আরবী ‘উযাহী’ শব্দটি হলো বহুবচন। এর এক বচন হলো ‘উসহিয়্যাতুন’। বৈয়াকরণিক আসমায়ী বলেছেন : এই শব্দটির চারিটি রূপ হতে পারে। (১) ‘উযহিয়্যাতুন’ এবং ইসহিয়্যাতুন’। (২) ‘উযহিয়াতুন’ এবং ইযহিয়াতুন’ এর বহুবচন হলো ‘উযাহী’ (৩) যাহইয়াতুন এর বহুবচন ‘যাহায়া’ (৪) ‘আযহাতুন’। এর বহু বচন ‘আযহা’।
এ সব কয়টি রূপের অর্থ হলো ‘সূর্যের ওপরে ওঠা’। অর্থাৎ সূর্যোদয়ের পর পূর্ব দিগন্তে সূর্যের ওপরে ওঠা। যেহেতু ১০ই যিলহজ তারিখে কুরবানির জন্তু জবেহ করার কাজ সকালে ঈদের নামাজ পড়ার পর এবং সূর্যের রেশ অনেকটা ওপরে ওঠার পর করা হয়, এ জন্য এ সময়ের সম্পর্কের কারণে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘ঈদুল আযহা’। রাসূলুল্লাহ (সা:) এই দিনের কুরবানির উৎসবকে ঈদুল আযহা বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঈদুল আযহার মূলে রয়েছে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। যে ইতিহাস জুড়ে রয়েছে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর আল্লাহ প্রেম এবং হযরত ঈসমাইল (আ:)-এর আত্মত্যাগের অভূতপূর্ব নিদর্শনাবলি। আসুন, এবার সে দিকে লক্ষ করা যাক।
হযরত ঈসমাইল (আ:) যখন পিতার সাথে চলাফেরার করার মতো বয়সে উপনীত হলেন, তখন হযরত ঈসমাইল (আ:)-এর বয়স নয় বছর, মতান্তরে বারো বছর, (তাফসিরে কুরতুবী সূরা আস-সাফ্ফাত ১০২ নং আয়াতের ব্যাখা) হযরত ইব্রাহীম (আ:) তখন অধিকাংশ সময় মক্কায় অবস্থান করতেন এবং মাঝে মাঝে সিরিয়ায় তার সাবেক বাসস্থানে যেতেন। জিলহজ মাসের ৮ তারিখ রাতে তিনি হযরত হাজেরার গৃহে শায়িত ছিলেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে আদেশ করেছেন, হে ইব্রাহীম! তুমি আমার নামে কুরবানি করো।
নবী ও রাসূলের স্বপ্ন অবশ্য আমাদের সাধারণ লোকের স্বপ্নের মতো নয়, তাদের স্বপ্ন আল্লাহ তায়ালার প্রত্যক্ষ আদেশ বা ওহী। কাজেই হযরত ইব্রাহীম (আ:) সকালে উঠেই আল্লাহর আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে একশ’ উট কুরবানি করলেন। দ্বিতীয় রাতে তিনি আবার স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে আদেশ করেছেন, হে ইব্রাহীম! তুমি আমার নামে কুরবানি করো। প্রাতঃকালে উঠে তিনি আরো একশ’ উট কুরবানি করে তার গোশত হাজার হাজার লোকের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। তৃতীয় রাতে পুনরায় স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে বলছেন, হে ইব্রাহীম! দুনিয়ার মধ্যে তোমার কাছে যা সবচেয়ে অধিক প্রিয় তা-ই আমার নামে কুরবানি করো। এবার তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, আমার সবচেয়ে অধিক প্রিয় কি? অনেক চিন্তার পর তার মনে হলো দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় তো আমার একমাত্র পুত্র ঈসমাইল। তবে কি আল্লাহ তাকে কুরবানি করতে আদেশ করেছেন আমাকে? তা-ই। বেশ, তাই করব আমি। ঈসমাইল দুনিয়ার সব বস্তুর চেয়ে আমার নিকট অধিক প্রিয় বটে, কিন্তু আল্লাহর চেয়ে অধিক প্রিয় নয়। আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য অকাতরে পুত্রের মমতা ত্যাগ করব তবুও আমার প্রতিপালক যেন আমার প্রতি সন্তুষ্ট হন। হে আমার প্রতিপালক আল্লাহ! আমার একমাত্র পুত্রকে তোমার নামে কুরবানি দিতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নেই, কিন্তু দুঃখ হচ্ছে আমার মনে এই ভেবে যে, মাত্র একটি ছেলেকে তোমার নামে কুরবানি দিতে হচ্ছে।
আজ যদি আমার একশত ছেলে থাকত, তবে একশত ছেলেকেই আমি তোমার নামে কুরবানি দিতাম। তিনি প্রস্তুত হলেন, পুত্র ঈসমাইলকে নিয়ে মিনা ময়দানের দিকে যাওয়ার জন্য। ঈসমাইলকে তিনি এ কথা জানালেন না তখন। তিনি মনে করলেন, ছেলে মানুষ, হয়তো এ কথা শুনলে ভয় পেয়ে আমার সাথে যেতেই চাবে না। যথাসময়ে বললেই চলবে। তিনি তার স্ত্রী হাজেরাকে বলতে চাইলেন কথাটা, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো এমনিতেই তো স্ত্রীলোকের অন্তর কুসুমসম কোমল, তদুপরি তার একমাত্র পুত্র ঈসমাইল, তাকে কুরবানি করার কথা শুনলে সে সম্মতি দেয়া তো দূরের কথা, হয়তো চিৎকারে, বুক চাপড়ে, মাথার চুল ছিঁড়ে উন্মাদিনী হয়ে যাবে। এখন কিছু বলার দরকার নেই, পরে একটু ভালো করে বুঝিয়ে সান্ত¦না দিলেই চলবে। তিনি স্ত্রীকে বললেন, হাজেরা! আমি ঈসমাইলকে সাথে নিয়ে এক স্থানে যাব, তুমি তাকে গোসল করিয়ে উত্তম পোশাক পরিয়ে দাও। হযরত হাজেরা পুত্রকে গোসল করিয়ে উত্তম পোশাকে সাজিয়ে দিলেন। পিতা-পুত্র একত্রে রওনা হলেন। পিতা আগে আগে আর পুত্র চলছেন পিছে পিছে।
মানবের চিরশত্রæ ইবলিশ-শয়তান! আল-কোরআনে সূরা বাকারার ১৬৮ নং আয়াতে উল্লেখ আছে, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করিও না, সে তোমাদের পরম শত্রæ। সে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর পুত্র কুরবানি করার উদ্যোগ দেখে জ্বলেপুড়ে মরতে লাগল। ভাবল, সে তার একমাত্র পুত্রকে আল্লাহর নামে কুরবানি করে আরো অধিক প্রিয়পাত্র হবে। একবার তো নমরূদের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খলিলুল্লাহ উপাধি লাভ করেছে, সেবারে আমি অনেক কারসাজি করেও তার কিছু করতে পারিনি, এবারেও কি আমি চুপ করে বসে থেকে তাকে আল্লাহর আরও অধিক প্রিয় পাত্র হওয়ার সুযোগ দেবো। তা হয় না, যে করে হোক তার এ উদ্যোগ পÐ করে দিতেই হবে। এ সময় আমার চুপ করে বসে থেকে তামাশা দেখলে চলবে না। নমরূদকে পরামর্শ দিয়ে হযরত ইব্রাহীমকে আমিই অগ্নিতে নিক্ষেম করিয়েছিলাম। আশা ছিল অগ্নিকুÐে নিক্ষেপের ভয়ে সে ভীত হবে, তার ঈমান লুণ্ঠন করতে পারব, কিন্তু আমার এত চেষ্টা সবই ব্যর্থ হয়ে গেছে, এবারে আবার আর এক বিপদ! ইব্রাহীমকে সোজাসুজি নিষেধ করলে তো সে কিছুতেই শুনবে না আমার কথা, আবার কোনোরূপ কায়দা কৌশল করে ধোঁকাবাজি করেও ভুলানো যাবে না তাকে। কারণ এক দিকে সে ভয়ানক চালাক, সহজেই ধরে ফেলবে আমার ধোঁকাবাজি। অপর দিকে সে আল্লাহর যা ভক্ত, তাতে যুক্তি পরামর্শ দিয়েও এ কাজ থেকে বিরত করা যাবে না তাকে। তবে একটা কাজ করলে হয়তো উদ্দেশ্য সফল হতে পারে, বিবি হাজেরার কাছে গিয়ে তাকে সব কথা বলে দিয়ে তার দ্বারা যদি ঈসমাইলকে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা করে দেখা যাক। স্ত্রীলোক তো, তাকে ভুলানো ও উত্তেজিত করা অনেকটা সহজ হবে। হ্যাঁ, ঠিক এই পথ ধরেই কাজ হাসিল করতে হবে। মানব জাতির আদি পিতা আদমকেও তো ভোলাতে না পেরে শেষে হাওয়ার সাহায্যে কাজ উদ্ধার করেছিলাম। পাপাত্মা শয়তান বিলম্ব না করে একজন সাধু পুরুষের বেশে হযরত হাজেরার কাছে গিয়ে বলল, বিবি হাজেরা! তুমি একটা বোকা মেয়ে! তোমার যে স্বামী শিশুপুত্রসহ তোমাকে এই জনমানবহীন মরু প্রান্তরে নির্বাসন দিয়েছিল।
বিশাল ময়দান, কোথাও একটা বাড়ি-ঘর নেই, একটা জনমানবের সাড়াশব্দ নেই, একটা গাছগাছালি নেই। এই ময়দানে এসে দাঁড়িয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ:) হযরত ঈসমাইল (আ:)-কে বললেন, বৎস ঈসমাইল, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে তার নামে কুরবানি করতে বলেছেন। এ বিষয়ে তোমার মতামত কী? হে পুত্র পারবে কি নিজেকে তার নামে উৎসর্গ করতে?
ধৈর্যের জ্বলন্ত প্রতীক, আল্লাহর প্রিয় দোস্ত, মুসলিম জাতির গৌরব হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর সুযোগ্য পুত্র হযরত ঈসমাইল (আ:) পিতার কথা শুনে নির্ভীকচিত্তে বরং অত্যন্ত আনন্দের সাথে উত্তর করলেন : (ইয়া আবাতিফ আল মা তু’মারু ছাতাজিদুনী ইনশা আল্লাহ মিনাছ ছাবিরীন) অর্থাৎ হে পিতা! আপনি যে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তা কার্যে পরিণত করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্গত দেখতে পাবেন, অর্থাৎ পারব ধৈর্য ধরতে। (সূরা আস-সাফ্ফাত ১০২ নম্বর আয়াত)। ওহো! আজ আমার কী শুভ দিন! আর আমি কি ভাগ্যবান আমার পরম সৌভাগ্য যে সারা দুনিয়ায় এত মানুষের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা আমাকেই তাঁর নামে কোরবানির জন্য পছন্দ করেছেন। আব্বাজান! আপনি বিলম্ব করবেন না, সত্বরই আপনি আল্লাহর আদেশ পালন করুন। আব্বাজান! আপনিও কি কম ভাগ্যবান আজ আপনি আপনার একমাত্র নয়নের মণি, ¯েœহের দুলাল পুত্রকে আল্লাহর নামে কোরবানি করে দুনিয়ার অক্ষয়কীর্তি স্থাপন করবেন, যা দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে আর সহ¯্র কণ্ঠে আপনার প্রশংসা করবে।
আব্বাজান! আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি নিশ্চয়ই সবুর অবলম্ব করব। আপনি আপনার কর্তব্য পালন করুন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) পুত্রের কথা শুনে নিশ্চিন্ত ও খুশি হলেন। বালক পুত্রের ঈমানের বল ও খোদাপ্রেম দেখে তিনি যারপরনাই আনন্দিত হলেন। এমন পুত্রের পিতা হতে পেরেছিন বলে তিনি নিজেকে অত্যন্ত গৌরবান্বিত মনে করলেন। তিনি স¯েœহে পুত্রকে বুকের সাথে জড়িয়ে তার মুখ চুম্বন করতে লাগলেন। আনন্দে তাঁর দু’চোখ বেয়ে দর দর ধারায় অশ্রæ গড়িয়ে পড়তে লাগল। হযরত ঈসমাইল (আ:) পিতার চোখে পানি দেখে বললেন- আব্বাজান! আপনার চোখে পানি আসছে আপনার মন দুর্বল হয়ে আসছে, আর বিলম্ব করবেন না সত্বর কাজ সেরে ফেলুন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) চোখের পানি মুছে বললেন না বাবা! চোখে পানি এলেও আমার মনে কোনো দুর্বলতা আসেনি। কেন দুর্বলতা আসবে? তুমি তো আল্লাহরই দান, আল্লাহরই আদেশে তাঁর কাছে তোমাকে পাঠিয়ে দেবো, এতে দুঃখ করার কী আছে বাবা! দুদিন আগে আর পরে সবাইকেই তো তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে। এর মধ্যে আমরা পিতা-পুত্র উভয়েই যদি আল্লাহর আদেশ পালন করে তাকে সন্তুষ্ট করতে পারি, তবে তার মতো আনন্দের আর কী আছে! তিনি ¯েœহের আতিশয্যে আবার পুত্রের মাথায় হাত বুলালেন। আবার তিনি তার কচি মুখে চুম্বন করলেন।
অতঃপর তিনি পুত্রকে জবেহ করার উদ্যোগ নিলে ঈসমাইল (আ:) বললেন, আমার একটি আরজ আছে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) জিজ্ঞাসা করলেনÑ বলো বাবা, কি তোমার আরজ! হযরত ঈসমাইল (আ:) বললেন প্রথমত, আমাকে জবেহ করার আগে আমার হাত-পা উত্তমরূপে বেঁধে নিন। কারণ জবেহ করার সময় আমার অনিচ্ছা সত্তে¡ও হয়তো আমি পশু-পাখির মতো হাত-পা নড়াচড়া করব, তাতে হয়তো আমার পা আপনার শরীরে রক্ত লেগে যেতে পারে, অথবা আমার রক্ত লেগে আপনার জামা-কাপড় খারাপ হয়ে যেতে পারে, তাতে আমি গুনাহগার হবো। দ্বিতীয়ত, আমাকে জবেহ করার সময় আপনার চোখ বস্ত্রের দ্বারা বেঁধে নেবেন। কারণ জবেহ করার সময় আমার প্রতি নজর পড়লে আপনার প্রাণে ¯েœহের উদ্রেগ হতে পারে। তৃতীয়ত, আমাকে মাটিতে উপুড় করে শয়ন করিয়ে নেবেন, যাতে আমার মুখের প্রতি আপনার দৃষ্টি পতিত না হয়। চতুর্থত, আমার রক্তমাখা জামাকাপড়গুলো আপনি খুলে নিয়ে আমার আম্মাকে দেবেন, কারণ আমিই তার একমাত্র সন্তান, আমি বিশ্বাস করি যে তিনি আল্লাহর আদেশ জানতে পারলে এ ব্যাপারে কিছুমাত্র দুঃখিত হবেন না। তথাপি যখনই আমার কথা তার মনে পড়বে, তখন আমার জামাকাপড়গুলো দেখে মনকে সান্ত¦না প্রদান করবেন।
হযরত ইব্রাহীম (আ:) পুত্রের কথায় বিস্মিত হয়ে পুত্রের হাত-পা বেঁধে নিলেন তৎপর নিজের চোখ দু’টি বস্ত্রের দ্বারা উত্তমরূপে বেঁধে পুত্রকে মাটিতে উপুড় করে শয়ন করিয়ে ছুরি হাতে নিয়ে বললেন : (ইন্না ছালাতি ওয়া নুছুকি ওয়া মাহ্ ইয়াইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাছ ছামিউল আলীম) প্রভু হে! আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছু আপনার উদ্দেশ্যে। হে প্রভু! আপনি সব কিছুই জানেন ও সব কিছুই শুনেন (সূরা আনআম-১৬২)। দোয়া পাঠ করে তিনি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে উদ্যত হলেন। আকাশে উড়ন্ত পাখিকুল, বনের যাবতীয় পশু হায় হায় করতে করতে চারদিকে ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিলো, পবনের গতি স্তব্ধ হয়ে গেল। আল্লাহর আরশ থর থর করে কাঁপতে লাগল। ফেরেশতাগণ ক্রন্দন করতে করতে আল্লাহ তায়ালার আরশের নিচে সমবেত হয়ে আবেদন জানালো, হে পরওয়ারদিগারে আলম! হযরত ইব্রাহীমকে তুমি একবার নমরূদের ভীষণ অগ্নিকুÐে নিক্ষেপ করেছিলে, তিনি সে কঠোর পরীক্ষায় অত্যন্ত সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তুমিই তাকে উপাধি প্রদান করেছ খলিলুল্লাহ। অথচ তোমার খলিলের এই বৃদ্ধ বয়সে তার ওপর তুমি আবার এ কি নির্মম পরীক্ষা শুরু করে দিলে? প্রভু হে! আমাদের বিশেষ বিনীত আরজ, তুমি তাকে এ কঠোর পরীক্ষা থেকে মুক্তি দাও। হযরত ইব্রাহীম ব্যতীত সারা দুনিয়ায় তোমার অন্য কোনো অকৃত্রিম বন্ধু নেই, আর তুমিই তার একমাত্র বন্ধু ও প্রভু। আল্লাহ তায়ালা বললেন : হে ফেরেশতাগণ! এর মর্ম তোমরা বুঝবে না স্থির হয়ে তোমরা ইব্রাহীমের কীর্তি দেখো। আমি ছুরিকে আগেই আদেশ করে রেখেছি, হে ছুরি! তুমি ইসমাঈলের একটি পশমও কাটবে না। ছুরি আমার সে আদেশ পালন করবে। কাজেই তোমরা চিশ্চিত থাকো। হযরত ইব্রাহীম (আ:) বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে সজোরে পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দিলেন।
আহা! কী নিদারুণ দৃশ্য! কি মর্মান্তিক ব্যাপার। বিশ্ববাসীগণ! চেয়ে দেখো, হযরত ইব্রাহীমের খোদাপ্রেমের কাছে আজ পুত্র ¯েœহ পরাজিত। কিন্তু এ কি! ছুরিতে যে ধার নেই একটুও! একটা পশমও তো কাটছে না ছুরিতে। হযরত ইব্রাহীম ভাবেন, কী আশ্চর্য! এত জোরে ছুরি চালাচ্ছি, অথচ কচি বালকের চামড়া একটুও কাটছে না কেন। এ ছুরি দিয়ে আমি শত শত উট জবেহ করেছি, তাতে এর সিকি বলও তো প্রয়োগ করতে হয়নি। আজ চতুর্থ গুণ বল প্রয়োগে ছুরি চালান সত্তে¡ও কেন এরূপ হচ্ছে। হযরত ঈসমাইল (আ:) বললেন, কৈ আব্বাজান! ছুরিতে আমার গলা কাটছে না তো। হযরত ইব্রাহীম (আ:) বিস্মিত স্বরে বললেন, কি জানি বাবা! আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। হযরত ঈসমাইল (আ:) বললেন আব্বাজান! নিশ্চয় আপনার মন দুর্বল হয়ে হাত অবশ হয়ে আসছে, তাই আপনি সত্যিকারের বল প্রয়োগে চুরি চালাতে পারছেন না। মন দৃঢ় করুন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) তার মনকে আরো দৃঢ় করে আবার সজোরে ছুরি চালালেন পুত্রের গলায়। এবার সত্যি সত্যিই অতি সহজেই জবেহ হয়ে গেল। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের বাঁধন খুলে ফেললেন। কিন্তু এ কি! সবিস্ময়ে চেয়ে দেখলেন, হযরত ইব্রাহীম (আ:) জবেহ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার পুত্র ঈসমাইল নয়, তার বদলে জবেহ হয়েছে একটি দুম্বা, আর পুত্র ঈসমাইল দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই। শুধু ঈসমাইল নয়, জিব্রাইল (আ:) এবং আরও অসংখ্য ফেরেশতা দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে।
হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর দুচোখ বেয়ে ঝর ঝর করে অশ্রæ নিপাত হতে লাগল। তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন, হে আল্লাহ! কেন তুমি আমার প্রতি বিমুখ হলে। তোমার আদেশ প্রতিপালন করতে তো আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমি তো স্বহস্তে তীক্ষèধার ছুরিকা ধরে আমার পুত্রকে কুরবানি করছিলাম, কিন্তু আমার কোন অপরাধ, তুমি তা কবুল করলে না? বল প্রভু! কোন ত্রæটি হয়েছে আমার? যদি আমার জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আমি কোনো অপরাধ বা ভুল করে থাকি তবে তা আমাকে বলে দাও আমি এখনি সে ত্রæটি সংশোধন করে আবার আমার পুত্রের গলায় ছুরি চালাব। আর যদি তা না বলো, তবে শাণিত ছুরিকা দ্বারা আমি নিজেকেই তোমার নামে কুরবানি করো দেবো।
বলো প্রভু! তাই কি চাও তুমি? বলো খোদা! কিরূপ কুরবানি পেতে চাও তুমি আমার কাছ থেকে? মারহাবা, মারহাবা ইয়া ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ! মারহাবা, মারহাবা ইয়া ঈসমাইল জবিহুল্লাহ! জিব্রাইল (আ:) বললেনÑ আচ্ছালামু আলাইকুম ইয়া ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ! আচ্ছালামু আলাইকুম ইয়া ঈসমাইল জবিহুল্লাহ! হযরত ইব্রাহীম (আ:) জিব্রাইল ফেরেশতার সালামের জওয়াব দিয়ে বললেন, হে রুহুল কুদ্দুস! আল্লাহর একি অদ্ভুত লীলাখেলা! যে পুত্রকে আমি স্বহস্তে কুরবানি করলাম, সে রইল সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে আমার পাশে দাঁড়িয়ে, আর কুরবানি হয়ে গেল একটা দুম্বা, দুম্বাটা এখানে কি করে কোথা থেকে এলো? হযরত জিব্রাইল (আ:) বললেন, হে খলিলুল্লাহ! আপনি চিন্তা করবেন না ব্যস্ত হবেন না।
আল্লাহ তায়ালা আপনার কুরবানি কবুল করেছেন। কেবল আপনার কুরবানিই নয় বরং আপনার স্ত্রী হাজেরার পুত্র কুরবানি এবং পুত্র ইসমাঈলের আত্মা কুরবানিও কবুল করেছেন। আপনার ঈমান পরীক্ষা করার জন্যই আল্লাহ আপনাকে এমন কঠোর আদেশ প্রদান করেছিলেন, আপনি সে পরীক্ষায় অত্যন্ত সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন (সূরা আস-সাফ্ফাতের ১০৪ থেকে ১১১ নম্বর আয়াতের ব্যাখা) শুধু আপনি নন, আপনার বালক পুত্র ঈসমাইলের এই বিরাট আত্মত্যাগ ও অসীম ধৈর্যের কথাও কিয়ামত পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে সেই সঙ্গে আপনার স্ত্রী হাজেরার কথাও! আপনাকে, আপনার স্ত্রী ও পুত্রকে দুনিয়ার প্রতিটি মুসলমান নর-নারী কিয়ামত পর্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। আপনাদের পিতা-পুত্রের এ অমর কীর্তিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য সারা দুনিয়ার অগণিত মুসলমান প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আযহা উপলক্ষে নিজেদের সাধ্যমতো উট, দুম্বা, গরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতি কুরবানি করবে। আর এই পুণ্য প্রথা প্রচলিত থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। সূত্র : (তাফসীরে কবীর, তাফসীরে রুহুল মাআনী)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন