সংসদও তার সংশোধনী ক্ষমতা প্রয়োগ করেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধন করতে পারে না
ইনকিলাব ডেস্ক : এই প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত ষোড়শ সংশোধনী পর্যন্ত বিচারিক ঘোষনা দিয়ে কিংবা সংবিধানের পরবর্তী সংশোধনী মাধ্যমে কখনই বিঘিœত করা হয় নি। ইতোমধ্যে খন্দকার দেলওয়ার হোসেন এবং গং বনাম বাংলাদেশ ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড এবং গং (২০১০ বিএলডি(বিশেষ)=৬২ ডিএলআর (এডি)২৯৮) মামলায় পঞ্চম সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এর ফলে সামরিক শাসকদের তৈরি আইনসহ তাদের সব আইন শীর্ষ আদালতে অবৈধ ঘোষনা করা হয়। তবে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার লক্ষ্যে সংসদকে সক্ষম করে তুলতে এবং উপরে বর্ণিত সময়ে জারি করা (অধ্যাদেশ) আইনে পরিণত করতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতিটি অক্ষুন্ন রেখে রাষ্ট্রের সর্বনাশা পরিস্থিতি এড়াতে এই বিধানকে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাময়িকভাবে শিথিল বা মওকুব (condoned) করা হয়। এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এই ডিভিশন মনে করেঃ “প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংবিধানে বিদ্যমান ৯৬ অনুচ্ছেদের বিধানাবলীতে বাংলাদেশের সপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে ‘অসদাচরণ কিংবা অসামর্থ্যতার’ অজুহাতে রাষ্ট্রপতি তাকে তার পদ থেকে অপসারণ করতে পারবেন। Second Proclamation (Tenth Amendment) Order, , ১৯৭৭ দ্বারা ৯৬ অনুচ্ছেদের (২), (৩), (৪), (৫), (৬) ও (৭) উপ-অনুচ্ছেদে প্রতিস্থাপিত ধারাসমূহে অপসারনের পূর্ববর্তী ব্যবস্থার পরিবর্তে সেখানে প্রদত্ত পদ্ধতিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারকের অপসারণ পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। এর আগের বিধান থেকে এই প্রতিস্থাপিত বিধান অধিকতর স্বচ্ছ হওয়ায় এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হওয়ায় একে কনডন করতে হবে।”
পঞ্চম সংশোধনী মামলার পর্যবেক্ষণ অনুসারে সংধিান সংশোধনের জন্য নবম সংসদ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তদানুযায়ী এর ওপর এক বছরের বেশী সময় ধরে সর্বস্তরের জনগণের আলাপ-আলোচনা চলে। এ প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট জুরি, রাজনীিিবদ, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর মতামত পাওয়া যায়। এর পর ২০১১ সালের ১৪ নং আইন হিসেবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। বেশ মজার ব্যাপার হলোঃ এই সংশোধনীতে উল্লেখিত অন্যান্য অনুচ্ছেদসহ সংসদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধন রহিত করে ৭খ অনুচ্ছেদ জুড়ে দেয়। এই সংশোধনীর ষষ্ঠ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদে ৯৪, ৯৫ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ অর্ন্ভুক্ত রয়েছে। এই ভাগের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদ জুড়ে দেয়া ছাড়া সচেতনভাবে অন্যগুলো অক্ষুন্ন রাখা হয়। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, যে সময় পর্যন্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি অস্থায়ীভাবে মওকুব করা হয়েছে সেই ৩১-১২-২০১২ তারিখের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পঞ্চম সংশোদনী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ সত্তে¡ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা অক্ষত রাখা হয়। এরপর সাড়ে তিন বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেছে। সংসদে বিতর্কিত ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়েছে। পরবর্তীতে, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়র নামে এবার সংবিধান ৭খ অনুচ্ছেদের অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়েছে এই সত্যকে উপেক্ষা করে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। অথচ অপ্রতিবন্ধকতার অনুবিধি (non-obstante clause) দিয়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় বলা হয়েছে, সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা সংসদের ওপর অর্পিত একটি গুরু দায়িত্ব। এই সংসদেই জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটান। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে নির্দেশিত পদ্ধতি অনুযায়ী এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্য কোন উপায়ে নয়, অন্য কোনভাবে এবং অন্য কারো দ্বার নয়। এটা এমনই হতে হবে। তবে সংসদের এরূপ ক্ষমতা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জুড়ে দেয়া ৭খ অনুচ্ছেদ দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ৭খ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ ‘৭খ।সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।’
মৌলিক কাঠামোর সুষ্পষ্ট সংজ্ঞা দেয়া না হলেও, বাস্তবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সুষ্পষ্টভাবে শনাক্তযোগ্য। আজ পর্যন্ত আমাদের এখতিয়ারে এবং অন্যান্য এখতিয়ারে বেশ কিছু বিচারিক ঘোষনায় বলা হয়েছে যে, (১) সার্বভৌমত্ব, (২) সংবিধানের আধিপত্য, (৩) গণতন্ত্র, (৪) গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার, (৫) ক্ষমতা পৃথকীকরণ, (৬) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, (৭) একক রাষ্ট্র, (৮) মৌলিক অধিকার এগুলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সংবিধানের সার্বভৌমত্ব ও আধিপত্য জনগণের ইচ্ছার চরম প্রকাশ। ক্ষমতার পৃথকীকরণ,বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রেও অবস্থান অনুরূপ। তাদের পরিচিতি সম্পর্কে কোন বিরোধ নেই। ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির অর্থ হচ্ছে, সার্বভৌম কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান যথা নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে ্এবং তাদের এখতিয়ার ও কর্তৃত্ব যথাক্রমে সংবিধানের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ ভাগে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। কোন অঙ্গ প্রতিষ্ঠা অন্যকোন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার/কর্তৃত্বে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। সংবিধানের কাঠামোগত স্তম্ভ রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গকে পৃথক ও স্বাধীন রাখার এবং তাদের মধ্যে সামাঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে সংবিধানে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সংশোধনীর মাধ্যমে এগুলো পরিবর্তন করা যায় না। সংবিধান কিছু মৌলিক নীতিমালার ওপর দাঁড়িয়ে আছে যেগুলো এর কাঠামোগত স্তম্ভ। এই স্তম্ভগুলো স্পর্শ করলে/ভেঙ্গে ফেললে/ ক্ষতিগ্রস্ত করলে সংবিধানরূপী গোটা অট্টালিকাটি ভেঙ্গে পড়বে। প্রকৃতপক্ষে সংবিধানিক ধারাসমূহ ব্যাখ্যা করে এই স্তম্ভগুলো শনাক্ত করতে হবে। এমন কি সংসদও তার সংশোধনী ক্ষমতা প্রয়োগ করেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো/স্তম্ভ সংশোধন করতে পারে না। এগুলো চারিত্রিকভাবে মৌলিক। পূর্ণ গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদাবোধ, আইনের শাসনও সংবিধানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য এই স্তম্ভগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে এবং প্রয়োজনীয় মর্যাদা ও কর্তৃত্বের সাথে কাজ
করতে এই সংবিধান প্রণয়নকারীরা তিনটি স্তম্ভকে বিশেষভাবে চিহ্নিত রাখার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে করে এদর প্রত্যেকটাই একান্তভাবে এবং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারে, যদিও তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে কিছু সুষ্পষ্ট নির্ধারিত কার্যক্রম রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন