শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্য, সমঝোতা ও পররাষ্ট্রনীতির পুর্নগঠন জরুরী

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদিরা মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার অনেকটাই ব্যর্থ হতে চলেছে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে রক্তাক্ত যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পালিয়ে যাওয়া কয়েক লাখ মানুষের আশ্রয়ের চেষ্টাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচে বড় মাইগ্র্যান্ট বা রিফিউজি ক্রাইসিস বলে অভিহিত করেছেন ইউরোপীয় নেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপ এশিয়া ও আফ্রিকার অর্ধশতাধিক দেশ মিলে প্রায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে আশ্রয় প্রার্থী কয়েক লাখ শরনার্থী সমস্যার কোন গ্রহনযোগ্য সমাধানে পৌছতে ব্যর্থ হলেও গত একমাসে বাংলাদেশ প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক দফতর থেকে বলা হয়েছে চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরনার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ অতিক্রম করতে পারে। জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে ন্যুজ হয়েও বাংলাদেশ সরকার ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরনার্থীর আশ্রয়, ভরণ পোষন ও নিরাপত্তার দায়-দায়িত্ব গ্রহন করেছে। বার্মার রাখাইন স্টেটে সরকারী বাহিনী ও বৌদ্ধ চরমপন্থীদের নৃশংসতা, গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলীকরণ ও বিতাড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে এক নজিরবিহীন সামাজিক রাজনৈতিক ঐক্য তৈরী হয়েছে। তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মত মুসলিম দেশ ছাড়াও বিশ্বের বেশকিছু রাষ্ট্রের সরকার এবং জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস মিয়ানমার সরকারের এথনিক ক্লিনজিং তৎপরতার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহন করেছেন। তবে ভারত ও চীনের মত আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভ‚মিকা সারাবিশ্বের মানবতাবাদি মানুষের কাছে চরম হতাশাজনক বার্তা বহন করছে। তারা যেন পাল্লা দিয়ে মিয়ানমার সরকারের মানবতা বিরোধি কর্মকান্ডের পক্ষে মিনমিনে সুরে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় ও সহায়তার প্রশ্নে বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের সামাজিক ঐক্য গড়ে উঠলেও দেশের সরকার এ বিষয়টিকে খুব দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশ্বসভায় আলোচিত মানবতা বিরোধি রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটনের পরও যেখানে মিয়ানমার সরকার পরস্পর বৈরী দুই আঞ্চলিক পরাশক্তি চীন ও ভারতকে নিজেদের পক্ষে রাখতে সক্ষম হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ক‚টনৈতিক ব্যর্থতার প্রমান পাওয়া যায়। সরকার একদিকে দেশে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য গড়ে তোলতে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে ক‚টনৈতিক ব্যর্থতার কারণে এমন একটি ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবেও ব্যাপক জনমত গড়ে উঠার পরও বাংলাদেশ কার্যত বন্ধুহীন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রেখেছেন বটে, দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর এসব যৌক্তিক প্রস্তাবও হালে পানি পাবে কিনা এ ব্যাপারে সংশয় রয়েই যাচ্ছে। নিউ ইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে(২০১৫-১৬) দেশে একের পরএক জঙ্গি হামলার ঘটনা একটি জাতীয় সংকট হিসেবে বিবেচিত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার বাস্তব সম্ভাবনাকে হীন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নাকচ করা হয়েছে। এর ফলে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা বা সরকারী বাহিনী সমুহের জঙ্গিবিরোধি অভিযানগুলো সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এখন রোহিঙ্গা সংকটকে সামনে রেখেও সরকার এবং বিরোধিদলকে ব্লেইম গেমে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থানের জন্য এই রাজনৈতিক অনৈক্যকে দায়ী করা যায়।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালমাপুরে অনুৃষ্ঠিত পিপিটি(পার্মানেন্ট পিপল্স ট্রাইবুনাল) বা আন্তর্জাতিক গণআদালত ৫দিন ব্যাপী সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে সাক্ষি সাবুদ গ্রহন করে যে রায় দিয়েছে তাতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও ডি-ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চি এবং সেনা প্রধান মিন অং সহ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধ নেতাকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অর্ধশত বছরের বেশী সময় ধরে চলা বার্মার সামরিক জান্তা সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আরাকানের ভ‚মিপুত্র রোহিঙ্গা নাগরিকদের সে দেশের এথনিক ডেমোগ্রাফি থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত চালিয়ে আসছে। সত্তুরের দশকে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার পর ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে ২লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিককে আরাকানে ফেরত নিতে বাধ্য করেছিলেন। তবে ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর মিয়ানমার সরকার সাংবিধানিকভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য বার্মিজ নাগরিকত্বের অধিকার খারিজ করে দেয়। ২০১২ সালের বার্মিজ আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের অন্তভর্‚ক্ত না করে তাদেরকে রাষ্ট্রহীন বাঙ্গালী মুসলমান বলে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে ধরে নিয়ে নাৎসী বাহিনীর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অনুরূপ আইডিপি ক্যাম্পে আটক রাখা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে দেড়লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বন্দি আছে বলে জানা যায়। গত বছর মিয়ানমারের সীমান্ত চৌকিতে কথিত সন্ত্রাসী হামলায় কয়েকজন বর্ডার পুলিশ হতাহতের ঘটনাকে পুঁজি করে সেখানে একটি বড় আকারের গণহত্যা ও রোহিঙ্গা বিতাড়নের সামরিক অভিযান শুরু করলে ব্যাপক আন্তজার্তিক সমালোচনা ও চাপের মুখে তা স্থগিত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাখাইনে মানবেতরভাবে জীবনযাপনকারি রোহিঙ্গারা সেখানে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটা আঁকড়ে থাকলে তো আর এথনিক ক্লিনজিংয়ের লক্ষ্য অর্জিত হবেনা, অতএব রোহিঙ্গা নির্মূলের নতুন একটি সুযোগ হিসেবে ধরা দেয় গত ২৫ আগস্টের কথিত আরসা জঙ্গি হামলার ঘটনা। এর একদিন আগেই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রোহিঙ্গা বিষয়ক তদন্ত কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। সে রিপোর্টে রোহিঙ্গা সমস্যা ও সামরিক বাহিনীর এথনিক ক্লিনজিং সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্যপ্রমানসহ সারাবিশ্বের কাছে গ্রহনযোগ্য সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব এবং পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির একটি নীতিগত ও ক‚টনৈতিক প্রক্রিয়া যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল ঠিক তখনি আরসা’ কথিত হামলা ঠিক কি কারনে কার স্বার্থে করা হয়েছিল তা নিয়ে কিছুটা প্রশ্নবোধক ধোঁয়াসা তৈরী হয়েছে। এই ঘটনার পর থেকেই হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীকে সংঘবদ্ধভাবে গণধর্ষন করা হয়, লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার পর জনশুন্য শত শত রোহিঙ্গা গ্রাম গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় যৌথভাবে বৌদ্ধ সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনী। এরপরও যে সব গ্রামে রোহিঙ্গারা অবস্থান বা আত্মগোপন করছিল সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা মাইকিং করে তাদেরকে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেয়। আর সীমান্তে স্থলমাইন পুঁতে রাখে। প্রাণভয়ে, গণধর্ষনের ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময়ে সীমান্তে মাইন বিষ্ফোরণ ও বার্মিজ সীমান্তরক্ষিদের গুলিতে আহত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশীরভাগ বাংলাদেশে পৌছতে পারলেও অনেকের ভাগ্যেই জুটছে সলিল সমাধি। সে সব হতভাগ্য রোহিঙ্গা যুবক, শিশু নারীদের গলিত অর্ধগলিত লাশ প্রায় প্রতিদিনই নাফ নদীর এপারে ভেসে আসতে দেখা যাচ্ছে।
রোগিঙ্গা মুসলমানদের উপর বার্মিজ গণহত্যার ঘটনা এবং বাংলাদেশে আশ্রিত ১০ লাখ শরনার্থীকে রাখাইনে পুনর্বাসন ও পূর্ণ নাগরিকত্বের দাবী বাস্তবায়ন এখন বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই চিরায়ত ও মানবিক দাবী অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। রোহিঙ্গারা যদি আরাকানের আদিবাসি না হন, তবে আরাকানও বার্মার অংশ নয়। আরাকান বার্মার অংশ হলে রোহিঙ্গারাও স্বাভাবিকভাবেই বার্মার নাগরিক। কারণ বার্মা বা মিয়ানমার নামক রাষ্ট্র ও তার সংবিধান রচিত হওয়ার বহু আগে থেকেই এরা আরাকানে বসরবাস করে আসছে। ১৭৮৪ সালে প্রথম আরাকান বার্মিজদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সাড়ে তিনহাজার বছর ধরে আরাকান একটি স্বাধীণ রাষ্ট্র হিসেবে টিকেছিল। বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হওয়ার সিকি শতাব্দীর মধ্যে আরাকান বার্মিজদের দখলে চলে যায়। বার্মিজ রাজা বোধপায়া আরাকান দখলের সময়ই বাংলার পাবর্ত্য অঞ্চলে প্রথম আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলমান, রাখাইন মগ, চাকমাসহ উপজাতীয়দের আগমন ঘটে। অর্থাৎ বর্তমানে আমাদের দেশে একশ্রেনীর বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত সুশীল সমাজের একটি অংশ যাদেরকে আদিবাসি বলে প্রচারনা চালাচ্ছে, তারা আরাকানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আড়াইশ বছর আগে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। আরাকান বার্মিজ দখলে যাওয়ার প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর আগে আরাকানের ক্ষমতাচ্যুত রাজা নরমিখলাকে সিংহাসন ফিরে পেতে গৌড় বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ প্রত্যক্ষ সামরিক সহযোগিতা করেন। বাংলার সুলতানের এই সহযোগিতায় সিংহাসন পুনরুদ্ধারের পর রাজা নরমিখলা ও তার (ম্রাউক রাজবংশ) বংশধররা বাংলার সুলতানদের অনুকরণে রাজকার্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। অবশ্য আরাকানে ইসলামের আগমনকাল খৃষ্টীয় অষ্টম শতক বা তার কিছু আগে আরব নৌ-বণিকদের মাধ্যমে।
একমাসের বেশী সময় ধরে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজারের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত রোহিঙ্গাদের নির্যাতিত হওয়া এবং স্বজন হারানোর কাহিনী সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে আবেগাপ্লুত করেছে। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র নায়কদের অনেকেই তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের পাশাপাশি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। বাংলাদেশের হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ভাগ্যবিড়ম্বিত অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়িয়েছেন। রোহিঙ্গারা আমাদের পাশের বাড়ির নিকটাত্মীয়। বিবেকের তাড়নায় গত বৃহষ্পতিবার আমরা কয়েক বন্ধু মিলে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম কক্সবাজারের উখিয়া, বালুখালি, কুতুপালং ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। যৎসামান্য ব্যক্তিগত অনুদান এবং নারায়নগঞ্জের বক্তাবলী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের স্থানীয় ও প্রবাসি সদস্যবৃন্দের সংগৃহিত কয়েকলাখ টাকা ও ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে শুক্রবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে দেখার এই অভিজ্ঞতা তুলনাহীন। স্বজন ও সহায় সম্পদ হারানো বিধ্বস্ত মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকানোর বা প্রশ্ন করার সাহস যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। ওদের এই দুর্দশার জন্য নিজেকে এক ধরনের অপরাধি মনে হয়েছে আমার। সাতশ বছর আগে সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ’ যেমন নরমিখলাকে সহযোগিতা করে সে আত্মীয়তার প্রমান রেখেছিলেন, এখন বাংলাদেশের জনগন এবং সরকার সে ঐতিহাসিক আত্মীয়তার ধারবাহিক প্রমান রেখে চলেছে। সবর্স্ব হারানো রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশকে তাদের নিরাপদ আশ্রয় মনে করলেও তারা তাদের পিতৃপুরুষের ভিটায় প্রত্যাবর্তন করতে চায়। তবে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার সাক্ষি এই ট্রমাটিক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত মানুষগুলো, বিশেষত শিশুরা রাখাইনে তাদের জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে ফেরত যেতে ইচ্ছুক নয়। চতুর্দশ শতকে বার্মিজদের তাড়া খেয়ে বাংলায় আশ্রয় নেয়া রাজা নরমিখলা যেমন গৌড়ের সুলতানের সহযোগিতায় ২৪ বছর পর শাসনক্ষমতা ফিরে পেয়েছিল, আমাদের সরকার এবং সেনাবাহিনীকে ইতিহাসের সেই অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন জাতিসংঘসহ সারাবিশ্বের মানুষ আমাদের পাশে দাড়ালেও আমাদের সরকার যেন ইতিহাসের উজ্জ্বল নায়কদের মত সপ্রতিভ ও সাহসী উদ্যোগ নিতে পারছেনা। জনগনের ইচ্ছার প্রতিফলন ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একেকটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে ও টিকে থাকে। জনগনের ইচ্ছা ও স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়ে ভিন্ন স্বার্থের সাথে আপোস করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র টিকতে পারেনা। রোহিঙ্গা শরনার্থী সংকট ও বার্মিজ সেনাবাহিনীর গণহত্যার ঘটনা বাংলাদেশের সরকার, সকল রাজনৈতিক শক্তি এবং সেনাবাহিনীর জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। মুক্তিকামী লাখো মানুষের প্রানের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে মগ বার্মিজরা খাটো করে দেখবে, তাদের বর্বর নীতির সাথে আপোস বা নিরবতা এ দেশের মানুষ মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সাম্প্রতিক সময়েও আমাদের সীমান্তরক্ষি বাহিনী বার্মিজ সীমান্তরক্ষিদের ঔদ্ধত্ব ও বর্বরতার বিরুদ্ধে পাল্ট্রা আক্রমনে পর্যুদস্তু ও পরাস্ত করার গৌরবময় ইতিহাস আছে। মাত্রা দেড় দশক আগে নাফ নদীর মোহনায় বার্মিজ সীমান্তরক্ষিদের আগ্রাসন রুখে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক আ ল ম ফজলুর রহমান। সেই যুদ্ধে ৬০০ সৈন্য হারিয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে শান্তি ও সন্ধি স্থাপনে বাধ্য হয়েছিল নাসাকা বাহিনী। বড়াইবাড়ির যুদ্ধে ভারতীয় সীমান্তরক্ষি বাহিনীকেও একই ধরনের পরিনতি ভোগ করতে হয়েছিল। বাংলাদেশের সেনা ও সীমান্তরক্ষি বাহিনীর ইতিহাসে ব্যর্থতা বা পরাজয়ের কোন নজির নেই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের শান্তিরক্ষি মিশনের সদস্য হিসেবে বিশ্বের যুদ্ধবিদ্ধস্ত অঞ্চলে শান্তি স্থাপনে বাংলাদেশি বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা প্রতিবেশী যে কোন দেশের জন্য ঈর্ষনীয়। অনেক দেরিতে হলেও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পগুলোতে ত্রান ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রণের পর পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জাতিগত অবস্থান এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ ও নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সাহসী সুদক্ষ কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া সাফল্যের সাথে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অসম্ভব। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আমাদের সরকারের ভ‚মিকা এখনো অস্বচ্ছ ও ধোঁয়াসাচ্ছন্ন। বিশ্ব সম্প্রদায়ের অনুরোধ ও মানবিক দাবী উপেক্ষা করেই গণহত্যার মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করার অনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছিল সরকার। সরকারের পরিবর্তিত নীতিগত সিদ্ধান্ত দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হলেও রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী ও গ্রহনযোগ্য সমাধানের প্রশ্নে সরকারের অবস্থান এখনো নড়বড়ে। এটি একটি জাতীয় এবং আঞ্চলিক সংকট। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে যে ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ক‚টনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন তা আদৌ দেখা যাচ্ছেনা। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। দেশের অর্ধেকের বেশী মানুষকে আস্থাহীন ও বৈরীতার মুখে রেখে কোন জাতীয় ঐক্য হতে পারেনা। আর জাতীয় ঐক্য ছাড়া বিভাজিত জনগোষ্ঠি নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যে কোন রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে অসম্ভব। রোহিঙ্গা সংকট এখন আঞ্চলিকতার গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরী করেছে। এ কারণেই এই মূহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী আলোচিত বিষয় এটি। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে মিয়ানমারের অং সান সু চি’র সরকারকে প্রকারান্তরে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার হিসেবে অভিহিত করেছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘন, কোফি আনান কমিশনের রিপোর্ট ও সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণও দিক নির্দেশনা রয়েছে এই নিবন্ধে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রফেসর ড. তাজ হাশমি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত কেভিন রাডের এই নিবন্ধটি নিজের ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার করে যে মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন তা’ প্রণিধানযোগ্য। দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের উপর ডক্টরেট ডিগ্রীধারি মি. তাজ হাশমির মতে, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশকে এখন তার বিদেশ নীতিকে নিজেদের স্বার্থে নিজেদের মত করে ঢেলে সাজাতে হবে। যে নীতি দিল্লী থেকে বিদেশিদের স্বার্থে পরিচালিত হয়ে আসছে বলে কথিত আছে তা’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও সংকটের মুখে দুই বৃহদ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের ন্যাক্কারজনক ভ‚মিকা আমরা দেখেছি। দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দি দেশই মিয়ানমারের এথনিক ক্লিনজিংয়ের ভ‚মিকাকে সমর্থন জানিয়েছে। তবে এহেন বাস্তবতায়ও বাংলাদেশ বন্ধুহীন নয়। বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, ইরান, সউদিআরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাড়িয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য কোন আপসকামী বা উপেক্ষনীয় বিষয় নয়। এই সংকটে যখন চীন-ভারত এক হয়ে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাড়াচ্ছে তখন বাংলাদেশকে অবশ্যই দ্রুত সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আরাকানের মুসলমানরা যদি বার্মিজ নাগরিক হওয়ার যোগ্য না হয়, তাহলে বার্মিজ শাসকরা আরাকান শাসনের অধিকার রাখেনা। বিশ্বের কাছে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ বাংলাদেশকেই নিতে হবে। এখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন