শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গ-২

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গত সপ্তাহের কলামে আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আইটেমের একটি পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরেছি, যথা নির্বাচনের কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি। গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আইটেমের আরেকটির অংশ তুলে ধরেছিলাম। আজকের সেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আইটেমটির অসম্পূর্ণ আলোচনাকে সম্পন্ন করবো এবং তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ আইটেমটি পূর্ণভাবে আলোচনা করবো। অসম্পূর্ণ আলোচনাটি ছিল সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে। আমরা স্ট্রাইকিং ফোর্স-এর তত্ত¡টির বর্তমান অকার্যকারিতা আলোচনা করেছি। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যে রাজনীতিকরণ হয়েছে (আংশিকভাবে হলেও) তার অপকারিতা আলোচনা করেছি, মাস্তান এবং ক্যাডার নামক রাজনৈতিক-সৃষ্টিকূলের সা¤প্রতিকালের গুরুত্ব ও দৌরাত্ম্য আলোচনা করেছি, ভোটারগণের সামনে কী কী অসুবিধা বা ভোটারগণের জন্য কোথায় কোথায় নিরাপত্তা দিতে হবে সেটাও আলোচনা করেছি। বাকি আলোচনা আজকের কলামে। 

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হবে, আমাদের লক্ষ্য হতে হবে, ভোটের অন্তত পনেরো বা দশ বা আটদিন আগে থেকেই জনপদে-জনপদে, গ্রামে-গ্রামে, থানায়-থানায়, মহল্লায়-মহল্লায় যেন মাস্তানমুক্ত ও ক্যাডারমুক্ত পরিবেশ বিরাজ করে। মানুষের মনে যেন স্বস্তি থাকে। মানুষ যেন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে। এই কাজ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের হাতে এমন কোনো পন্থা বা মাধ্যম বা অস্ত্র নেই, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যতীত। কিন্তু আমরা নির্দ্বিধায় বলতে চাই, মনমানসিকতার দিক থেকে অনেক অংশেই পলিটিসাইজড, দায়িত্ব পালনের দিক থেকে ওভার স্ট্রেচ্ড এবং ক্লান্ত বিদ্যমান পুলিশ ও র‌্যাব বাহিনী দিয়ে এই বিশাল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এর জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা অপরিহার্য।
আমরা কঠোর এবং কঠিন একটি প্রশ্ন উপস্থাপন করছি। প্রশ্নটি হলো, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে কার কী কী ক্ষতি আছে সেটা বিশ্লেষণ করা হোক। সেটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে কোটারি স্বার্থ রক্ষাকারীগণই সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিপক্ষে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন সাফল্যের সঙ্গে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করুক, এটা আমাদের দাবি এবং আমাদের প্রত্যাশা। নির্বাচন কমিশনকেও চিন্তা করতে হবে ঐরূপ সাফল্য অর্জনে কী কী বাধা থাকতে পারে। যদি নির্বাচন কমিশন সেইরূপ বিশ্লেষণ করে তাহলে আমাদের বিশ্বাস যে, নির্বাচন কমিশনও একমত হবে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে। সেনাবাহিনী জনগণের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সেনাবাহিনী। দেশ ও জাতির যে কোনো বিপদ-আপদ-কষ্টে পাশে দাঁড়িয়েছে এই সেনাবাহিনী। দেশের বাইরেও দাঁড়িয়েছে, দেশের অভ্যন্তরেও পাশে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ পাশে দাঁড়ালো রোহিঙ্গাদের ত্রাণ তৎপরতায়। জনগণের ভাগ্যকে প্রভাবান্বিত করে, রাষ্ট্রের ভাগ্যকে প্রভাবান্বিত করে, এমন ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ হলো পার্লামেন্ট নির্বাচন। এই কর্মযজ্ঞে, জনগণের কল্যাণে, কেন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা যাবে না, এটা আমাদের নিকট বোধগম্য নয়। পত্রিকার ভাষ্য মোতাবেক, নির্বাচন কমিশনের সম্মানিত যে কেউ বলেছেন যে, সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কি হবে না এটা কারো চাওয়ার উপর নির্ভর করে না। আমরা যেহেতু স্টেইকহোল্ডার তাই আমাদের দায়িত্ব জনগণের প্রয়োজনে চাওয়া। চাওয়া পূরণ করবে কি করবে না এটা নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের উপর। পূরণ করলেও নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে হবে, পূরণ না করলেও নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি আজকের কলামে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের রায়ের ১১৭৮ ও ১১৭৯ নম্বর অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করছি এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মহোদয়ের রায়ের ১৯৩ অনুচ্ছেদের প্রথম অর্ধেকের বাংলা ভাবার্থ তুলে ধরছি। খায়রুল হক মহোদয়ের মূল রায়ের অনুচ্ছেদগুলো বাংলা ভাষায় ছিল তাই উদ্ধৃত করা সহজ হয়েছে; সিনহা মহোদয়ের মূল রায়ের অনুচ্ছেদগুলো ইংরেজিতে ছিল তাই ভাবার্থ উদ্ধৃত করেছি (অনুবাদ নয়)।
বিচারপতি খায়রুল হক: অনুচ্ছেদ-১১৭৮ উদ্ধৃত। নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাধীন করিতে হইবে। ইহাকে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে। লোকবল নিয়োগে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করা যাইবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠান করিতে সর্বপ্রকার প্রয়োজন নিরসনকল্পে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ লইবেন। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সকল প্রকার সহায়তা সরকারের নির্বাহী বিভাগ তড়িৎ প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবেন, অন্যথায় তাহারা সংবিধান ভঙ্গ করিবার দায়ে দায়ী হইবেন। এই ব্যাপারে কোনো তরফে কোনো গাফিলতি দেখা দিলে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করিবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তড়িৎ গ্রহণ করিবেন, অন্যথায় তাহারাও সংবিধান ভঙ্গের দায়ে দায়ী হইবেন। সাধারণ নির্বাচনের তপসীল ঘোষণার তারিখ হইতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা (ডিসক্রিশন) অনুসারে, যাহারা এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সেই সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে। নির্বাচন কমিশনারগণ অন্তমুর্খী (ইনট্রোভার্ট) হইবেন না। যতদূর সম্ভব তাঁহাদের দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা (ট্রান্সপারেন্সি) বজায় রাখিবেন। সতত মনে রাখিবেন যে জনগণের নিকটেই তাঁহাদের জবাবদিহিতা (একাউনটেবিলিটি)। তাঁহারা সকলে জনগণের সেবক মাত্র। তাঁহারা কি কাজ করিতেছেন তাহাও জনগণের জানিবার অধিকার রহিয়াছে, তাঁহারা কি কাজ করিতে পারিতেছেন না এবং কেন পারিতেছেন না তাহাও জানিবার অধিকার জনগণের রহিয়াছে। নির্বাচনী আইন বা বিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনগত পদক্ষেপ তড়িৎ লইতে হইবে। এ ব্যাপারে কোনোরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন চলিবে না। শৈথিল্য প্রদর্শন করিলে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে আইন অমান্যকারী হইবেন।
বিচারপতি খায়রুল হক: অনুচ্ছেদ-১১৭৯ উদ্ধৃত। শুধু তাহাই নহে, সংবাদ মাধ্যম ও আপামর জনসাধারণ তাহাদের অধিকার সম্বন্ধে শুধু ওয়াকিবহাল নয়, সোচ্চার হইতে হইবে। তাহা হইলেই শুধু নির্বাচন কমিশন ও সরকার-এর জবাবদিহিতা নিশ্চিত হইবে এবং তাহারা সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকিবেন। বিচারপতি সিনহার রায়ের ১৯২ অনুচ্ছেদের ভাবার্থ লিখছি। খায়রুল হক মহোদয়ের নেতৃত্বে যে রায় দেওয়া হয়েছিল সেই রায়ে, আশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে শক্তিশালী করবে যে, ঐ নির্বাচন কমিশন যেন ফ্রি এন্ড ফেয়ার তথা স্বাধীন ও উন্মুক্ত বা পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারে। সেই রায়ে আশা করা হয়েছিল যে, সরকারের হস্তক্ষেপ ব্যতীতই নির্বাচন কমিশনে শূন্য পদগুলো পূরণ হবে। এস কে সিনহা মহোদয়ের নেতৃত্বে প্রদত্ত রায়ে মন্তব্য হচ্ছে, ২০১১ বা ২০১২ সালের পরবর্তী বাংলাদেশের কোনো সরকারই উপরে ব্যক্ত আশাগুলো পূরণের লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সিনহা মহোদয়ের নেতৃত্বে প্রদত্ত রায়ে মন্তব্য হচ্ছে যে, বিরোধী দলও এই বিষয়টি পার্লামেন্টে বা অন্য কোনো ফোরামে উপস্থাপন করেনি। সিনহা মহোদয়ের নেতৃত্বে প্রকাশিত রায়ে মন্তব্য হচ্ছে, সরকার বা বিরোধী দল কর্তৃক এইরূপ নিষ্ক্রিয়তা বা নিশ্চুপতার ফল হলো এই যে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। অতঃপর ১৯৩ অনুচ্ছেদে দীর্ঘ মন্তব্য আছে; যেটি এই কলামের পরের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করছি।
বিচারপতি সিনহার রায়ের ১৯৩ অনুচ্ছেদের ভাবার্থ। জাতীয় সংসদের নির্বাচন যদি স্বাধীনভাবে, পক্ষপাতহীনভাবে এবং কোনো প্রকারের হস্তক্ষেপ ব্যতীত অনুষ্ঠান করা না যায় বা অনুষ্ঠান করা না হয়, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যতীত, গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠিত করা বা গঠন করা সম্ভব নয়। ফলে আমাদের দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং আমাদের দেশের পার্লামেন্ট এখনও শৈশবেই রয়ে গেল। জনগণ এ দুইটি প্রতিষ্ঠানের উপরে বিশ্বাস বা আস্থা স্থাপন করতে পারছেন না। যদি এ দুইটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিকরণের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও সম্মান অর্জন করা না হয় তাহলে কোনো বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যতীত, জ্ঞানী বা মেধাবী রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ পার্লামেন্ট-এর সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না এবং এ কারণে পার্লামেন্টের প্রাতিষ্ঠানিকরণ প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়। পার্লামেন্ট যদি যথেষ্ট পরিপক্ব না হয়, তাহলে ঐ অপরিপক্ব পার্লামেন্টের হাতে বিচারকগণের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া বিচার বিভাগের আত্মহত্যার শামিল। এছাড়াও, রাজনৈতিক দলগুলোকে, জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে তাদের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সচেতন ও সাবধান হতে হবে। এই রায়ের উপরের অনুচ্ছেদগুলোতে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে বা আলোচনা করা হয়েছে, পরিপক্ব গণতন্ত্রেও যেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে এবং যেখানে পার্লামেন্টের সদস্যগণ উন্মুক্ত গ্রহণযোগ্যভাবে নির্বাচিত হন, সেখানেও ঐ ধরনের পার্লামেন্টগুলো বিচারপতিগণকে অপসরণের কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারেনি।
কেন রায় থেকে উদ্ধৃত করলাম সেটা বলি। রায় থেকে উদ্ধৃত করার পেছনে কারণ হলো, আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনটি, বাংলাদেশে (বর্তমানে বাধাপ্রাপ্ত) গণতান্ত্রিক রাজনীতি পুনরুদ্ধার করার জন্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মনে স্বস্তি আনার জন্য, জনগণকে নির্বাচনমুখী করার জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন, সে পরিবেশ ইতিবাচকভাবে সৃষ্টিতে অনেকগুলো উপাত্তা কাজ করে। আমরা সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীগণ বলা এক জিনিস, আর অসাধারণ ব্যক্তিত্বগণ বলা আরেক জিনিস। সম্মানিত পাঠক, আপনারা খায়রুল হক মহোদয়ের রায় এবং সিনহা মহোদয়ের রায় থেকে উদ্ধৃত করা অনুচ্ছেদগুলো পড়লে, নিজেরাই বুঝতে পারবেন যে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিগণও নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে কী কী মন্তব্য করেছেন। পাঠক স¤প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের কষ্ট কমানোর জন্য আমি এই কাজটি করে দিলাম। এখন আমি, নির্বাচন কমিশনে যে বক্তব্য তুলে ধরেছিলাম তার মধ্য থেকে অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক এ কলামের পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি।
বিষয়টি হলো, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ও পার্লামেন্ট সম্পর্কে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক যে কর্মপরিকল্পনা (১৬ জুলাই ২০১৭) পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়েছে তার পৃষ্ঠা নম্বর ৭-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শুধু নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করলে চলবে না। বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল বা ভঙ্গুর বা স্পর্শকাতর। নির্বাচনী ব্যবস্থা এখনও স্থিতিশীল হয়নি। মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১০ মে ২০১১ তারিখ সংক্ষিপ্ত মৌখিক রায়ের মাধ্যমে আদেশ দিয়েছিলেন দশম এবং এগারোতম পার্লামেন্টের নির্বাচন ১৩তম সংশোধনী মোতাবেক তথা তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, পার্লামেন্ট চাইলে প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার বিধান বাদ দেওয়ার সংশোধনী আনতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের পার্লামেন্ট সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের দেড়-দুই মাসের মধ্যেই সংবিধান সংশোধন করে ফেলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায়, মৌখিক সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের তারিখ থেকে প্রায় ১৬ মাস পর, প্রকাশিত হয়েছিল। সে সংক্ষিপ্ত মৌখিক রায় এবং লিখিত পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে দু’একটি জায়গায় অতি গুরুত্বপূর্ণ তফাৎ রয়ে গেছে। অর্থাৎ, সংক্ষিপ্ত রায়ে যে কথা বা যে বাক্যগুলো আছে, সে বাক্যগুলো হুবহু বা তার মর্ম লিখিত রায়ে নেই, বরং বিরোধীয় বক্তব্য আছে। কোনো অবস্থাতেই একটি রায়ে এইরূপ অসঙ্গতি গ্রহণযোগ্য নয়, কাম্য নয়। যাহোক, এরূপ অসঙ্গতির বিহিত কী হবে বা না হবে সেটা বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীগণ বলতে পারবেন। কিন্তু সেই মৌখিক-সংক্ষিপ্ত এবং লিখিত-পূর্ণাঙ্গ রায়ের অসম্পূর্ণ বাস্তবায়ন বা পক্ষপাতমূলক বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান রাজনৈতিক সরকারই দায়ী। যার ফলে একটি জগাখিচুরি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক সরকারের বিতর্কিত কর্মকান্ড তথা বিতর্কিত আইনগুলো, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার পথে বাধা বলে আমরা বিবেচনা করি।
পার্লামেন্ট ভাঙ্গা নিয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, নির্বাচনের যথেষ্ট পূর্বেই, পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হবে। একজন সিটিং পার্লামেন্ট মেম্বার যে সকল প্রটোকল পান, যে সকল ক্ষমতা ভোগ করেন, যে সকল সুবিধা ভোগ করেন, সে সকল প্রটোকল ক্ষমতা বা সুবিধা কারো মুখের কথায় ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়। অতএব, নির্বাচনী খেলার মাঠকে সকলের জন্য সমানভাবে উপভোগ্য বা ব্যবহারযোগ্য করতে হলে, পার্লামেন্টকে ভেঙে দিতেই হবে। বর্তমান পার্লামেন্টের অনেক সদস্যই আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হবেন- এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের এমন কোনো পন্থা বা ক্ষমতা আছে বলে প্রমাণিত হয়নি যার দ্বারা, সিটিং এমপিগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শুধু বস্তুগত সহায়তাই যথেষ্ট নয়। নীতিগত সহায়তা, নৈতিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান আইন বা বিধান সংশোধন করে হোক বা নতুন বিধান সংযুক্ত করে হোক, নির্বাচন কমিশনের জন্য বা নির্বাচন কমিশনের প্রতি বন্ধুপ্রতীম ও শুভেচ্ছা প্রতীম এমন একটি সরকার বাংলাদেশে প্রয়োজন। এটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যায়, নিরপেক্ষ সরকার বলা যায়, নির্দলীয় সরকার বলা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলা যায়। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সে সরকারের বৈশিষ্ট্য হতে হবে অন্ততপক্ষে চারটি; যথা এক. রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ হতে হবে। দুই. আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর উপর রাজনৈতিক প্রভাব অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রভাব বিস্তারের সকল প্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষমতা বা সূত্র বা মাধ্যম বা পন্থা রহিত থাকতে হবে। তিন. সরকারের সদস্যগণের কোনো ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে পারবে না। চার. সরকারের প্রধানতম কাজ হবে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা প্রদান করা এবং সহায়তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তার সবকিছু করা। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক চাওয়া কোনো সহায়তাকে তারা নেতিবাচক উত্তর দিতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশনও একটি স্টেকহোল্ডার। রাজনৈতিক দলগুলো স্টেকহোল্ডার বিধায়, নির্বাচন কমিশনের দাওয়াতে এসে বক্তব্য প্রদান করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত প্রকাশ করতেই পারে; এটা তাদের স্বাধীন এখতিয়ার। তবে সকলের প্রস্তাব শোনা, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়ক বলে আমরা বিবেচনা করি। কোন প্রকারের সরকার হবে, সেটা স্থির হবে পার্লামেন্টের আইন দ্বারা। ঐ আইনের বক্তব্য কী হবে, সেটা নির্ধারণ করার জন্য স্টেকহোল্ডারদের মতামত প্রয়োজন। বিভিন্ন দিনে দলগুলোকে স্টেকহোল্ডার বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশন যেমন মত বিনিময় সভায় দাওয়াত দিয়েছে, তেমনই পার্লামেন্ট কর্তৃক আইন প্রণয়নের আগে নির্বাচন কমিশনকেও স্টেকহোল্ডার বিবেচনা করে, পার্লামেন্ট-এর নিকট নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করার অধিকার ও প্রয়োজনীয়তা নির্বাচন কমিশনের আছে বলে আমরা মনে করি।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি মনে করে, যেরূপে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকার বিদ্যমান এবং দায়িত্ব পালনরত, সেরূপের রাজনৈতিক সরকারের অধীনে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা কষ্টকর ও অসুবিধাজনক তথা ডিসএডভানটেজিয়াস হয়ে যাবে। কোনো একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা এবং না করলে আইনগত সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি সম্বন্ধে আমরা অবহিত থেকেই আবেদন করছি তথা প্রস্তাব করছি। নির্বাচন কমিশন এমন সুপারিশ করবে যেন আমরাসহ সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বিশেষত প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। তার জন্য উপযুক্ত সরকার ব্যবস্থা উদ্ভাবনে, নির্বাচন কমিশন ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি। আমরা মনে করি, এটাই দেশবাসীরও আশা।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
mgsmibrahim@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন