‘অহিংসা পরম ধর্ম’ এবং ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ বাণী প্রচার করে গৌতম বুদ্ধ মানবতাবাদী হিসেবে জগৎসংসারে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছেন। প্রবর্তন করেছেন বৌদ্ধ ধর্ম। সেই ধর্মের অনুসারীরা মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করছে। এটা কোন ধরণের অহিংসার নমুনা! তাহলে কি মিয়ানমারের বৌদ্ধদের কাছে রোহিঙ্গারা ‘জীব’-এর সংজ্ঞায় পড়ে না? আরাকানের চতুর্দিকে রক্ত আর আগুনের ভয়ঙ্কর দৃশ্য। নারী-পুরুষ এমনকি অবুঝ শিশুর চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছে রাখাইন রাজ্যের আকাশ-বাতাস। ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ ধর্মে রোহিঙ্গা হত্যা ‘মহাপূণ্য’!! ‘অহিংস পরম ধর্ম’ অনুসারীদের রোহিঙ্গা গণহত্যা পরম ধর্ম? বৌদ্ধের বাণী ‘সংসার ধর্ম ত্যাগ কর’ অথচ মিয়ানমারের সব বৌদ্ধই ঘর-সংসার করছে এবং মুসলিম নিধনে সবাই এক কাতারবদ্ধ!
মিয়ানমারে বৌদ্ধ সেনারা জাতিগত রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন তথা শতশত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ হত্যা করছে। একশ কিলোমিটার এলাকার বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। জীবন বাঁচাতে ছুঁটছে সীমান্তের দিকে। সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারলেও আরো লক্ষাধিক নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে; উভয় পাশ থেকে তাদের দিকে তাক করে আছে বিজিবি ও বিজিপির বন্দুকের নল। জাতিসংঘ এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বিশ্ব বিবেক নীরব। বিশ্বের দেশে দেশে মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং গণতন্ত্রের ত্রাণ কর্তারা ঘুমিয়ে। রোহিঙ্গারা বেঘোরে মরছে অথচ আমাদের দেশের ‘মুসলমানদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝড় তোলা’ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের আল্লামা শফি হুজুর, মানুষকে নিত্য ছবক দেয়া দেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাঁ সোলাকিয়ার ইমাম, মানবাধিকার রক্ষার এজেন্সিধারী শাহবাগের ইমরান এইচ সরকার, ‘সব ধর্মের মানুষ সমান’ শ্লোগানধারী বামপন্থী বিবেকবান রাজনীতিক, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রতিবাদকারী রাজপথে সোচ্চার মুখচেনা নারী নেত্রী, মানবতার সেবাদানের দাবিদার এনজিওকর্মী সবাই নীরব দর্শক! মিয়ানমারের আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্ত ঝড়ছে; অথচ তাদের পাশে নেই পবিত্র দুই মসজিদ মক্কা-মদিনার খাদেম ও মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক সউদী বাদশাহ, গ্রান্ড মুফতি থেকে শুরু করে ওআইসি কেউই! রোহিঙ্গা মুসলিমরা কি মানুষ নয়! তাদের কি বেঁচে থাকার অধিকার নেই? রোহিঙ্গা শিশুদের কি বেঁচে থাকার অধিকার নেই? নারীদের ইজ্জত আব্রæ মূল্যহীন?
মিয়ানমারে চলছে মুসলিম নিধন। ধর্মে রোহিঙ্গারা মুসলমান সে জন্যই হয়তো কনফুসিয়াসের চীন নিশ্চুপ; ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠা শ্বেত ভাল্লুকের দেশ পুতিনের রাশিয়া নিরব; জুয়া-ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্যাম্পের আমেরিকা নিচ্চুপ; মোদীর হিন্দুত্ববাদী নীতিতে নিমজ্জিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম অনুসারী মহাত্মা গান্ধীর ভারতের মুখে কুলুপ, মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা দালাইলামা অন্ধ। সুচির দেশের সামরিক জান্তারা মুসলিম নিধন অভিযান নীরবতা পালনের মাধ্যমে এইসব দেশ-ব্যাক্তিরা বার্তা দিচ্ছেন রোহিঙ্গা মুসলিম নারী-পুরুষ-শিশুদের গায়ে কোনো রক্ত নেই; তাদের দায় নেই। সে জন্যই রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র দেখেও তারা নীরব। কিন্তু মুসলিমদের অধিকারের দাবিতে যারা সোচ্চার তারা নীরব কেন? আমাদের দেশের নেতানেত্রী ও মানুষের অধিকার আদায়ের ব্যাপারীরা উটপাখির মতো গর্তে মুখ লুকিয়ে আছেন কেন? দু’একটি ইসলামী দল রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনের প্রতিবাদ করলেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল- সামাজিক সংগঠন-ব্যাক্তি যেন নীরব দর্শক। সাংস্কৃতির সংগঠন, ক্লাব-পাঠাগার, শিল্পী-সাহিত্যিক নীরব কেন? কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষকরা অন্ধ হয়ে আছেন। বিশ্বের কোনো দেশে সংখ্যালগু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-ইহুদিদের ওপর ঢিল ছুঁড়লেই প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে রাস্তায় গান গেয়ে মানবতার ছবক দেন; রোহিঙ্গারা মুসলিম হওয়ায় কি তারা এখন নীরব দর্শক? সেটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মানবতাবাদী বামপন্থী রাজনীতিক, মসজিদের ঈমান, অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের নেতাকর্মীরা কি রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে গগন বিদারী কোনো মিছিল করেছে? বিশ্বের কোনো প্রভাবশালী মিডিয়ায় কি তাদের প্রতিবাদের কোনো খবর ছাপা হয়েছে?
আল-জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন এবং বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশনের ফুটেজে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হানাদারদের গুলির মুখে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা যেমন ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণটুকু হাতে নিয়ে ভারতে আশ্রয়ের আশায় ছুটেছিল; সুচির অহিংসা পরম ধর্মে দিক্ষীত সেনাবাহিনীর বিভৎস হত্যাযজ্ঞ তাদের মতই জীবন বাঁচাতে আরাকান থেকে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ছুটছেন রোহিঙ্গারা। তাদের আশ্রয় দিতে দিতে সেই ক্ষমতা এখন হারিয়ে বসেছে বাংলাদেশ। তারপরও তো রোহিঙ্গারা মানুষ। নিরস্ত্র এইসব রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, বাড়ি ঘর লুটপাট করা হচ্ছে, অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যদি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হতেন তাহলে কি ভারত নীরব থাকতো? রোহিঙ্গারা যদি ইহুদি হতেন তাহলে কি আমেরিকা-ইউরোপ মুখে কুলুপ এঁটে থাকতো? রোহিঙ্গারা খ্রিষ্টান হলে কি পুতিন-ট্রাম্প খিল মেরে ঘরে বসে থাকতেন? রোহিঙ্গারা খ্রিস্টান নয়, তবু পোপ ফ্রান্সিস রোহিঙ্গা নিধনের নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অথচ সউদী বাদশাহ’র ঘুম ভাঙ্গছে না?
মিয়ানমারে বিপন্ন মানবতা। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা অব্যাহত রয়েছে। শিশু-নারী-বৃদ্ধ কেউ রেহাই পাচ্ছে না শান্তিতে নোবেল জয়ী সুচির সামরিক বাহিনীর হাত থেকে। গ্রামের পর গ্রাম বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। জীবন বাঁচাতে মানুষ ছুঁটছে সীমান্তের দিকে। সেখানে বাঁধা পেয়ে গুমরে মরছে; আত্মনাদে আকাশ-বাসাত ভারী হচ্ছে। দৃশ্য এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় করুণ চিত্র। নাফ নদীতে ভাসছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের লাশ। রোহিঙ্গা সংকটের একটা বাস্তবসম্মত সমাধানে পৌঁছবার লক্ষ্যে সুপারিশ প্রদানের জন্য ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনে মিয়ানমারের ৬জন সদস্য রাখা হয়। বাকি ২ সদস্যের একজন লেবানন এবং আরেকজন নেদারল্যান্ডসের নাগরিক। দীর্ঘ এক বছর বিরামহীন কাজ করে কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করে। গত ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট টিন কিউ এবং শীর্ষ নেত্রী অং সান সু চির কাছে তুলে দেওয়া হয়। পরের দিনই শুরু হয় রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাযজ্ঞ।
নাফ নদীর পানিতে ভাসছে মানবতা, মিয়ানমারের বর্বর বৌদ্ধ সেনাবাহিনীর হাতে ক’দিন পরপর রোহিঙ্গা মুসলমানরা প্রাণ হারাচ্ছেন। জীবহত্যা মহাপাপ ধর্মের বাণী যারা ছড়িয়ে দেন, লালন করেন অহিংসায় পরম ধর্ম যারা বিশ্বাস করেন বলে দাবি করেন তারাই আজ রোহিঙ্গা হত্যাকে কোন অপরাধ মনে করছেন না। কিন্তু আমাদের দেশের বিবেকবানরা নীরব কেন? রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার অধিকার হরণের বিভৎস রুপ ও মর্মান্তিক চিত্র দেখে মুখে কলুপ এঁটে থাকা কি বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা নয়? মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়া জঘন্য অপরাধ। সুচি বাহিনীর মানবতাবিরোধী শোষণ, অত্যাচার, জুলুম নির্যাতনের রিরুদ্ধে জনমত গঠনের উদ্যোগ নেই কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ মিয়ানমারকে দেয়া বাংলাদেশের যৌথ অভিযানের প্রস্তাবকে উদ্বেগজনক অবিহিত করে গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে নিবন্ধ লিখেছেন। তার মতে ‘বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া এই প্রস্তাব উদ্বেগজনক। যদিও বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এই প্রস্তাব দিল তা নয়। গত বছরের আগস্ট মাসেও বাংলাদেশ এ ধরনের যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছিল। মিয়ানমারের নির্যাতিত বিদ্রোহীরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে যেভাবে মনে করেন বাংলাদেশকে সেভাবে বিবেচনা করলে তা কি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক হবে? যদি মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রস্তাবে সাড়া দেয়, তবে এই অভিযানের সূত্রে তাদের নিরাপত্তা বাহিনী কি বাংলাদেশে প্রবেশের অধিকার রাখবে? এ ধরনের নিরাপত্তা অভিযানের সীমানা কীভাবে নির্ধারিত হবে?’
এটা ঠিক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কঠিন পরীক্ষা চলছে। আপাতদৃষ্টিতে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা চলছে। এটা পশ্চিমাদের ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সোমালিয়ার মত দীর্ঘস্থায়ী কোনো সহিংসতার প্লট তৈরির পরিকল্পনা নয়তো? এর পেছনে কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কলকাঠি নয়তো? পরিস্থিতি যেটাই হোক বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের বিবেকবানদের নীরবতা রহস্যজনক। নাফ নদীর পানিতে ভাসছে মানবতা। রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্তে রঞ্জিত। মানবতাবিরোধী এই অপরাধের প্রতিবাদে তো হেফাজতের আহমদ শফি, শাহবাগের ইমরান এইচ সরকার, মানবতাবাদী বামপন্থী রাজনীতিক এবং প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের রাজপথে নামার কথা। পাহাড়ে সন্তু লারমাদের অধিকার নিয়ে যারা সর্বদা সোচ্চার তাদের কণ্ঠে প্রতিবাদী গানের শ্লোক বের হওয়ার কথা। কিন্তু সবাই রহস্যজনকভাবে নীরবতা পালন করছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন