আরাকান তথা রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমান সম্প্রদায় সমকালীন ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা ও দীর্ঘমেয়াদী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। এই মুহর্তে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে মুসলমানরা গৃহযুদ্ধ ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের সম্মুখীন। গত এক দশকে এসব দেশের অন্তত ৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের একটি অংশ প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগ করে এশিয়া, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মাইগ্রেট করেছে, যা’ বর্তমানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের সবচেয়ে বড় ইউরোপীয় মাইগ্রেশন ক্রাইসিস হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তবে কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদি হুমকি না থাকলেও ইতিহাসের পাকেচক্রে ও ভাগ্যক্রমে মিয়ানমারের অন্তর্গত রাখাইনের মুসলমানরা উদ্দেশ্যমূলক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বা এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হওয়ায় গত পাঁচ দশকে পালিয়ে প্রতিবেশি দেশগুলোতে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই আশ্রয় গ্রহণকারি রোহিঙ্গার সংখ্যা অন্তত ৫ লাখ। এদের বেশিরভাগই অনিবন্ধিত ও অচিহ্নিত। আরাকান এবং কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে যথেষ্ট মিল থাকায় এবং যে কোন বিপদে আপদে সংকীর্ণ নাফ নদী পেরিয়ে সহজে আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ থাকায় রোহিঙ্গা মুসলমানরা প্রাণ বাঁচাতে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বেছে নেয়, এটাই স্বাভাবিক। আরাকানের শাসক থেকে শুরু করে সাধারণ জনগন শত শত বছর ধরে এই ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। সে সব প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে মিয়ানমারের জান্তা শাসকরা আরাকানের মুসলমানদের বাংলাদেশী মুসলমান বলে আখ্যায়িত করে তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করতে গণহত্যা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পন্থা বেছে নিয়েছে। শত শত বছর ধরে আরাকানের শাসক এবং সাধারণ মানুষ বার্মিজদের দ্বারা বার বার নিগৃহিত ও বিতাড়িত হয়েছে। এর মধ্যে সবচে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে পঞ্চদশ শতকের শুরুতে আরাকানের রাজা নরমিখলা নিজের চাচাকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতা দখলের পর সিংহাসনচ্যুত রাজার আমন্ত্রনে বার্মার রাজা মেং শো আই ১৪০৬ সালে ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে আকষ্মিক আরাকান আক্রমন করলে নরমিখলা প্রান ভয়ে গৌড় বাংলায় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের আশ্রয় গ্রহন করেন। প্রায় ২৪ বছর বাংলার সুলতানের আশ্রয়ে থাকার সময় নরমিখলা ইসলামের শিক্ষা ও সুমহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে আকৃষ্ট হন। ১৪৩০ সালে নরমিখলা বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ্’র প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আরাকান পুনরুদ্ধার করেন। সে সময় নরমিখলার সাথে থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত ছিল। কথিত আছে, গৌড়ে এসে নরমিখলা একজন সূফী কামিল সাধক হজরত মুহাম্মদ জাকির রহমতুল্লাহির দরবারে প্রথম আশ্রয় গ্রহন করেন। বাংলার সুলতানের সহায়তায় আরকানের শাসনক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেখানে কার্যত বাংলার সুলতানদের প্রভাবিত ও প্রবর্তিত শাসন পদ্ধতি, বিচারব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, মূদ্রা ব্যবস্থা, রাজাভিষেক ও অনুরূপ শাসন পদ্ধতি চালু হয়। এমনকি নরমিখলা স্বয়ং বাংলার সুলতানদের মত মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ উপাধি গ্রহন করেছিলেন। তবে নরমিখলার প্রবর্তিত আড়াইশ বছরের ব্রাউক উ রাজবংশ আরাকানের ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে। তার আমাত্যবর্গের বেশীরভাগই ছিল মুসলমান। সে সময়ের রাজদরবার ও আমাত্য দরবারে বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য ও কৃষ্টির পরিপোষন ও প্রচলন করেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আদি বির্বতনের সাথে রোসাঙ্গ রাজ দরবারের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে। মধ্যযুগের কবি দৌলত কাজী তাঁর ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্যে ভারতীয় লোকাচার এবং পারস্যের ইসলামি ঐতিহ্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। সেখানকার রাজ দরবারেই বিকশিত হয়েছিল কবি আলাওলের সাহিত্য প্রতিভা। বাংলার সুলতানদের অনুকরণে আরকানে রাজভাষা ফারসি হওয়ায় সেখানে ফারসি শিল্প সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন মুসলমান আমাত্যরা। সেখানকার পরিচর্যায় আলাওল হয়ে ওঠেন বহুভাষাবিদ, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারি। হিন্দী কবি মালিক মুহাম্মদ জায়সির পদুমাবত কাব্যকে পদ্মাবতী নাম দিয়ে বাংলায় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য রসের ভান্ডারকে সুমৃদ্ধ করেছিলেন। আরাকানের রাজ আমাত্য মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় আলাওল রচিত সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আদি প্রণয়োপাখ্যান। এছাড়া সপ্তপয়কর, তোহফা, সিকান্দারনামার মত রচনা আলাওলকে মহাকবির মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছিল। মধ্যযুগের আরো বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক আরাকান রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যকে সুসমৃদ্ধ করেছেন।
আরকানের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে কখনোই বার্মিজদের প্রভাব কার্যকর ছিলনা। মূলত: আরাকানের বিগত সাড়ে চার হাজার বছরের ইতিহাসের প্রায় পুরোটাই নিরবিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীন ইতিহাস-ঐতিহ্যে সুসমৃদ্ধ ছিল। আর বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং আরাকান ছিল অবিচ্ছিন্ন ভূ রাজনৈতিক সত্তা। বাংলায় ও আরাকানে ইসলাম ধর্মের প্রসারের ইতিহাসও প্রায় অভিন্ন প্রথমত:খৃষ্টীয় সপ্তম অষ্টম শতকে যখন আরবীয় বণিক ও সূফি সাধকরা সমুদ্রপথে বাংলাদেশে দক্ষিনের সমুদ্রোপকুলীয় অঞ্চলে অবতরণ করেছিলেন। তবে আরাকানে আরব মুসলমানদের আগমনের জন্য তাদের পূর্বাঞ্চলীয় নৌবাণিজ্য পোত এবং জাহাজডুবির পর আশ্রয় নেয়ার ঘটনাকে বিশেষভাবে প্রনিধান করা হয়। আরকানের বিভিন্ন প্রান্তে সে সময় নির্মিত মসজিদের পুরাকৃত্বি ও ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা আরাকানের মুসলিম ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের প্রামাণ্য দলিলের অংশ হয়ে আছে। শুধু আরকানেই নয় পুরো মিয়ানমারেই এমন অসংখ্য প্রাচীন মুসলিম পুরাকৃত্বির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও বিশাল আরাকান পবর্ত দ্বারা আরাকান রাজ্য বার্মার অপরাপর অংশ থেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন ছিল এবং আছে। বার্মার সাথে আরাকানের এই ভূ-প্রাকৃতিক বিচ্ছিন্নতা এবং বাংলার সাথে ভূ-রাজনৈতিক সাজুয্যই আজকের রাখাইন সম্প্রদায়ের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শত শত বছরের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহনের পরও তাদেরকে আরাকানে বহিরাগত বা বাংলাদেশি মুসলমান হিসেবে গণ্য করে বিতাড়নের ভূ টকৌশল গ্রহন করেছে। আরাকানিজদের এই ভাগ্য বিড়ম্বনার প্রথম ভিত্তি তৈরী করেছিল বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা। তারা একটি জনসংখ্যা জরিপে আরাকানের মুসলমানদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবেই তালিকার বাইরে রেখেছিল বলে অভিযোগ আছে। একসময় বৃটিশ বার্মার অন্তর্গত আরাকানকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মার অন্তর্গত করার কোন যুক্তিই ছিলনা। ভূ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে আরকানকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের সাথে একীভ‚ত করাই ছিল ইতিহাসের দাবী। বৃটিশদের বাংলা ভাগ, পাঞ্জাব ভাগ,ডুরান্ট লাইন বা ম্যাকমোহন লাইনের মত আরকানকে বার্মার অঙ্গিভ‚ত করাও একটি বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক সংঙ্ঘাতের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। অবশ্য ভাগ-বাটোয়ারার প্রেক্ষাপট বাদ দিলে আরকানের বর্তমান অবস্থার জন্য দায় একপাক্ষিকভাবে মিয়ানমার শাসকদের। তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই আরাকানকে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতামুক্ত করতে চায়। এ কারণেই তারা প্রথমেই আরাকানের ঐতিহাসিক নাম পল্টে ‘রাখাইন’ করেছে। এর রাজধানী আকিয়াবকে করেছে ‘সিত্তে’ বা সিটওয়ে। সভ্যতা সংস্কৃতির সব দাবী উপেক্ষা করে মিয়ানমারের সব ধরনের নাগরিকত্বের স্বীকৃতির তালিকা থেকে রোহিঙ্গা মুসলদের বাদ দেয়ার চেষ্টা কার্যকর করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূল করার সব ধরনের আয়োজন সম্পন্ন করছে সভ্য দুনিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে। পশ্চিমা দুনিয়া বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সবক দিয়ে বেড়ালেও রাখাইনে মুসলমানদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তাদের নিরবতা বিষ্ময়কর। রাখাইনের দরিদ্র মুসলমানদের উপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পৈশাচিক নির্মমতার সাথে তুলনীয় কোন নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে শুধুমাত্র ইহুদি জায়নবাদিদের হাতে ফিলিস্তিনীদের হত্যা, বিতাড়ন ও ইহুদি বসতি স্থাপনের ঘটনাবলীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমার বর্ডারে সন্ত্রাসী হামলা কথিত হতাহতের ঘটনার পর রাখাইনে যে তান্ডবলীলা চালানো হয়েছিল। তাতে হাজার হাজার নিরস্ত্র যুবককে গুলি, নির্যাতন, জবাই ও পুরিয়ে মারা হয়েছে। শত শত নারীকে ধর্ষণ করার পর পৈশাচিক নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে। দুধের শিশুকে মায়ের সামনে, এমনকি বুকে শুইয়ে জবাই করার দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে। একসাথে অনেক রাখাইন নারী-পুরুষকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করার পর আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারার নারকীয় দৃশ্যের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতন কখনো বন্ধ হয়নি মাঝে মধ্যে মাত্রাভেদ ঘটেছে মাত্র।
গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুরু হওয়া আরাকানের মুসলমানদের উপর বার্মিজ শাসকদের নির্যাতন ও জাতিগত নির্মূল অভিযানের আগে এই জনগোষ্ঠির উপর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক তথ্যবহুল গ্রন্থের সংখ্যা খুবই কম। ষাটের দশকের শুরুতে বার্মায় নিযুক্ত ইসরাইলী ক‚টনীতিক রেঙ্গুনে ইসরাইল অ্যাম্বাসির সেকেন্ড সে্েক্রটারী মোশে ইয়েগার বার্মায় মুসলিম জনগোষ্ঠির অবস্থান ও ঐতিহাসিক বিবর্তন নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ‘মুসলিমস ইন বার্মা’ শিরোনামে তার তথ্যবহুল লেখাটিকে জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের মাস্টার্স ডিগ্রীর অভিসন্দর্ভ হিসেবে দিয়েছিলেন মোশে ইয়েগার। আরাকানের পেগু,ইরাবাদি, তেনাসেরিম নদীতীরবর্তি ব-দ্বীপ অঞ্চলে আরব মুসলমানদের প্রথম আগম থেকে শুরু করে খৃষ্টীয়একাদশ শতক থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বার্মিজ মুসলমানদের ধারাবাহিক ইতিহাস ইয়েগারের রচনায় স্থান পেলেও সেখানে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। তবে বৃটিশদের মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকার ধারাবাহিকতায় পঞ্চাশের দশকে বার্মিজ সেনা শাসকরা আরাকানের মুসলমানদের টার্গেট করেই এখানকার সব প্রশাসনিক নীতি-কৌশল গ্রহন করেছিল। এর সর্বশেষ নমুনা হচ্ছে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব সম্পর্কিত কালো আইন। সেখানে ১৩৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির মধ্যে রাখাইন মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রায় ৫ দশক ধরে মিয়ানমারে গণতন্ত্র বা আইনের শাসন ছিলনা। সকলের প্রত্যাশা ছিল সেখানে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও মানবাধিকার ফিরে পাবে। দীর্ঘদিন অন্তরীণ থাকার পর মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেতা অং সান সুচি’ র মুক্তি লাভ এবং ভোটযুদ্ধে বিজয় লাভের পর স্বাভাবিকভাবে সেখানকার মানবাধিকার বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের সমস্যার সমাধানের প্রত্যাশা করা হয়েছি। অং সান সুচির দল ক্ষমতায় যাওয়ার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের নবযাত্রা সূচিত হলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় আরো ভয়াল রূপ লাভ করেছে। আরাকানের মুসলমানদের ঐতিহাসিক বিবর্তন সম্পর্কে বাংলায় লেখা পরিপূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থের সংখ্যা খুব নগন্য। এ ক্ষেত্রে ২০১৩ সালে প্রকাশিত ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দের লেখা ‘আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস’ গ্রন্থটি খুব বেশী বিস্তৃত না হলেও অনেক তথ্যপঞ্জির সমাবেশে বেশ সমৃদ্ধ। এই গ্রন্থের ভ‚মিকা ও উপক্রমণিকা থেকেই মোশে ইয়েগার, ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূসের লেখা এ বিষয়ক ইংরেজি গ্রন্থের পাশাপাশি উর্দূ ভাষায় লেখা কয়েকটি সমৃদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থের কথা জানা যায়। বিশেষত: মুহাম্মদ তাহের জামাল নদভীর লেখা ‘সারজামিন আরাকান কি তাহরিকে আজাদী:তারিখি পাস মানজার মে’ নামের ৪৪৩ পৃষ্ঠার গ্রন্থে আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস থেকে বর্মি ও বৃটিশদের আরাকান দখল, ১৯৪২ সালের গণহত্যা, এবং জেনারেল নে উইনের শাসন এবং মুসলমানদের স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। তবে আরাকানের আজকের বাস্তবতার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় মুহম্মদ খলিলুর রহমানের লেখা ‘কারবালা ই আরকান’ নামের মধ্যে। মিয়ানমারের শাসকরা রাখাইন স্টেটকে এখানকার মুসলমানদের জন্য কারবালায় পরিনত করেছে।
বিংশ শতকের শুরুতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহার তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন,
‘কতেø হোসাইন আসলে মে মর্গে এজিদ থা
ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ’।
এখানে কবি বোঝাতে চেয়েছেন, হযরত ইমাম হোসাইনের(রা.) শাহাদাতের মাঝে আসলে এজিদের অপমৃত্যুই নিহিত ছিল: কেননা প্রতিটি কারবালার পরেই ইসলাম পুর্নজীবন লাভ করে।
বার্মায় শতাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির অস্তিত্ব ও নাগরিকত্বের স্বীকৃতি থাকলেও হাজার বছরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সত্বেও আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি অগ্রাহ্য হওয়ার পেছনে বিশ্ব রাজনীতির ইসলাম বিদ্বেষী অনুঘটকেরা নেপথ্যে কাজ করছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বর্তমানের তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনেও লাখ লাখ রাখাইনকে বাস্তুচ্যুত করা এবং হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পরও বিশ্বসম্প্রদায়ের নিরবতায় এই সন্দেহ সৃষ্টি করে। যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের গৃহযুদ্ধে লাখ লাখ শরনার্থীর চাপ ইউরোপে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাইগ্রেন্ট ক্রাইসিস হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের মত দরিদ্র ও জনসংখ্যাবহুল দেশের উপর লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীর বোঝা চাপলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা খুবই অপ্রতুল। জাতিসংঘ, ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে মিয়ানমারের প্রতি সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করছেনা। গত বছর অক্টোবর শুরু হওয়া রোহিঙ্গা গণহত্যা ও উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে ক্যাথোলিক খৃষ্টানদের পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে আরাকানে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর নতুন দমনাভিযান ও মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে এ সপ্তাহে পোপ আবারো বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারসহ রাখাইনে পুর্নবাসনের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকার কারো কোন আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ইতিহাসের ঘৃন্যতম গণহত্যায় মেতে উঠেছে। দীর্ঘদিন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, দক্ষিন এশিয়ার দরিদ্র একটি দেশের সরকারী বাহিনী দেশের একটি মুসলিম সম্প্রদায়কে নির্মূল করলেও বিশ্ব সম্প্রদায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ক‚টনৈতিক, অর্থনৈতিক চাপ বা নিষেধাজ্ঞা জারির মত কোন পদক্ষেপই নিচ্ছেনা। অথচ এর চেয়ে অনেক লঘু অপরাধের সন্দেহে বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশ ও সংস্থার বিরুদ্ধে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ করছে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমাবিশ্ব। বিশ্ব বিবেকের এই নিরবতা নিস্ক্রিয়তায় আরাকানের মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। ছয়শ বছর আগে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ বার্মিজদের হাতে আরাকানের ক্ষমতাচ্যুত শাসক নরমিখলাকে সৈন্য সামন্ত দিয়ে সহযোগিতা করে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। বার্মিজদের নৃসংশতায় আজ ৬শ বছর পর আরাকানের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন, হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক সর্বস্ব ফেলে, কেউ বুকে-পিঠে গুলি ও নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে আহত অবস্থায় বেঁচে থাকার সর্বশেষ আশ্রয় হিসেবে বাংলাদেশ সীমান্তে ভীড় জমাচ্ছে। পুশব্যাক করে তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া কোন যুক্তিতেই গ্রহনযোগ্য নয়। অভিন্ন ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অংশিদার হিসেবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশের অনেক কিছুই করনীয় আছে। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীর বোঝা বহন করছে। অন্যদিকে বার্মিজরা বলছে এরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, এরা ‘বাংলাদেশি সন্ত্রাসী’। এখন বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে যে আরাকান সাড়ে চার হাজার বছর ধরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে ছিল। অষ্টাদশ শতকে আরাকানে কিছু সামন্তের বিশ্বাসঘাতকতায় বার্মিজ রাজা বোধপয়া আরকান দখলের ধারাবাহিকতায় বৃটিশরা আরাকানকে বার্মার সাথে সংযুক্ত করলেও বার্মিজরা তাদেরকে মেনে নিতে না পারার ব্যর্থতার দায় তাদেরকেই বহন করতে হবে। বার্মিজরা যখন রাজনৈতিক ও মানবিক উদ্যোগের বদলে রোহিঙ্গা সমস্যায় সামরিক সমাধানের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তখন বিশ্বসম্প্রদায় এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কর্তব্য হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে মিয়ানরমারকে বাধ্য করা। আন্তর্জাতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা অথবা রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি সব ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থন ঘোষনা করা। রাখাইনে মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়নের মাধ্যমে সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিনত করার দূরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দিতে রাখাইনের মুসলমানরা স্বাধীনতার জন্য এখন অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মিয়ানমার বাহিনী রাখাইনদের উপর যত বেশি নির্মম শক্তি প্রয়োগের পথ গ্রহন বরছে রাখাইনের মুসলমানরা স্বাধীনতার জন্য ততই মরিয়া হয়ে উঠছে। রাখাইনের মুসলমানরা এখন মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়নে ক্রমে কঠিন শপথে দৃপ্ত হচ্ছে। পাঁচ দশকের বেশী সময় ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের হাতে অনবরত মার খাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা মুসলমানরা। গতবছরের গণহত্যার পর এবার সশস্ত্র রোহিঙ্গা প্রতিরোধযোদ্ধারা পাল্টা আঘাত দিতে শুরু করেছে। তাদের এই প্রতিরোধ লড়াইয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহন ক্রমে বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের নির্মূল অভিযানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি নিজেদেরকে মুক্তিকামি বলে দাবী করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তা চায়। এ দাবীর সাথে সব আঞ্চলিক শক্তি, জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়েরও সমর্থন আছে। মিয়ানমার এ দাবী মানতে না চাইলে আরাকানের স্বাধীনতার দাবী প্রবল আকারে উঠে আসতে পারে। পূর্বমুখী নীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তার নিকটতম প্রতিবেশিদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। তবে মিয়ানমারের অন্যায় দাবী ও রোহিঙ্গা নির্মূলের সামরিক তৎপরতার সাথে আপস করে তা কখনো সম্ভব নয়।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন