শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদ সংখ্যা

আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে কুরবানির প্রভাব

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৪ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭



বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে সর্বাধিক প্রভাব ফেলেছে যেসব ইসলামী উৎসব তার মধ্যে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা প্রধান। এই দু’টি পর্ব সমগ্র মুসলিম জাহানেরই জাতীয় আনন্দ-উৎসব। ঈদুল ফিতর আত্মসংযম ও সমমর্মিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে আর ঈদুল আযহা আত্মোৎসর্গের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় আরব দেশে ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় সমসাময়িককালেই। প্রাচীনকালে বাংলাদেশের সঙ্গে আরব দেশের নৌপথে নিবিড় বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। এই সুবাদেই আরব বণিকগণ হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আমলেই বাংলাদেশে ইসলামের বার্তা বয়ে নিয়ে আসেন। এ-ও জানা যায় যে, চীন ও সুমাত্রা অঞ্চলে নৌপথে বাণিজ্য জাহাজে গমনকারী কোনো কোনো সাহাবায়ে কেরাম সফর বিরতি করেছেন বাংলাদেশের উপকূলীয় সমুদ্র বন্দরে। তবে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচারের সূত্রপাত ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর খিলাফতকালে। ইসলাম বাংলাদেশের মানুষের মননকে যে পরিচ্ছন্ন চেতনায় উদ্ভাসিত করে, যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে তা অতি দ্রæত প্রসারিত হতে থাকে এ দেশের বৃহৎ অংশে। এ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বহুত্ববাদের দীর্ঘকালীন নিগড় থেকে নিজেদের মুক্ত করে একাত্মবাদের মুক্ত সড়কে এসে সত্যিকার জীবন জোয়ারে আপ্লুত হয়। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অচলায়তন। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে এক নতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আঙিনা ইসলামের ঈমান-আকিদা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অনুশাসনের প্রভাবেÑ যা কালে কালে এদেশী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের স্বকীয় পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক বিপ্লবাত্মক প্রভাব ফেলে আসছে সেই আদিপর্ব থেকেই। ঈদুল আযহা এমন এক আনন্দ-উৎসব যা শুধু জীবনকে জানাবার এবং উপলব্ধি করবার প্রেরণাই দান করে না, বরং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার নৈকট্য লাভের পথও প্রশস্ত করে দেয়। ঈদুল আযহা বাংলাদেশে কুরবানির ঈদ নামেই সমধিক পরিচিত। একে বকরী ঈদও বলা হয়। আরবী করবান শব্দটির অর্থও নৈকট্য। অন্যদিকে ঈদুল আযহার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জবেহের আনন্দ-উৎসব। যে উৎসবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি দেয়া হয় এবং যার মাধ্যমে আল্লাহর র্কুবত বা নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয় সেটাই কুরবানির ঈদ।
ঈদুল আয্হা পশু কুরবানির মধ্যদিয়ে সামাজিক বিপ্লবের পথও প্রশস্ত করে দিয়েছে বাংলাদেশ। ব্রিটিশ ভারতে গরু কুরবানির বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন চালিয়েছে হিন্দু সমাজ। হিন্দু জমিদাররা তাদের জমিদারি এলাকায় গরু কুরবানি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে হিন্দু জমিদারি এলাকায় গরু কুরবানি করা তখন ভীষণ কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর যে মহা বিপ্লবী জিহাদী আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন সেই আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল গরু কুরবানির ওপর হিন্দু জমিদারদের নিষেধাজ্ঞা সমূলে উৎখাত করা।
ঈদুল আয্হা বা কুরবানির ঈদ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বাংলা সাহিত্যে এর উপস্থিতি অবলোকন করলেই। ব্রিটিশ ভারতে মুসলামানরা স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করে আসেন ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই। ব্রিটিশ ভারতে আমরা কবি কায়কোবাদ, ইসমাঈল হোসেন শিরাজী প্রমুখ কবিদের লেখায় আত্মকুরবানির প্রতীকরূপে কুরবানির ঈদকে দেখতে পাই। অনল প্রবাহের কবি ইসমাঈল হোসেন শিরাজী ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য নিজের জান কুরবানি দেবার শপথ গ্রহণ করতে জাতিকে আহŸান জানান।
বাংলা সাহিত্যে কুরবানির ঈদকে ব্যাপকভাবে এবং সঠিক পরিচয়ে উপস্থাপিত করেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কুরবানির ওপর তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেন। তিনি এক স্থানে বলেন, ডুবে ইসলাম আসে আঁধার/ইব্রাহীমের মতো আবার/কুরবানি দাও প্রিয় বিভব/জবীহুল্লাহ ছেলেরা হোক...।
ঈদুল আয্হা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়েছে। এর আনন্দ এনে দিয়েছে সামাজিক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংরক্ষণের অনুপ্রেরণা। কুরবানির পশুর গোশ্ত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া এবং আর এক ভাগ নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য রাখাÑ এই বণ্টন নীতি, ঈদের আনন্দ সবাই সমানভাগে ভাগ করে নেবার প্রেরণায় উদ্ভাসিত করেছে। ঈদুল আয্হা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে এবং আত্মসচেতনতায় বলীয়ান করে। ঈদুল আযহার দিনে সামর্থ্য মতো ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে, নিজেকে সুন্দর করে, সজ্জিত করে ঈদগাহে গিয়ে বৃহৎ জামাতে দুই রাকাত নামাজ ইমামের পেছনে আদায় করার মধ্যে, নামাজ শেষে ধনী, নির্ধন একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলির মধ্যে, তারপর যাদের সামর্থ্য আছে তাদের পশু কুরবানির মধ্যে, কুরবানির গোশ্ত ধনী, নির্ধন সবার মাঝে বণ্টনের মধ্যে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে তা বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এক মিলন মোহনায় এসে দাঁড়াবার প্রেরণা জোগায়।
ঈদুল আয্হা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এনে দেয় মহামিলনের অনুভব।
লেখক : মুফাসসিরে কুরআন, গবেষক ও সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন