বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

দখল ও দূষণে নাব্যতা হারাচ্ছে নদ-নদী

| প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চান্দিনা (কুমিল্লা) থেকে মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল : নীরবেই চলে গেল বিশ্ব নদী দিবস। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব নদী দিবস। নদীমাতৃক দেশ আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ। নদীই আমাদের এই শ্যামল দেশের প্রাণ, অর্থনীতির ভিত্তি। আমাদের বাঙালি জীবনধারা, আমাদের সংস্কৃতির সূতিকাগার, নদীনির্ভর গ্রাম, নদীবিচ্যুত এই চিরচেনা রূপ কল্পনাও করা যায় না। কৃষি ফসলের সাথে নিবিড় আত্মীয়তা আমাদের নদীর। পলি-জলের যে শক্তি তারও উৎস ওই নদী। মরে যাচ্ছে দেশের নদ-নদী। বিশেষ করে কুমিল্লার নদী দখলে ও দূষণে নাব্যতা হারাচ্ছে। উৎমুখে গতিরোধ, দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, অবৈধ বনায়ন, অপরিকল্পিত ব্রিজ, মাটি কাটাও বালু উত্তোলন চলছে কোনো নিয়ম ছাড়াই। এদিকে যেমন নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পানির গতিপথ বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে নদীর বাঁধ। বহু স্থানে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বন্যার অশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে নানা আয়োজনে পালিত হয়েছে দিবসটি। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালিত হয়। সেই হিসাবে এবার ২৪ সেপ্টেম্বর (রোববার) ছিল বিশ্ব নদী দিবস। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্ব নদী দিবস পালন করতে শুরু করে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া (বিসি) ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল বিসি রিভারস ডে পালন দিয়ে। ১৯৮০ সালে কানাডার খ্যাতনামা নদীবিষয়ক আইনজীবী মার্ক অ্যাঞ্জেলো দিনটি ‘নদী দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিসি রিভারস ডে পালনের সাফল্যের হাত ধরেই তা আন্তর্জাতিক রূপ পায়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ নদী রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরি করতে ‘জীবনের জন্য জল দশক’ ঘোষণা করে। সে সময়ই জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। এরপর থেকেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে, যা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৬০টির বেশি দেশে পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে থেকে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে আসছে।
অথচ সেই নদীকে আমরা প্রতিদিন খুন করে চলেছি। দখল করছি নদীর বুক, বিষজলে মরে যাচ্ছে মাছ, শিল্পবর্জ্যরে এই বিষ আমরাই ঢালছি। উজানের বাঁধে হারিয়ে যাচ্ছে নদীর চিহ্ন। নদীর এই মরণ, বিনাশের দায় এ দেশের সাধারণ মানুষের বিন্দুমাত্র নেই। নদীর দূষণ, দখল, নদীকে বিষময় করার সমস্ত দায় ক্ষমতাবানদের, বিত্তবানদের, রজনীতিকদের। জীবন-জীবিকা, কৃষি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গে নদী মানুষের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দখল-দূষণে প্রায় বিপন্ন বাংলাদেশের নদ-নদী। আবার কখনো এই নদীর কারণে মানুষের জীবন, সংসার, বসতবাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরে নিমিষেই।
কুমিল্লায় রয়েছে উল্লেখযোগ্য বেশ ক’টি নদী ও খাল। এখানে প্রধান নদী গোমতী। ডাকাতিয়া ও কাঁকড়ী নামে আরো দু’টি রয়েছে। নদী ছাড়া খালগুলো হচ্ছেÑ গঙ্গাইজুড়ী, ঘুংঘুর ও সোনাইছড়ি। গভীর নলক‚পের পাশপাশি নদী খালের পানি দিয়ে একসময় এ জেলায় সেচকাজ চলত। ড. আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে সোনাইছড়ি খাল এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে কাটা কোদালিয়া খাল দক্ষিণ কুমিল্লার কৃষিতে বিপ্লব এনেছিল। এর বাইরে নাম না জানা অনেকে খালের পানি সেচকার্যে ব্যবহার হতো। আজ এগুলোর কোনো কোনোটি মৃতপ্রায়, কোনোটি বা হারিয়ে গেছে অব্যবস্থাপনার কারণে। এ ছাড়া নদী ও খালের দু’পাড়ে বসতি গড়ে উঠায় ও যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দাউদকান্দির মেঘনা নদীর কুমিল্লা অংশ শুকিয়ে যাওয়ার এবং অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠায় সম্ভবনাময় এই অংশটির ব্যবসা-বাণিজ্যও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
জেলার প্রধান নদী গোমতী। এ দেশের প্রবেশ মুখে উজানোর অংশে ভারত সরকার পাম্প হাউজ নির্মাণের মাধ্যমে শুঙ্ক মৌসুমে সেচসুবিধার জন্য ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে পানি সরিয়ে নেয়। এতে নদীর পানিপ্রবাহ একেবারেই কমে যায়। যে কারণে নদীটি প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে গোমতী অববাহিকায় সেচ কার্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। গোমতী, ডাকাতিয়া, কাঁকড়ী নদীর উপর সরকার বেশ ক’টি ব্রিজ নির্মাণ করেছে। ব্রিজ নির্মাণে সড়ক ও জনপথ বিভাগ দায়িত্ব পালন করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডেও মতামত নেয়া হয়নি। নদী বিষয়ে অনভিজ্ঞতার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথে তারা বাধার সৃষ্টি করে। এতে পলি জমে নদীর নাব্যতা নষ্ট হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী জানান, জেলার তিনটি নদীর যে প্রসস্থতা তাতে কোনো গার্ডার ছাড়াই ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব হতো। এতে পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হতো না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতামত নিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করলে নদীতে পলি জমত না। বেইলি সেতুর পিলার অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় সেখানে নদীর নাব্যতা দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। এর বাইরে তিনি আরো বলেন, পালপাড়া বেইলি ব্রিজটি দৈর্ঘ্য কমাতে নদী ভরাট করা হয়। এদিকে চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার এলাকায় কাঁকড়ী নদীর উপর ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের ব্রিজটিও নদীকে ছোট করে নির্মাণ করা হয়। ফলে পানির প্রবল চাপে ব্রিজটি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, শহরতলীর আলেখারচর এলাকায় একটি ব্রিজ নির্মাণের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় সম্পন্ন। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডেও মতামত না নিয়ে এটা করলে ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা বাঁধ হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
কুমিল্লার গোমতী অংশের দু’তীরে তিন শতাধিক, নতুন ডাকাতিয়ায় ৫০টিরও বেশি এবং কাঁকড়ী নদীতে ৬০টিরও বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। অর্থাৎ নদীগুলোর অবৈধ স্থাপনা রয়েছে ৪ শ’টিরও বেশি। আস্তে আস্তে গাছপালা, মাটির ঘর, আধা-পাকা ঘর ও সর্বশেষ পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নদী দখল করে বাড়ি, গতিপথে প্রতিবন্ধতা, অবৈধ উপায়ে মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ইত্যাদির মাধ্যমে নদীগুলোর দুরবস্তার বিষয়ে ভ‚মি আইন অ্যাডভোকেট আনোয়ার সাহেব বলেন, নদী তীর দখল, মাটি কাটা, বাগান সৃজনের নামে জায়গা দখল, বালু উত্তোলন, বাঁধের উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল প্রভৃতি বিষয়গুলো পৃথক পৃথক বিভাগ বা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় বলে সমন্বয়হীনতার কারণে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যেহেতু নদীগুলো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেহেতু নদী সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদী নৌমন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলে সমন্বয়হীনতা হতো না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যাও থাকত না। তারা এককভাবে উদ্যোগ নিলেই দখল, অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ইত্যাদি প্রতিরোধ সম্ভব হতো। আইনি জটিলতায় পড়ার সম্ভাবনা কম থাকত।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন