আন্তর্জাতিক পটে মুসলিমরা হেরেই যাচ্ছে, ঠকে যাচ্ছে। তবুও মুসলিমবিরোধী কিছু গোষ্ঠীর ক্রোধ কমছে না। আরো ছবক শেখাতে নানা কসরত করছে। তারা কখনো সরাসরি যেমন ফিলিস্তিন, মিয়ানমারে, কখনো মুসলিমদের ভিতরেই বিভেদ সৃষ্টি করে যেমন সিরিয়া, লিবিয়ায়, এইসব গর্হিত কার্যাবলী করছে। শত্রæ সরাসরি মুসলিমদের আক্রমণ করতে পারে, তবে যেখানে মুসলিমরা রাজনৈতিক মত পার্থক্য বা ফিরকাগত কারণে একে অন্যের বিরুদ্ধাচারণ করছে, সেখানে বিদেশিরা অনুপ্রবেশ করে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। অতীতে মুসলিমরা অনৈক্যের জন্য দক্ষিণ ইউরোপ, ফিলিস্তিনসহ বহু এলাকা হারিয়েছে। পলাশীর কারণে বিদেশিরা এই এলাকার কাবুল থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ছড়ি ঘুরিয়েছে।
এখন সর্বশেষ দলাদলি মুসলিম বিশ্বে কাতারকে নিয়ে। পুরা ঘটনার পিছনে চারটি আরব রাষ্ট্র থাকলেও সউদী আরবই যে প্রধান ফিতনা সৃষ্টিকারী তা প্রমাণিত হয়েছে। নতুন যুবরাজ এসেই এই ফিতনায় ঘি ঢেলে দিয়েছেন। তবুও ভালো যে যুবরাজের চেতনা ফিরেছে। তিনি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ও ইয়েমেন সংকট নিরসনের জন্য রাস্তা খুঁজছেন এখন। এর আগে বৃদ্ধ বাদশাহকে তিনি ভুল পথে নিচ্ছিলেন। মুসলিম ঐক্যবিরোধী এজেন্ডা নেয়ায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সউদী ইজ্জত হুমকির মুখে দাঁড়ায়। সউদীর পেছনে মিশর, যার নেতা একজন ইহুদী নারীর পুত্র, যাতে পুলকিত ইসরাইল। আর দুই মিত্র আরব আমিরাত ও বাহরাইনে নেই কোন গণতন্ত্র, মানবাধিকার। এমনকি ইসলামী অধিকারগুলোও এসব রাষ্ট্রে আছে কি না সন্দেহজনক। মিশরের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইহুদী পুত্র নস্যাত করেছে। অবশ্য এর পিছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, সউদী আরব ও আরব আমিরাত। যুক্তরাষ্ট্র তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগানকেও হত্যা করতে প্রচেষ্টা চালায়। তবে সউদী আরব এই প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করায় তার কাজটা ঠিক হয় নাই। এক শ্রেণির মার্কিনী গবেষক, যারা ইসরাইল ঘেঁষা, মনে করে যে, সউদী আরবকেও লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরাকের মতো ছবক শেখানো উচিত, কারণ অন্যদের মতো তাদের কোমড় ভেঙে না দিলে, তারা আবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে না দাঁড়ায়। সউদী আরবকে কয়েক টুকরা করার একটা পরিকল্পনা ইহুদী লবির হাতে রয়েছে। সময়মতো তারা এ নিয়ে এগুবে।
আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, ফিলিস্তিন ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মুসলিম বিশ্ব। তার সঙ্গে যোগ দিতে অযথা কাতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে। শয়তান পিছু ছাড়ছে না মুসলমানদের। পররাষ্ট্রনীতিতে মেধা কমই দেখা যাচ্ছে বর্তমান যুগের মুসলিমদের। অথচ অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, মুসলিম শাসকরা পররাষ্ট্র নীতির জ্ঞানে খুবই উচ্চ স্তরের ছিলেন। গ্রানাডার আল হামরা প্রাসাদে ছিল ‘হল অব অ্যামবাসাডারস’Ñ রাজদূতদের মিলনায়তন। এ হল এখনো আছে। ভ্রমণকারীরা দেখে থাকে। মুসলিম শাসকদের দেখাদেখি সেভিলের খ্রিস্টান রাজা তার আল-কাজারে প্রাসাদ-কিল্লায়Ñ মুসলিম স্থপতিদের দ্বারা তৈরি করান ‘রাজদূতদের মিলনায়তন’। পররাষ্ট্র নীতির বিষয়টি খুবই গুণগত মানে দেখতেন মুসলিম শাসকগণ। আমার স্ত্রী ও আমি ‘রাজদূতদের মিলনায়তন’-এর দুটিই সফরে দেখে এসেছি। বর্তমান যুগের প্রায় মুসলিম শাসকদের পররাষ্ট্রনীতি বলে কিছুই নেই। তাঁরা সবাই ¯্রােতের শেওলার মতো ভাসেন। গাদ্দাফি, সাদ্দাম প্রমুখ সঠিক পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণ না করায় না দেশের চারপাশে, না দূরে, বন্ধু সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
যাইহোক কাতার ভাগ্যবান। ঘরের কাছে বন্ধু সৃষ্টি না করলেও তার অবস্থাও ইরাক-লিবিয়ার মতো হয়ে যেত এর ভিতর। সাহসী দুই রাষ্ট্র তুরস্ক ও ইরান তার বিপদের বন্ধু হয়ে অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও কাজে দিয়েছে।
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েও সউদী কোয়ালিসন আবার হাতছাড়া রাজধানী সানাতে বিমান থেকে বোমা ফেলেছে যা বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে যার ভিতর ছিল নারী, শিশু, বেসামরিক ব্যক্তিগণ। ইয়েমেন সমস্যা শিয়া-সুন্নী প্রশ্নে যাতে শিয়াবিরোধী ভূমিকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে সউদী আরব। অথচ মুসলিম বিশ্বে জনগণের নিকট তাদের পররাষ্ট্রনীতি কমই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সউদী আরব শিয়াদের বিরোধিতা করে মুসলিম অনৈক্য সৃষ্টি করেছে যা ইসরাইল ও তার মিত্রদের সাহস জুগিয়েছে মুসলিমবিরোধী এজেন্ডা গ্রহণে। শিয়াবিরোধী নীতি আল-কায়েদা, তালিবান, বোকো হারাম পর্যন্ত অনুসরণ করেছে সুন্নি মুসলমান হওয়ার দোহাই দিয়ে। আর এই আত্মঘাতী নীতির পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে ইসরাইল ও তার মিত্ররা।
ইরানকে নানানভাবে ঘায়েলে নতুন খেলা নিয়ে মাঠে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ইরানের ভাগ্য সুপ্রসন্ন আল্লাহর তরফ থেকে তার দক্ষিণ সীমান্ত এখন বন্ধু ভাবাপন্ন হয়েছে এবং সেই সঙ্গে তুরস্কের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এসবের জন্য সউদী আরবের যুবক যুবরাজের প্রতি ইরানের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ইরানের এটি অশাতীত সাফল্য পররাষ্ট্রনীতিতে।
আফগানিস্তানের খেলা যুক্তরাষ্ট্র শেষ করছে না। এর জন্য সম্ভবত: ইন্ডিয়া দায়ী। মার্কিন ও ইন্ডিয়া সম্মিলিত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে আফগানিস্তানে। ফলে পাকিস্তান আরও বেশী করে চীন-রাশিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, যে রাশিয়া তার অপমান ভুলতে তালিবানের সঙ্গে মিত্রতার টোপ দিয়েছে। চীন এতে নিম রাজি। তবে ডোনাল্ডের নতুন মার্কিন নীতির কারণে আরও নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরবে।
পাকিস্তান ধীরে ধীরে মার্কিন বলয় থেকে সরে যাচ্ছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর পাকিস্তানের কদর কমে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের। তবে পাক-চীন সম্পর্ক গভীরতর হচ্ছে।
নাইজেরিয়া এখন পর্যন্ত বোকো হারামের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারে নাই। তাদের কিছু দাবি মেনে নিলে সমস্যাটার সমাধান হতো। একই রকমের সমস্যা ইন্দোনেশিয়া আছে এদেশে হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার আছে এদেশের জন্য বিশেষ আইনের ব্যবস্থা করে বিদ্রোহ দমন করে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ধর্মীয় শান্তি এখনও পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা হয় নাই। খ্রিস্টান-মুসলিম সংঘর্ষ মাঝে মাঝে হচ্ছে। ফিলিপাইনে মুসলিম সমস্যার সমাধান এখনও হয় নাই। যার ফলে মুসলিমদের একদল এখনও সশস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র তাই উপস্থিত হাতিয়ারসহ বিশ্বব্যাপী ‘ওয়ার অন টেরর’ চলছে।
মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যার মানবাধিকারসম্মত সমাধান এখনও করে নাই। অহিংসার নীতি আর সেখানে নেই। উভয়পক্ষ সশস্ত্র। তবে কে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র করল? এটি একটি প্রশ্ন। ইন্ডিয়া তার দেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বের করে দিতে চাইছে। তারা মুসলিম। এই জন্য কি? এই নীতি অবলম্বন করলে, ইন্ডিয়ার ধর্মনিরপেক্ষতা ও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র-এ ধরনের মান্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।
ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইন্ডিয়া প্রভৃতি এলাকায় মুসলিমরা ধর্মকর্ম ঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। হালাল খাবার, পোশাক, মসজিদ, নামায, পারসনাল ল’, রোজা, দাড়ি ইত্যাদি নিয়ে নানামুখী নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন তারা। ওআইসি’র ভূমিকা খুবই দুর্বল এসব ক্ষেত্রে। কানাডাতে বর্তমান সরকারের জন্য মুসলিমরা ভালো রয়েছে। মুসলিমদের উচিত এঁটা ধরে রাখা। তবে স্পেনের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনা একটা নেগেটিভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার ইস্যু নিয়ে খুব নাজুক অবস্থায়। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। আবার আমাদের দিকে শরণার্থী ঠেলে দিবে- তা মেনে নেওয়া যায় না। ওআইসি ও চীনের মাধ্যমে সমস্যাটার সমাধান আসতে পারে। রোহিঙ্গারা আমাদের কাছাকাছি ভাষায় কথা বলে, এই ছুতায় তাদের স্থান বাংলাদেশে, এটা কোন যুক্তি হল? বাঙলা ভাষায় কথা বলে না যারা, তাদেরকে কি আমরা বের করে দিব? তা কেমন করে হয়? ভাষায় ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সীমানা কমই হয়।
একটা প্রশ্ন এসেছে যে মুসলিমরা সন্ত্রাস করছে। আসলে সব মুসলিম নয়, অল্প সংখ্যক মুসলিম। যেখানে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম রয়েছে যেমন ফিলিস্তিনে সেখানে সশস্ত্র সংগ্রাম বৈধ। আর অন্যত্র মুসলিমদের ধৈর্য্য ধারণ করা উচিত। তবুও আমরা বলব ‘ডেসপারেট’ (হতাশাগ্রস্ত) মুসলিম কিছু যুকব করলেও বিপক্ষের রাষ্ট্রীয় যন্ত্র যেভাবে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করছে নানাভাবে, এই দুই ধরনের সন্ত্রাসের কোন তুলনাই হয় না। সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা গ্রাহাম ই ফুলার তাঁর “ওয়ার্লড উইথ দ্য আউট ইসলাম” গ্রন্থে পাশ্চাত্যের এই দ্বিমুখী নীতির তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি লেখেন, “সন্ত্রাসী হত্যা করার প্রয়াসে পঞ্চাশ হাজার ফুট দূর থেকে বোমা ফেলা বৈধ, কিন্তু জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে পাঁচ ফুট দূর থেকে শত্রæকে হত্যার জন্য একটি একক আত্মঘাতী বোমা হামলা, এখানেও নিরীহ মানুষ মারা যায়, চালানো অনৈতিক?’ তবুও আমরা বলব এসব না করাই ভালো বিদেশে, কারণ বহু মুসলিম যে এখন বিদেশে বসবাস করে। তারা হুমকির মুখে পড়ে। মুসলিমদের নীতি ঢেলে সাজাতে হবে।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন