এই তো এসে গেছে কোরবানীর ঈদ, ঈদুল আজহা। নতুন ধরনের এক আনন্দোৎসবে মেতে উঠতে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়। রমজানের ঐ রোজার শেষে আমরা যে আত্তি¡ক আনন্দে জাগ্রত হই, এটা সে রকমের নয়। কেননা এতে আছে ত্যাগের আনন্দ। ঐতিহ্য সূত্রে বিশ্বব্যাপী এটা সর্বজন পরিজ্ঞাত যে, মহান প্রেরিত পুরুষ হজরত ইব্রাহিমকে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়ে ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানী করার। দেখা গেল সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি হলো তার আপন সন্তান। আশ্চর্য, সেই সন্তান বালক ইসমাইল স্বয়ং নিঃসঙ্কোচে আত্ম বলিদানে অগ্রসর হয়ে তার পিতাকে কর্তব্য সাধনে আহŸান করল। পরম করুণাময় আল্লাহ তখন পিতাপুত্রের অকল্পনীয় ত্যাগের বিকল্প পন্থার নির্দেশ দিলেন। সমগ্র বিশ্বে কোটি কোটি মুসলমান ১০ থেকে ১২ তারিখ জিলহজ্ব মাসে সুস্থ পশু কোরবানীর মাধ্যমে এই ত্যাগ সাধনে অগ্রগণ্য হয়ে আসছে এবং এবারও হবে।
ইতোমধ্যে পুরো পৃথিবীতে চলছে নানা অকাÐ-কুকাÐ আমাদের দেশেও। তদুপরি অনবরত বর্ষণ আর বিপরীত স্রোত এসে আমাদের ভূখÐের একটি বড় অংশ বন্যা প্লাবিত। কীভাবে তাহলে উদযাপিত হবে ত্যাগের উৎসব, কোরবানী?
বলা বাহুল্য, এক জাতীয় দুর্যোগের মুখোমুখি এখন আমরা। একদিকে ঈদুল আজহা যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে পালনের প্রতিজ্ঞা অন্যদিকে বন্যাজনিত দুর্দশাগ্রস্ত দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা। অবশ্যই আমাদের দুকূল রক্ষা করতে হবে। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা করবে সেটা সম্ভব হবে না।
প্রসঙ্গত আমার কৈশোর কালের কথা মনে পড়ে। তখন অনেক দরিদ্র পরিবারের মানুষ যারা বিত্তবান তাদের উৎসব আনুসঙ্গিকতার শরীক হয়ে থাকতো। রোজার ঈদ, কোরবানীর ঈদ তারা একই সঙ্গে কাটাতো, হয়তো বা তাদের মনে কিছু ক্ষোভ অবশ্যই থাকতো। তাই কালক্রমে এখন স্বচ্ছল হয়ে তারা স্বতন্ত্রভাবে তাদের জীবনধারনের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। বেশ কিছুকাল আগেই আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের গ্রামে কোরবানীর গোশত নেবার মতো গরীব-দুঃখী আর নেই। এখন শুধু আত্মীয়-স্বজনদের তাদের গোশত পাঠানো যায়। কোরবানীর গোশত নেবার জন্য আশপাশের গ্রাম থেকে ভিখারী শ্রেণীর লোকজন আসে। শহরের বাড়িতে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেখানে বস্তির লোকের পোয়াবারো। যা হোক, এভাবে বর্তমানে আমরা বন্যাপীড়িত মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় গোশত আর জাকাতের অর্থ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। তাতেই আমরা অনুভব করবো যথার্থ ত্যাগের আনন্দ। সাধারণভাবে সাহায্য বিতরণের মধ্যে যে মানবিকতার প্রকাশ এভাবে গভীর ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে আকস্মিক দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় অনেক বেশি আন্তরিকতা সমৃদ্ধ মহানুভবতার উন্নয়ন ঘটবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা যে একটা ঐশ্বরিক প্রত্যয়বোধ থেকে বিচ্ছুরিত তা মর্মে মর্মে অনুভূত হবে। পবিত্র কোরআন শরীফে এর বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। একটা নির্দেশের বাংলাা তর্জমা এখানে পেশ করা হলো : “প্রদত্ত জন্তুর ওপর নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা তাদেরকে তিনি রিজিক হিসাবে দিয়েছেন। অত:পর তা হতে আহার কর আর যারা দুস্থ তাদেরকে আহার করাও।” (সূরা হাজ : ২২/২৮)।
আহার তো আমরা হরদম করেই যাচ্ছি। এখন ঐ নির্দেশের শোষাংশের ওপর কি আমরা একটু বেশি জোর দিতে পারি না? অবশ্যই পারি। বন্ধু-বান্ধবদের মতো সমভাবে আতিথেয়তা প্রদর্শন করতে পারি। এবং এটা শুধু স্বধর্মীদের জন্য নয় বিধর্মীদের ক্ষেত্রেও একই উপায়ে প্রযোজ্য। মানবতার সেবায় আমাদের আত্মোৎসর্গের আকুলতা অর্জন করতে হবে। এটাইতো ঈদুল আজহার শিক্ষা।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বাংলা একাডেমি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন