মা কর্তৃক বনশ্রীতে দুই ভাইবোনের হত্যার ঘটনা মানুষের মনোজগতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মায়ের কোল সন্তানের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ অথচ সেই মা কর্তৃক সন্তার হত্যার বিষয়টি এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠছে তাহলে সন্তানের নিকট নিরাপদ স্থান কোনটি।
প্রকৃত পক্ষে শিশু আল্লাহর দান। ফুলের মতো নির্মল। নির্মোহ ও নিরপরাধ। ফুল ও শিশুকে যারা ভালোবাসে না তারা অমানুষ অথবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। নিজের শিশু সন্তান তো বটেই, অন্যের এমনকি জীবনের দুশমন হলেও তার শিশুসন্তানের প্রতি কেউ প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে না, যার সামান্যতম মানবতাবোধ থাকে। মানুষ তো বটে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পশুপাখিও নিজের সন্তানকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষার চেষ্টা করে। এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। মায়া, মমতা, সহানুভূতি এসব গুণ মহান আল্লাহ্ই দিয়েছেন তার বান্দাদের। তবে নানা কারণে প্রকৃতিতে যেমন বিপর্যয় দেখা দেয়, তেমনই মানুষের চিন্তা-চেতনাতেও বৈকল্য ঘটে। বিপর্যয় দেখা দেয়।
বিশেষত মানসিকভাবে কেউ রোগাক্রান্ত হলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। জীবন সম্পর্কে হতাশা, উপার্জনহীনতা, আপনজনের সঙ্গে বিরোধ, সামাজিকভাবে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকলে অনেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজেকে সামলাতে পারে না। তখন অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আপনজন, স্ত্রী-পরিজন, এমনকি প্রিয় সন্তানকেও হত্যা করতে দ্বিধা করে না- এমনই নিষ্ঠুর ও নির্মম কর্মকা- আমাদের সমাজে ঘটছে প্রায়শ। চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহেও শিশু-কিশোরদের ওপর এক শ্রেণীর বিবেকহীন মানুষ অত্যাচার করছে। সামাজিক অস্থিরতা ও অভাব-অনটনের কারণে শিশু-কিশোরদের কেউ কেউ ছিঁচকে চুরির মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই বলে সন্দেহ হওয়া মাত্রই বিচার-বিবেচনা না করে কোন শিশু-কিশোরের ওপর চড়াও হয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার মতো ঘটনাকে স্বাভাবিক বলা যাবে না কোন বিচারেই।
সিলেটের শিশু রাজনকে চোর সন্দেহে ধরে নির্মমভাবে মারধর করতে করতে মেরে ফেলে কয়েকজন নরপশু। খুলনার শিশু রাজীবকে নিজের গ্যারেজে কাজ না করবার অপরাধে গ্যারেজ মালিক ও তার লোকেরা পায়ুপথে কম্প্রেসার দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে মেরে ফেলে অভিনব কায়দায়। শহরের বাসাবাড়িতে কাজের শিশু-কিশোরদের ওপর সামান্য কারণে চালানো হয় বর্বর অত্যাচার। কোনও কোনও মেয়ে শিশুর ওপর চলে যৌন নির্যাতন। এমনকি অনেককে বাবা-মা বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে দেয়া হয় না দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। অথচ শিশু-কিশোরদের দিয়ে কাজ করানোই বেআইনি। কিন্তু আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু-কিশোররা বাসাবাড়ি, কলকারখানা, গ্যারেজ প্রভৃতিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। এদের স্বাভাবিক জীবন যেমন ব্যাহত হয়, তেমনই অসুখ-বিসুখে সুচিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাও থাকে না। এমনকি অনেককে পর্যাপ্ত খাবারও দেয়া হয় না বাসাবাড়ি, কলকারখানা বা গ্যারেজে।
অথচ সকাল থেকে গভীর রাত অবধি তাদের খাটিয়ে নেয়া হয় একনাগাড়ে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিশু-কিশোর শ্রমিকদের নিয়ে প্রায়শ কথা ওঠে। সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় এদের পক্ষে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয় না। শিশু-কিশোরদের অধিকার নিয়ে জাতিসংঘেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো স্বাক্ষরও করেছে। এরপরও শিশু-কিশোরদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমনটি বলা মুশকিল। শিশু-কিশোরদের কল্যাণে জাতিসংঘের গৃহীত সিদ্ধান্তের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি। অপরদিকে এক শ্রেণীর মানসিক বিকারগ্রস্ত মা-বাবা অথবা আত্মীয়স্বজন দ্বারা যাতে নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে মারা না যায় সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করা দরকার।
ঢাকার বনশ্রীতে একজন মা কর্তৃক দুই শিশু হত্যার যে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে তা শুধু ভয়াবহই নয়, অমানবিক ও ব্যতিক্রমও। এর প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করে শিশুসন্তান হত্যার এমন নিষ্ঠুর ঘটনা যাতে না ঘটে তার উপায় বের করা জরুরি। এ ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোদৈহিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের যতœবান হতে হবে।
শিশুরা আমাদের স্বপ্ন। আশা-আকাক্সক্ষা। দেশ, জাতি ও সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। বিকারগ্রস্ত মায়ের হাতে নিহত শিশু দুটি যে, এদেশ ও জাতির জন্য বড় কোনও অবদান রাখতে সক্ষম হতো না- তা কে বলবে? নিষ্ঠুরতার শিকার নয়, শিশুদের বিকশিত হতে দিতে হবে। সুন্দর স্বপ্ন দেখাতে সহায়তা করতে হবে আমাদেরই।
ষ লেখক : চেয়ারম্যান, জয়যাত্রা ফাউেন্ডশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন