মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

জনগণের স্বার্থ ও সম্পদ রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে উন্নয়নে সফল হওয়া যায় না

প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিট ছিল গণতন্ত্র, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা। লাখো মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসেও আমরা যেন ঔপনিবেশিক আমলের শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের গ্যাঁড়াকল থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। উপরন্তু যতই দিন যাচ্ছে, স্বশাসিত জাতির শাসকশ্রেণি জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনে ততই যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে স্বাধীনতা সাড়ে ৪ দশক পর প্রথমত জাতিকে বিভক্ত করে ফেলতে চাইছে, দ্বিতীয়ত তারা দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার বদলে এসব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত করার পাশাপাশি গণতন্ত্রের সর্বজনীন আকাক্সক্ষাকে গলাটিপে হত্যা করতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ পূর্ববর্তী আমলে এ দেশের মানুষকে সেনাশাসকরা উন্নয়নের চমক দেখিয়ে ভোলাতে চাইছিল। জেনারেল আইয়ুব খানের সেনাশাসিত দশককে উন্নয়নের দশক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অনেক প্রামাণ্য উপাদানই হয়তো আমাদের ইতিহাসে পাওয়া যাবে। তবে এসব অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্র কখনো সাংঘর্ষিক বিষয় ছিল না। তথাপি তারা গণতন্ত্রের বদলে উন্নয়নের বটিকা গেলাতে চেয়েছে। এদেশের মানুষ তা মেনে নেয়নি। সত্তরের নির্বাচনে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে জনগণ তার জবাব দিয়েছিল। দেশে গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন থাকলে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সব পক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ থাকলে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অর্থনৈতিক কর্মকা-ই উন্নয়নের পথে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে যথেষ্ট। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক বৈষম্য নিরসনে দেশের কোনো সরকার এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর তেমন কোনো রাজনৈতিক-প্রশাসনিক উদ্যোগ না থাকলেও শুধু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এর পেছনে দেশের শিল্প বিনিয়োগে বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের খাতই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহে গতিসঞ্চারে গার্মেন্ট রফতানি খাত এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনাকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের ভূমিকা খুবই গৌণ এবং অস্বচ্ছ। দুই-তিন দশক ধরে একশ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও আদম বেপারি বিদেশ গমনেচ্ছু একেকজন যুবকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করে, অবৈধ পন্থায় বিদেশে লোক পাঠিয়েছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে এভাবে বিদেশে গিয়ে অনেকেই অবৈধ অভিবাসী হয়ে ফেরারি পলাতক জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। এরপরও ওরা ক্রীতদাসের মতো শ্রম বিক্রি করে জমিজমা বন্ধক রেখে, আত্মীয়স্বজনের ঋণে বিদেশ যাওয়ার খরচের টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। চার দশক ধরে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এভাবেই একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া সঞ্চারিত হয়েছিল। যতই দিন গেছে বিদেশগামী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এখনো মধ্যপ্রাচ্যে এমন হাজার হাজার বাংলাদেশি নাগরিক আছেন, যারা আশি ও নব্বইয়ের দশক থেকে সেখানে অবস্থান করছেন। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকা এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকায় দেশের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য অনেক টান থাকা সত্ত্বেও তারা দেশে ফিরে আসতে পারছেন না। তবে তাদের পাঠানো টাকায় এক সময়ের পর্ণকুটিরগুলো ঝকমকে টিনের ঘর অথবা পাকা দালানে পরিণত হয়েছে। প্রতি বাড়িতে স্যানিটারি ল্যাট্রিন হয়েছে। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রায় তিন হাজার কোটি ডলার রিজার্ভের রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা তাদের সময়ে দেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্ফীতিকে নিজেদের রাজনৈতিক সাফল্য বলে দাবি করে আসছে। স্বাধীনতার পর স্বৈরাচারী এরশাদ থেকে শুরু করে বর্তমানের ভিশন টুয়েন্টি ওয়ানের রূপকার সরকার পর্যন্ত সবাই জনগণের অর্থনৈতিক সংগ্রামকে নিজেদের কৃতিত্ব এবং তথাকথিত উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। 

মেদবহুল নাদুসনুদুস চেহারার মানুষ যেমন নিজেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলে দাবি করতে পারে না, তদুপরি সে যদি উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত হয়, তাকে একজন সাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন সক্ষম মানুষ হিসেবেও গণ্য করা যায় না। বিশেষ চিকিৎসা ও পরিচর্যা ছাড়া এ ধরনের মানুষের অকস্মাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। ঠিক একইভাবে দেশে গণতন্ত্র না থাকলে, আইনের শাসন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সাধারণ মানুষের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত না থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তিরিশ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ অথবা কিছু মেগা প্রকল্পকে দেশের উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, বল্গাহীন নৈতিক অবক্ষয়, যুব সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তি, শিশুদের ওপর চরম নিষ্ঠুরতার মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়াকে দেশের সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিশ্লেষকরা সামাজিক ব্যাধি হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর এই ব্যাধি আমাদের সমাজদেহে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনাচার, শোষণ-বৈষম্য, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতি। শাসকশ্রেণি দেশে শান্তি-স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের বদলে বিভেদ-বিভক্তির দেয়াল নির্মাণ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করতে চাইলে সাধারণ জনগণের সামনে আর কোনো প্রত্যাশার জায়গা থাকে না। সমাজে এ ধরনের হতাশা এবং মাৎস্যন্যায় সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি জনগণকে আস্থাহীন, দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল এবং অনিরাপদ করে তোলে। এ ধরনের বাস্তবতায় একশ্রেণির মানুষ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে। আরেক শ্রেণির পলায়নপর মানুষ জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে বিদেশে পাড়ি জমায়। গত এক দশকে এভাবেই দেশ থেকে চার লাখ কোটি টাকার বেশি সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বৈধপথে বিদেশে যাওয়ার রাস্তা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় অবৈধ পথে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বছরে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। অবৈধ পথে বিদেশে গিয়ে ইতিমধ্যে ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক আছেন। আমাদের সরকার বৈধপথে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে যেমন কার্যকর পদক্ষেপ বা কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, একইভাবে মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট (আকামা) জটিলতায় অবৈধ হয়ে পড়া লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিকের বৈধতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। এমনকি আমাদের জনশক্তি রফতানির প্রধান বাজারগুলো সাত-আট বছর ধরে বন্ধ থাকলেও এসব বন্ধ দরোজা খুলতে সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতা ও যোগ্যতা কার্যত ব্যর্থ, প্রশ্নবিদ্ধ। প্রায় ৮০ লাখ অভিবাসী এবং প্রায় অর্ধকোটি গার্মেন্ট শ্রমিকের কষ্টার্জিত আয় এবং রেমিটেন্স জাতির অর্থনীতি ও উন্নয়নের চাকাকে গতিশীল রাখলেও সরকার একদিকে যেমন জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে রাজকোষ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও নিরাপদ রাখতে পারছে না।
এক-এগারো পরবর্তী মহাজোট সরকার এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক ধারাবাহিকভাবে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ লোপাট হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে দেশের শাসকশ্রেণির রাঘববোয়ালরা জড়িত আছে বলে খোদ অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। গত দুই দশকে একাধিকবার শেয়ারবাজার লুণ্ঠনের হোতাদের এখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রধান ব্যাংক সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িতদের এখনো শাস্তি হয়নি এবং টাকা উদ্ধারও হয়নি। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংক জালিয়াতি ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, জালিয়াতি ও পাচারের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের বিচার দূরের কথা, এদের নাম-ঠিকানাও দেশের মানুষের কাছে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বড় বড় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সরকারের সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই দুদকের কাছ থেকে দায়মুক্তির সার্টিফিকেট নিয়ে দোর্দ- প্রতাপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফিনানসিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)’র ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই সংখ্যাটি দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকায়। এভাবেই এগিয়ে চলেছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। সাম্প্রতিক সময়ে এটিএম কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে কোটি কোটি টাকা লুঠ করার সঙ্গেও পুলিশসহ সরকারের প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হলো দেশে ব্যাংক ডাকাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন কোড হ্যাক করে ইতিমধ্যে ৮০০ কোটি টাকা পাচার করে দিয়েছে সংঘবদ্ধ জালিয়াতচক্র। জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পর আমাদের অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, ৪ হাজার কোটি টাকা তেমন কিছুই নয়। এবারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনলাইন জালিয়াতির মাঝখানে ১০ কোটি ডলার বেহাত হওয়ার পর বিদেশি ব্যাংকিং চ্যানেলে ধরা না পড়লে বিলিয়ন ডলার বেহাত হওয়ার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এবারো দেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং এফবিসিসিআই’র নেতা বললেন, ৮০০ কোটি টাকা ছেঁচড়া চুরি। তার মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন ডলারের পুরোটাই নিয়ে নিতে পারত হ্যাকাররা। তার এই মন্তব্য একেবারে যুক্তিহীন বা বাগাড়ম্বর নয়। তিনি যথার্থই বলেছেন, ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনা আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শাপেবর হতে পারে। তবে আমাদের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে ইতিহাস বা ঠেকে শেখার কোনো লক্ষণই খুঁজে পাওয়া যায় না। একের পর এক হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা, এটিএম কার্ড স্কিমিং থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোড জালিয়াতি পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শর্ষের ভেতরে ভূত রেখে যতই নতুন সফটওয়্যার, ফায়ারওয়াল সংযুক্ত করা হোক, নতুন নতুন নির্দেশনা জারি হোক, এসব প্রযুক্তি ও প্রোফাইল দেখভাল করার লোকগুলোকে না পাল্টালে সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কা থেকেই যায়। বিশেষত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক টাকা চুরির সঙ্গে জড়িত বা দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে জনসম্মুখে ও বিচারের কাঠগড়ায় হাজির করা না হলে ওরাই আবারো বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়ে যে কোনো সময় দেশ ছাড়তে পারে। আর অর্থমন্ত্রী বা এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত রেখে বলতে চাই, আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চেয়ে বহুগুণ বড় অর্থনীতির ধনী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনার নজির আছে কি? সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের কোনো ঘটনাকে এতটা নিস্পৃহভাবে গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনা মাঝপথে ধরা না পড়লে এরই মধ্যে হয়তো আরো ৭ হাজার কোটি টাকা বেহাত হয়ে যেত। সবচেয়ে উদ্বেগ ও বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ফেব্রুয়ারি মাসের ২ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে নিউইয়র্কের ফেডারেল ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ছাড় করতে ঢাকা থেকে ৩৫টি নির্দেশনা পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৫টি নির্দেশনায় ১০১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক এবং শ্রীলঙ্কায় পাঠানোর পর বানান ভুল এবং সন্দেহজনক ট্রানজেকশন মনে করে বাকি নির্দেশনাগুলো আটকে দেয়া হয়। প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির এই খবর বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারে ৮ ফেব্রুয়ারি যদিও ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের দ্য ইনকোয়েরার পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ, এমনকি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত এ তথ্য জানতে পারেননি। এখন বলা হচ্ছে, তদন্তের স্বার্থে অর্থমন্ত্রীকেও এ বিষয়ে জানায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভা, ২৮ এবং ১ মার্চে অনুষ্ঠিত অডিট কমিটির সভাতেও রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরি সংক্রান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে কোনো গোপন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল কিনা তাও জানা যায়নি। তবে এত বড় একটি কেলেঙ্কারির ঘটনা খোদ অর্থমন্ত্রীর কাছে গোপন রাখার যে তথ্য জানা যাচ্ছে, তাতে টাকা চুরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নেপথ্য ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের ডালপালা বিস্তার করছে। এখন গণমাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রহস্যজনক আচরণের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এমনকি টাকা চুরির ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ক্ষুদ্র ব্যাংক ঋণের ৫-১০ হাজার টাকা আদায়ের জন্য যে দেশে কৃষকের কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে নিয়ে যায় পুলিশ, সে দেশেরই রাষ্ট্রীয় কোষাগারের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনা সংঘটিত হওয়ার প্রায় এক মাস পরে এ তথ্য জানার পর আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রথমেই নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তবে অনেক দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনা তার কাছে গোপন রাখাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধৃষ্টতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবেন, তা কিন্তু বলেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ তসরুফ করা অসম্ভব। বিশেষত ব্যাংকের কোড ফাঁস এবং ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে কথিত নির্দেশনা পাঠানোর ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি আইডি ইতিমধ্যে শনাক্ত হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে হয়তো তাদের নাম-পরিচয় এখনই প্রকাশিত হচ্ছে না। তবে যাদের যোগসাজশে ৮০০ কোটি টাকা বেহাত হলো এবং আরো ৭ হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছিল তাদের কোমরে কখনো দড়ি পড়বে কিনা সে বিষয়ে জনমনে সন্দেহ আছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পরিবর্তনসহ রাজনৈতিক নিয়োগের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। তদন্ত কীভাবে হবে তা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাই ভালো জানবেন। তবে রাষ্ট্রের নাগরিক অথবা তসরুফ হওয়া টাকার একজন মালিক হিসেবে একজন সাধারণ নাগরিকও জানেন, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা চুরির ঘটনা গোপন রাখা বা ধামাচাপা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে নিশ্চয়ই কোনো আইটি বিশেষজ্ঞ বা এফবিআই তদন্তের প্রয়োজন পড়বে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত সম্পদের মালিক যেমন এ দেশের জনগণ, একইভাবে এই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। বৈদেশিক কর্মসংস্থান, জিএসপি সুবিধা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির ঘটনায় জনগণের সম্পদ ও স্বার্থ রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা বার বার প্রমাণিত হচ্ছে। জনগণকে কথিত উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানোর চেয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করা, সুশাসন, জননিরাপত্তা এবং জনগণের সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন