদর্শিক। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির আদর্শ কী? বিএনপির আদর্শ হিসেবে শহীদ জিয়া তার বিভিন্ন বক্তৃতা ও রাজনৈতিক ক্লাসগুলোতে যা বলেছেন খুব সংক্ষেপে বললে তা দাঁড়ায় এরকম যে, উদার ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন আধিপত্যবাদ বিরোধী একটি মধ্যমপন্থা যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব মর্যাদা ও উন্নয়নকে নিশ্চিত করে। জিয়াউর রহমান এর নাম দিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জিয়াউর রহমানের আবিষ্কৃত কোনো দর্শন ছিল না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার চেতনা, মূল্যবোধ, আত্মমর্যাদা ও উন্নয়ন চিন্তা, কৃষ্টি ও ধর্মীয় চেতনার সংমিশ্রণ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। হাজার বছর ধরে এ চেতনা ও আকাক্সক্ষা এই ভূখ-ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর শোনিতে অনুরণিত হয়েছে। জিয়াউর রহমান তাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছেন। ফলে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অতিদ্রুত জিয়াউর রহমানের দলটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় দলে পরিণত হতে পেরেছে। এর সাথে জিয়াউর রহমান নিজের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব, সততা, ইমেজ, শ্রম, সাধনা, দেশপ্রেম দিয়ে বিএনপিকে সাড়ে তিন বছরেই দেশের অন্যতম বৃহৎ দলে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের বিভিন্ন দল, মত ও পেশার যোগ্য লোকদের বিএনপির পতাকা তলে সমবেত করে বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনে তাদের পরিচালিত করেছেন। জিয়ার ইমেজ, আদর্শ ও খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে নব্বই দশকে বিএনপি পুনরায় নির্বাচিত হয়। এসময় জিয়াউর রহমানের অসমাপ্ত কাজ অর্থাৎ বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের স্বরূপ দলীয় নেতাকর্মী তথা দেশবাসীর মাঝে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু দেশ পরিচালনায় ব্যস্ত হয়ে বিএনপি সে সুযোগ নষ্ট করে। ফলে বিএনপির অভ্যন্তরে ডান-বামের টানপোড়েন সৃষ্টি হয়। ডানপন্থীরা বিএনপিকে চরমপন্থী দল এবং বামপন্থীরা বিএনপিকে ধর্মনিরোপেক্ষ কমিউনিস্ট দলে পরিণত করার জন্য গ্রুপিং শুরু করে। এই দোটানায় যখন যে গ্রুপ ক্ষমতাবান হয়েছে তখন তারা বিএনপিকে তাদের মতো করে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছে। ফলে বিএনপির নিজস্ব মধ্যপন্থী যে রাজনৈতিক দর্শন তা দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চর্চিত ও অনুসৃত হতে পারেনি। এই সঙ্কট বিএনপির একটা বড় অংশের নেতাদের আদর্শহীন, ত্যাগ ও দেশপ্রেমহীন ভোগবাদী রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে ২০০১ সালে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হওয়ার পরও বিএনপি দেশ ও দল পরিচালনায় নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। যেমন ৫ম সংশোধনী, যা বিএনপির রাজনীতির মূল খুঁটিগুলোর একটি- তাকে ভেঙে পড়তে দেখেও বিএনপি নির্বিকারভাবে দেড় বছর পার করেছে। দেশি-বিদেশি মিত্র ও শক্তিগুলো ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক লাভের বলি করে বিএনপি নিজেই শেষ করেছে বা শত্রুতে পরিণত করেছে। আদর্শের থেকে স্বজনপ্রীতিও আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেয়ায় ১/১১-র মতো ষড়যন্ত্র ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এসময় নেতা, মন্ত্রী, এমপিরা ভোগবাদী রাজনীতির প্রতিযোগিতায় নিজের আখের গোছানোর কাজে এতো বেশি ব্যস্ত ছিলো যে, ১/১১ মতো ভয়ানক ষড়যন্ত্রের পদধ্বনীও শুনতে পায়নি। যারা শুনেছেন তারা লুণ্ঠিত সম্পদ রক্ষায় সেই মিছিলে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন। ১/১১-এর পর ফখরুদ্দীন সরকার বিএনপি নেতাদের দুই ভাগেভাগ করে। একভাগ সংস্কারপন্থী নামে দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল তৈরি করে। আরেক ভাগকে খালেদাপন্থী করে তার পাশে রাখা হয় তাকে নিয়ন্ত্রণ ও তার খোঁজ-খবর জানার জন্য। কিন্তু সাধারণকর্মী ও স্বল্প সংখ্যক ত্যাগী নেতার কারণে খালেদা জিয়া ১/১১ সংকট উৎরাতে সক্ষম হন। ফখরুদ্দীন সরকার ব্যর্থ হলে তাদেরই ভাগ করা খালেদাপন্থী অংশ জেলমুক্ত খালেদা জিয়ার পাশে অদৃশ্য ইশারায় অভিন্ন উদ্দেশ্যে বসে যান। এই তথাকথিত খালেদাপন্থী নেতারা বিএনপির ত্যাগী নেতাদের চেয়ারপার্সনের অফিসের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। ফলে খালেদা জিয়ার পক্ষে ১/১১-র পেছনে তার দলীয় নেতাকর্মীদের কার কী ভূমিকা তা জানা সম্ভব হয়নি। বরং যে যখন যেভাবে সুযোগ পেয়েছে নিজের মতো করে তাকে গল্প শুনিয়েছে। ১/১১’র পর বিএনপির উচিত ছিলো কী কারনে এবং কাদের কারণে ১/১১ সৃষ্টি এবং এতে তার দলের নেতাদের কী ভূমিকা ছিলো, ১/১১ পর তার নেতাদের কার কি অবস্থান ছিলো সে বিষয়ে গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু বিএনপি সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দল বিরোধী কর্মকা-ে জড়িত হলে, দলীয় শৃঙ্খলা ও কমান্ড ভঙ্গ করলে যে দলীয় শাস্তি পেতে হবে, সে ভয় ও বাধ্যবাধকতা আর বিএনপি নেতাদের থাকেনি। ফলে ৫ মে ২০১৩ শাপলা চত্বরে দলীয় নেতাকর্মীদের নামার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়া হলেও নেতারা সেনির্দেশ অমান্য করার সাহস দেখাতে পেরেছে। ২৯ ডিসেম্বর বা ৫ জানুয়ারির পর চেয়ারপার্সন দলীয় কার্যালয়ে বালির ট্রাকে বন্দি থাকলেও নেতাকর্মীরা গুলশান অফিস মুখো হয়নি। এমনকি পরপর দুইবার খোদ বেগম খালেদা জিয়া নিজে রাজনৈতিক কার্যালয়ের গেইটে নেমে এসে দলীয় নেতাকর্মীদের রাজপথে নামার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আহ্বান জানালেও রাজধানীতে কোনো নেতাকে নামতে দেখা যায়নি। অথচ সাফল্যহীন আন্দোলন শেষে এই নেতাদেরই গুলশান অফিসে সফেদ পাঞ্জাবী পরে টিভি ক্যামেরার সামনে বসতে দেখা গেছে। খালেদা জিয়ার আহ্বানে কেন তারা রাস্তায় নামেনি দলে এ মর্মে তাদের কোন জবাবদিহী করতে হয়নি। আদর্শহীন রাজনীতি এতোটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, সামান্য বিপদের আভাসে যে নেতা জীবনে বিএনপি করবো না বলে নাকে খৎ দিয়েছে, বিপদ শেষে সেই নেতাকে আবার না ডাকলেও বিএনপি অফিসে গিয়ে সামনের কাতারে বসতে দেখা যাচ্ছে।
পত্রিকার রিপোর্ট যদি সঠিক হয় এবার বিএনপিতে ‘আদিবাসী ও সংখ্যালঘু’ বিষয়ক একটি উপ-কমিটি হচ্ছে। অথচ বিএনপি আদর্শিকভাবে ‘সংখ্যালঘু’ ও ‘আদিবাসী’ শব্দগুলো সব সময় অস্বীকার করে এসেছে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে কিম্বা ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে বহুবার বলেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলে কেউ নেই। বিএনপি সংখ্যালঘু ধারণায় বিশ্বাস করে না। অপরদিকে ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৫ সালে জাতিসংঘে চিঠি লিখে বিএনপিই প্রথম জানিয়েছিল, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। তাছাড়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কনসেপ্টের সাথে এই দুটো শব্দ সাংঘর্ষিক।
নেতাদের এই ভোগবাদের কারণে বিএনপি নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচি প্রচারে শক্তিশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বেশকিছু গণমাধ্যমের লাইসেন্স দিলেও অনুমতি পেয়েই নেতারা তা দিয়ে টাকা কামানোর ধান্দায় ব্যবহার করতে গিয়ে দলীয় আদর্শ বিরোধীদের হাতে তুলে দিয়ে আত্মঘাতী প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছে। কেউ আবার সরাসরি বিক্রি করে দিয়েছে। হাওয়া ভবনের বিরুদ্ধে প্রচারে বিএনপি নেতাদের মালিকানাধীন গণমাধ্যম যতটা আগ্রহী ছিল, বর্তমানের নোয়াবাজার ও বড় বড় ব্যাংক লুটের ঘটনায় তাদের ততটায় সিরাসক্ত দেখা যাচ্ছে। ফলে বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন প্রচার ও আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে এখন কোনো মিডিয়া নেই বললেই চলে। একই অবস্থা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রেও। রাজনীতিতে আদর্শিক চর্চার অনুপস্থিতির কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায়ও বিএনপি চরম অবহেলা ও উদাসীনতা দেখিয়েছে। এই সুযোগে বিএনপি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রগুলোতে জোট সহযোগী জামায়াত ডমিনেট করতে শুরু করেছে। বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো ডমিনেট করে জামায়াত বিএনপিকে দিয়ে তার রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণ করাতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৮ সালে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়া এর মধ্যে অন্যতম। এই আদর্শিক চর্চার অনুপস্থিতি ও গণমাধ্যমের সমর্থনহীনতা বিএনপিকে কার্যত রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে গত কয়েক বছরে সরকারের একের পর এক ব্যর্থতা ও অপকর্মের বিরুদ্ধে বিএনপি যেমন কোনো জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, তেমনি জনমত গঠন করতে জোরালো কোনো বক্তব্যও উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে ভয়াবহ আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম তোলপাড় হলেও বিএনপি দায়সারা বক্তব্য দিয়েছে। একইভাবে শেয়ারবাজার ধস, সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন অর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও দূর্নীতি নিয়েও বিএনপিকে জোরালো কোনো বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা নির্বাচনে পর ইউনিয়ন পরিষদ যেন আওয়ামী লীগের হাতে ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। আজ বলা হচ্ছে, আবারো নির্বাচন বয়কট করলে দেশবাসী আগামীতে বিএনপির সাথে নির্বাচনে থাকবে না এ বলে যে, বিএনপির সাথে নির্বাচনে গিয়ে লাভ নেই, তারা তো শেষ মুহূর্তে বয়কট করবে। কাজেই হারো/জেতো নির্বাচনে থাকো। কিন্তু এর পরের আরো ভয়াবহ ভাবনাটি বিএনপি ভাবেনি। কারণ, জনগণ এটাও ভাবতে পারে যে, বিএনপিকে ভোট দিয়ে লাভ নেই, তারা তো ভোটের সুরক্ষা দিতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম একটি পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র কাউন্সিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন করে বিএনপির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কতোটুকু সম্ভব? ঢাকায় সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে মির্জা আব্বাসকে দিয়ে কমিটি পুনর্গঠন করে কতোটুকু ফায়দা হয়েছে তা বিএনপি নেতাকর্মীমাত্রই অবগত।
প্রকৃতপক্ষে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দল পুনর্গঠনের চেয়েও এই মুহূর্তে তাকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আদর্শের কাছে ফিরে যেতে হবে। দলের নেতাদের মধ্যে আদর্শিক চর্চা বাড়াতে হবে যা তাদের ভোগবাদিতা থেকে দূরে সরিয়ে ত্যাগের মানসিকতায় গড়ে তুলবে। রাজনীতি বিজ্ঞান বলে, জাতীয়তাবাদী শক্তির কোনো আন্তর্জাতিক বন্ধু থাকে না। বিএনপিকেও তেমনি তথাকথিত বিদেশী বন্ধুদের ভরসা বাদ দিয়ে দেশের জনগণ ও দেশীয় শক্তি সঞ্চয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। জাতীয়তাবাদী শক্তির জন্য বিজেপি বা মার্কিন কংগ্রেস কেউ স্থায়ী বন্ধু হতে পারে না। দেশের মধ্যে বিএনপির প্রয়োজনীয়তা, দেশবাসীর মধ্যে বিএনপির অপরিহার্যতা সৃষ্টি করতে হবে। বিদেশী বন্ধুদের ইচ্ছায় বা আঙ্গুলি হেলনে দেশবাসী বিএনপিকে ভোট দিয়ে দেবে এমন চিন্তা বাতুলতা মাত্র। ২০১৩ সালে সারা দেশের রাজনৈতিক মাঠে পাকা ধান ত্যাগী নেতাকর্মীর অভাবে বিএনপি ঘরে তুলতে পারেনি, তসরুপ হয়ে গেছে। আগামী মৌসুমেও ধানগুলো যেনো ঘরে আসে সেজন্য ত্যাগী নেতাকর্মী তৈরি বিএনপির এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শহীদ জিয়ার আদর্শিক চর্চাই কেবল সেই ত্যাগী নেতা তৈরি করতে পারে বলে দেশবাসীর বিশ্বাস।
email : palash74@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Akhter Jahid ১৩ মার্চ, ২০১৬, ৯:৫৬ এএম says : 0
জাতীয়তাবাদী শক্তির কোনো আন্তর্জাতিক বন্ধু থাকে না। বিএনপিকেও তেমনি তথাকথিত বিদেশী বন্ধুদের ভরসা বাদ দিয়ে দেশের জনগণ ও দেশীয় শক্তি সঞ্চয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে
Total Reply(0)
আবু নোমান ১৩ মার্চ, ২০১৬, ৫:২৮ পিএম says : 0
তরুণ, ত্যাগী ও মেধাবী নেতাকর্মেদের বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।
Total Reply(0)
আজাদ ১৩ মার্চ, ২০১৬, ৫:৩২ পিএম says : 0
জোবায়ইদা রহমানকে নিয়ে আসলে খারাপ হবে না।
Total Reply(0)
আবদুল হান্নান ১৩ মার্চ, ২০১৬, ৫:৩৪ পিএম says : 1
মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কোন বিকল্প নেই।
Total Reply(0)
হাফিজ ১৩ মার্চ, ২০১৬, ৫:৩৯ পিএম says : 0
বিএনপির নীতি নির্ধারনী মহলের উচিত এই লেখাটি পড়া।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন