রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

ফাঁদে পড়ে বিপথগামী হচ্ছে যুব সমাজ অভিভাবকদের বাড়ছে ক্ষোভ

শ্রীপুরের ৭ স্পটে মেলার নামে জুয়া ও অশ্লীল নৃত্য

প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শ্রীপুর (গাজীপুর) উপজেলা সংবাদদাতা

গাজীপুর সদর ও শ্রীপুরের ৭টি স্থানে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধভাবে চলছে মেলার নামে হাউজি, জুয়া ও অশ্লীল নৃত্যের জমজমাট আসর। এলাকার যুব সমাজ এসব মেলায় গিয়ে রাতভর জুয়ার আসরে সর্বস্বান্ত হয়ে বিপদগামী হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই জেলার মহানগরসহ শ্রীপুরের ৭টি স্পটে দীর্ঘদিন ধরে অবাধে চলছে মেলার নামে জুয়া, র‌্যাফেল ড্র, হাউজি, উলঙ্গ নৃত্য, ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা। হাউজি ও জুয়া খেলার শেষে রাত ১২টার পর থেকে শুরু হয় প্রধান আকর্ষণ হিসেবে নারীদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ নৃত্য। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারদলীয় নেতাদের প্রতিদিন মোটা অংকের মাসহারা দিয়ে রাতভর চলে ওইসব অনৈতিক কর্মকা-। টাকা হাতিয়ে নেয়ার নানা ফাঁদে পড়ে বিপথগামী হচ্ছে উঠতি বয়সের তরুণ-যুবকরা। গ্রামের অনেক কোমলমতি শিশুও ওই ফাঁদে পড়ছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে হোতাপাড়া, রাজেন্দ্রপুর, বাঘের বাজার, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী বাজারে ও শ্রীপুর উপজেলায় কেওয়া, ২নং সিএন্ডবি, মাওনা ও ফরিদপুর গ্রামে অর্ধশত বিঘা জমি ভাড়া নিয়ে ও বন বিভাগের জায়গা দখল করে মেলার নামে জুয়ার আয়োজন করা হয়েছে। জমির মালিক প্রতিজনকে প্রতি রাতে ভাড়া দেওয়া হয় ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা হারে। কেওয়ার জুয়া মেলার পরিচালক সেলিম হোসেন বলেন, ‘পুলিশসহ বিভিন্নজনকে প্রতি রাতে ৫ লাখ টাকা দিয়ে জুয়া মেলা চালাচ্ছেন তারা। মেলার আয়োজক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রশিদ, তৌহিদ ও সাইফুল ইসলাম।’ এদিকে শ্রীপুরের নয়নপুর এলাকার মেলার আয়োজক স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল হকের ভাতিজা রফিকুল ইসলাম জানান, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই প্রতি রাতের হাউজি-জুয়ার টাকা ভাগাভাগি করে মেলা পরিচালনা করা হচ্ছে। গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-কালিয়াকৈর মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়কে ও শ্রীপুর পৌর এলাকাজুড়ে মাইকিং করে দিনভর র‌্যাফেল ড্রর টিকিট বিক্রি করা হয়। শ্রীপুর রেলওয়ে স্টেশন, স্টেশন রোড এলাকার নূরুল ইসলাম খান মার্কেট, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, লোহাগাছ ফালু মার্কেট, কেওয়াবাজার, ভাংনাহাটি, বৈরাগীরচালা, আনসার রোড মোড় ও ২ নম্বর সিএন্ডবি এলাকাসহ অন্তত ৫০টি স্পটে র‌্যাফেল ড্রর নামে জুয়ার টিকিট বিক্রি করা হয়। গত শুক্রবার রাত ৯টায় সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে একটু পূর্ব পাশে বিশাল প্যান্ডেল। প্যান্ডেল থেকে পাশেই দেখা যায় গ্রামের মসজিদ। প্যান্ডেলের ভেতর ঢুকতেই চোখে পড়ে র‌্যাফেল ড্রর ঘোষণা মঞ্চ। একটু ভিতরে গেলেই ওয়ান-টেন, ডাব্বা, চরকি ও জামাই-বউসহ হরেক জুয়ার ৩৩টি স্টল। সব স্টলেই উপচেপড়া ভিড়। পাশেই রঙিন কাপড় দিয়ে ঘেরা হাউজি খেলার ঘর। মেলায় আসা কয়েকজন জানালেন, হাউজির পর এ ঘরেই শুরু হয় উলঙ্গ নৃত্য। একাধিক জুয়ার স্টল ঘুরে দেখা গেল, খেলায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগই তরুণ। টাকা দ্বিগুণ করার প্রলোভনে পড়ে তারা জুয়ার বোর্ডে টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। কেওয়া গ্রামের মেলার ডাব্বো স্টলের সামনে বিষণœ তরুণের দেখা মেলে। প্রায় ২০ মিনিট তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার বাড়ি পাশের উজিলাব গ্রামে। শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্র তিনি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি জানান, নতুন প্যান্ট কেনার কথা বলে তার বাবার কাছ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে গত বুধবার জুয়া খেলে সব টাকা খোয়ান। পরদিন মিথ্যা বলে তার মায়ের কাছ থেকেও ৭০০ টাকা নিয়ে জুয়া খেলে তাও হারান। পরে গত শুক্রবার আলমারি থেকে মায়ের রাখা ৩ হাজার ৫০০ টাকা চুরি করে জুয়া খেলে হেরে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। রাত কাটিয়েছেন সহপাঠীর বাসায়। ওই তরুণ আরও জানান, সহপাঠীর কাছ থেকে ১০০ টাকা ধার করে তাও খুইয়ে হতাশ হয়ে খেলা দেখছিলেন। তিনি আশঙ্কা করছেন, বাড়ি ফিরলে তার মা গালমন্দ করবেন। এরপরও তিনি রাতেই বাড়ি ফিরবেন। তবে সহপাঠীদের সহযোগিতায় একটি নাটক সাজিয়ে মা-বাবার কাছে ‘নির্দোষ’ থাকার উপায় খুঁজছেন। শ্রীপুর পৌর এলাকার এক যুবক আবুল হোসেন মেলা শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৪ লাখ টাকা জুয়া খেলে হেরেছে। একই এলাকার ২নং ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, ব্যবসায়ী রুমান প্রতি রাতেই জুয়া ও নগ্ন নৃত্যের টানে মেলায় গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরেছেন। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে হোতাপাড়া নামক স্থানে চলা একই ধরনের মেলায় ঘুরে দেখা গেল, মাত্র ১০ থেকে ১২ বছর বয়সের কয়েকজন শিশুও বিভিন্ন স্টলে জুয়া খেলছে। শিশুদের সঙ্গে কথার বলার চেষ্টাকালে টের পেয়ে মেলা পরিচালক, স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীরা তাদের সরিয়ে দেয়। কয়েকজন ভাসমান দোকানদার জানান, রাত গভীর হলে পাল্টে যায় মেলার চিত্র। রাত ১২টার দিকে শুরু হয় র‌্যাফেল ড্রর পুরস্কার ঘোষণা। এরপর চলে হাউজি খেলা। হাউজির পরই চলে একের পর এক সম্পূর্ণ উলঙ্গ নৃত্য। এসব অনৈতিক কর্মকা-ের প্রতিবাদে শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আলহাজ আনিছুর রহমানের উপস্থিতিতে দুই-তিনবার মানববন্ধন মিছিল করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শুধু তাই নয়, এসব অনৈতিক কর্মকা- বন্ধের জন্য মাওনা, কেওয়া, রাজেন্দ্রপুর, জৈনা বাজারসহ উপজেলা চত্বরেও একাধিকবার স্থানীয় আমজনতা ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা করেন। এতেও প্রশাসনের কোনো টনক নড়েনি। গত ৭ মার্চ শ্রীপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুম রেজা ও গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে এক প্লাটুন বিজিবি ও আনসার সদস্যের সমন্বয়ে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শ্রীপুর পৌর এলাকার ২নং সিএন্ডবি বাজার, মাওনা উত্তর পাড়া, ফরিদপুর গ্রামের মোল্লা পাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে জুয়ার প্যান্ডেল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে মালামাল ট্রাকযোগে শ্রীপুর উপজেলায় ত্রাণ ভা-ারে নিয়ে আসেন। জানা গেছে, মেলা ভাঙচুরের দিনই রাতে কেওয়া বাজার, ফরিদপুর গ্রামের জনৈক আলাল উদ্দিন সরকারের জায়গায় ও মাওনা উত্তরপাড়ায় পুনরায় দাপটের সঙ্গে স্টল নির্মাণ করে চালানো হচ্ছে হাউজি, জুয়া ও উলঙ্গ নৃত্যের ব্যবসা। গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মাহমুদ হাসান জানান, কোন এলাকায় অসামাজিক কার্যকলাপ বা মেলার নামে জুয়া হয়ে থাকলে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
শ্রীপুর মডেল থানার কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘শ্রীপুরে কীভাবে ওই মেলাগুলো চলছে আমার জানা নেই। মেলার আয়োজকদেরও আমি চিনি না। শ্রীপুর মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেন, ‘গত শনিবার গভীর রাতে পুলিশ গিয়ে ওই মেলা বন্ধ করে দিয়েছে। এরপরও মেলা চালালে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন