মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

প্যারিস চুক্তি নাকচ করে ট্রাম্প কি ভুল করেছেন?

| প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : ১৯৭৩-এ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজেতা আইভার জিয়েভার একদা বলেছিলেন, কার্বন দূষণের কারণে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এক বিরাট ধাপ্পা। গুচ্ছের টাকা স্রফে পানিতে যাচ্ছে ভূ-উষ্ণায়নের ধান্ধাবাজি আর ভাঁওতাবাজিতে। ভিয়েভারের কথা ধার করে গত মে মাসে নর্থ ডাকোটায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমরা প্যারিস চুক্তিকে বাতিল করব আর জাতিসংঘের কোনও ভূ-উষ্ণায়ন প্রকল্পে আমেরিকা দান-খয়রাত করবে না। ভূ-উষ্ণায়ন একটা ধাপ্পা। কিয়োটো হতে কোপেনহাগেন থেকে প্যারিস, যাবতীয় জলবায়ু সম্মেলনের ও জলবায়ু চুক্তির ধ্রুবপদ একটাই- কার্বন ও গ্রিনহাউস এফেক্ট এবং ভূ-উষ্ণায়ন। গ্রিনহাউস ও ভূ-উষ্ণায়ন ব্যতিরেকে পরিবেশ বা জলবায়ুকে বিপন্ন করে তুলছে যে, আরও হাজারটা বিষয় তা নিয়ে কোথাও কোনো হেলদোল নেই।
নেচে-কুঁদে গান গেয়ে আন্দোলন করে কিয়োটো থেকে কোপেনহেগেন থেকে প্যারিস-জলবায়ু সম্মেলন বা চুক্তি অশ্বডিম্ব ছাড়া বিশেষ কিছু প্রসব করতে পারেনি। বিভিন্ন জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরের ট্র্যাডিশন রয়েছে, কিন্তু নেই চুক্তি সমাপনের কোনো নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট, চুক্তি না-মানলেও নেই কোনো কড়া শাস্তির বিধান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনো রকম আগাম নোটিশ ছাড়াই চুক্তির যাবতীয় শর্তকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিষ্ক্রান্ত হলেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে।
বিশ্বের ১৬১টি দেশ ইতোমধ্যে পেশ করেছে তাদের ইউটেনডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন অর্থাৎ কোন দেশ কবে কতটা কার্বন বা গ্রিনহাউস নির্গমন কমাবে তার নিক্তি-মাপা হিসাবনিকাশ। ১৯৯৭ সালের কিয়োটা প্রোটোকলে স্থির হয়েছিল যে অ্যানেক্স ১-এর দেশগুলো ১৯৯০-এর তুলনায় ২০১২ সালের মধ্যে দূষণ কমাবে ৫.২ শতাংশ। ২০০৯ সালে দেখা গেল সামগ্রিক দূষণ বেড়েছ ১১.২ শতাংশ। সবটাই যে দূষণ কমানোর মিথ্যা বাগাড়ম্বর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভূ-উষ্ণায়নের জন্য দায়ী কি কেবল কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাস? অবৈজ্ঞানিক কুযুক্তি। আইপিসিসি বা ইন্টার গর্ভরমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (জাতিসংঘের একটি ঘোলাটে সংস্থা) ধুয়ো তুলেছে ১৭০০ সালের তুলনায় স্রেফ মনুষ্যকৃত মূর্খামিতে পরিমন্ডলে নাকি অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড যুক্ত হয়েছে। তার ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৬ থেকে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হিমবাহের আয়তন সঙ্কুচিত হচ্ছে, ফলে সমুদ্রপানির উচ্চতা নাকি বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ সেমি। কার্বন দূষনের করাল থাবায় নাকি অপসৃয়মাণ উত্তর মেরুর বরফের চাদর। গত ১০০ বছরে সব থেকে গরম ৯টি গ্রীষ্ম নাকি আবির্ভূত হয়েছে ১৯৮০র পরে। কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগীরণে লাগাম না-পরালে ২১০০ সালে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড সঞ্চিত হবে নাকি বার্ষিক ৩০ বিলিয়ন টন। তাপমাত্রাও ২-৭ ডিগ্রি বাড়বে। ১৯৮০ পরবর্তীতে ভূ-উষ্ণায়ন-জনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় আমেরিকাকে নাকি প্রতি সপ্তাহে খরচ করতে হচ্ছে ১ বিলিয়ন ডলার।
ভ্রান্ত অভিযোগের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর, বর্তমানের তুলনায় আমেরিকাকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ যদি ২০ শতাংশ কমাতে হয় তা হলে কার্বন ট্যাক্স বাবদ কয়লা-জাত বিদ্যুতের দাম এখনই দ্বি’গুণ, পেট্রোল/ডিজেলের দাম তিন গুণ ও কয়লার দাম চার গুণ বাড়াতে হবে। ক্লিনটন চেষ্টা করেছিলেন, ২০১৭ সালেও উদ্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। গ্রিনহাউস হিটিং এর বেশিটাই আসে জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও অন্য কিছু গ্যাস মারফত। গ্রিনহাউস এফেক্টের কারণেই পৃথিবীর মিন টেম্পারেচার সুমধুর ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, না হলে সুজলাং সুফলাং পৃথিবী মঙ্গলে পরিণত হত। তাপমাত্রা বিরাজ করত শূন্যের ১০ ডিগ্রি নীচে।
১৯৪০ থেকে ১৯৭০, সারা পৃথিবীতেই শিল্পায়নের বান ডেকেছিল। সেই ৩০ বছরেই সবচেয়ে বেশি কয়লা পুড়েছে। সর্বাদিক তাপবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়েছে, ফলে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশিছে। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এই ৩০ বছরে কেবলই কমেছে, বাড়েনি মোটেই। ১০০ বছরের উষ্ণায়নের ইতিহাসে এই ৩০ বছর ছিল ব্যতিক্রমী সুশীতল। সুতরাং, ভূ-উষ্ণায়নের জন্য কার্বন ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস দায়ী নয় মোটেই।
আইপিসিসি তার যাবতীয় ভবিষ্যদ্বাণীতে ব্যবহার করে জিসিএম বা জেনারেল সার্কুলেশন মডেল। জলবায়ু-বিশারদরা প্রথম থেকেই বলে আসছেন, কম্পিউটার-কৃত জিসিএম মডেলের কোনো নির্ভরযোগ্যতা নেই। কারণ সমুদ্র ও পরিবেশের কিছু আপাত-স্থ’ুল পরিসংখ্যানের গাণিতিক বিশ্লেষণ করে জিসিএম। ভূ-উষ্ণায়নে মেঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিসিএম এর পক্ষে মেঘ-চরিত্রের তল পাওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। আইপিসিসির গণনায় গত ১০০ বছরে নাকি বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে ১.২০ সেলসিয়াস, প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের তাপমাত্রা গত ১০০ বছরে বেড়েছে ০.৫০ সেলসিয়াস। তাও ১৯৪০-র আগে যখন গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রায় কোনো অস্তিত্বই ছিল না। ১৯৮০-তে, আইপিসিসি বলছে, বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে আধডিগ্রি। অথচ তাপমাত্রা পরিমাপে সবচেয়ে নির্ভুল, উপগ্রহের গণনায় ১৯৮০-তে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
জিসিএম বর্ণিত মনুষ্যকৃত গ্রিনহাউস এফেক্টের দরুন ভূ-উষ্ণায়নের অব্যর্থ কিছু চরিত্র-লক্ষণ আছে, যেমন-উত্তর গোলার্ধের তাপমাত্রা দক্ষিণের তুলনায় বেশি বাড়বে, উচ্চ অক্ষাংশ বা হায়ার ল্যাটিচুড নিম্ন অক্ষাংশের তুলনায় বেশি উত্তপ্ত হবে, উত্তর মেরুর উষ্ণতা দক্ষিণ মেরুর তুলনায় বাড়বে। কিন্তু দুই মেরু বা দুই অক্ষাংশের তাপমাত্রার চলনে কোনো ফারাক স্বয়ং জিসিএম করে উঠতে পারেনি কারণ তাপমাত্রার কোনো পরিবর্তন হয়নি। জিসিএম-এর পূর্বাভাস, সাহারা মরুভূমি ও স্কটল্যান্ডে সমপরিমাণ বৃষ্টির। অবিমিশ্র এই আহাম্মকির পর জিসিএম-র গণনা সম্পর্কে বাক্যব্যয় না-করাই শ্রেয়। ট্রাম্পের ভাষায় ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে অযথা শোরগোল সত্যিই মস্ত চালাকি।
কার্বন ট্যাক্স, কার্বন ক্রেডিট-আইল, ইফ ইয়ুল- এই গৎবাঁধা বুলি সর্বাগ্রে পরিত্যাজ্য। এই Differentiated reponsibilities ও শুধুই কথার কথা। কোপেনহেগেন আমেরিকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০০৫ এর তুলনায় ২০২০ তে তারা কার্বন ঘনত্ব ১৭-২০ শতাংশ কমাবে, চীন কমাবে ৪৪-৫০ শতাংশ আর ভারত ২০ শতাংশ। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের পর আমেরিকার অঙ্গীকার ২০২৫ এ তারা কার্বন দূষণ ২৫ শতাংশ কমাবে আর চীন বা ভারত ২০৩০ এর আগে কার্বন দূষণে কোনো রকম লাগাম টানতে পারবে না। কারণ চীন বা ভারত যে উন্নয়নের রথে সওয়ারি। কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না-জলবায়ু চুক্তির ট্র্যাজেডি এটাই। মিষ্টি কথায় কোনো দেশই কার্বন বা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে লাগাম পরাতে চাইবে না। সুতরাং জীবাশ্ম জ্বালানি যথা, পেট্রোল, ডিজেল, কয়লা, গ্যাসোলিন পোড়ালেই চড়া মাশুল/কর বাধ্যকতামূলক করতে হবে। চড়া মাশুলের অর্থ কার্বন ট্র্যাক্স। পেট্রোল-ডিজেল, কয়লা-গ্যাসোলিনের দাম বাড়ানো। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা, গণ ও বিকল্প পরিবহণে উৎসাহ প্রদান। তাপবিদ্যুৎ ব্যবহারে বেশি মাশুল ধার্য করা পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুতের তুলনায়।
কার্বন ক্রেডিটও দূষণ নিয়ন্ত্রণে ফলপ্রসূ নয়। স্টকহোম ইন্সটিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এমিশন ট্রেডিং স্কিমের আওতায় অনতি-অতীতে শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেনকে ২ বিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য করেছিল। শর্ত ছিল এইচএফসি-২৩ ও সালফার হ্যাক্সেফ্লোরাইডকে নির্দিষ্ট মাত্রায় কমাতে হবে। কার্যক্ষেত্রে হল ঠিক উলটোটা, এইচএফসি বা হ্যাক্সেফ্লোরাইড তো কমলই না, উপরন্তু ৬০০ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশল। রাশিয়া-ইউক্রেন ধরেই নিয়েছিল দূষণ যত বাড়বে তত মুফতে টাকা মিলবে। অর্থাৎ কার্বন ক্রেডিট রিভার্স সাবসিডির কাজ করল। চীন সরকারি হিসাবে ২০১২ সালে ৬০০ মিলিয়ন টন কয়লা পুড়িয়েছে, আমেরিকার কয়লা দহনের ৭০ শতাংশ বেশি। কার্বন ক্রেডিটের দোহাই দিয়ে জাতিসংঘকে শিখন্ডী করে ভারত বা চীনও ভিক্ষাপ্রার্থী গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের। ট্রাম্প পরবর্তী ১০ বছরে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের পরিবর্তে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমেরিকার পরিকাঠামো উন্নয়নে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন