মোহাম্মদ আবদুল গফুর
গত সোমবার একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : ‘বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তো?’ এ প্রশ্ন উঠা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান কর্মসূচিই হয়ে দাঁড়িয়েছে হামলা-মামলা প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতাকর্মীদের রাজনীতি করার পথ ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা। দেশের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ স্বীকার করতে বাধ্য যে, বিএনপি আগাগোড়া নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অভ্যস্ত এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে অভ্যস্ত নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এসত্যও স্বীকার করতে বাধ্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহাসিক অবদান থাকলেও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরে দেশের সকল বিরোধী দল নিষিদ্ধ করে একটিমাত্র সরকারী দল রেখে বাংলাদেশে বাকশালী শাসন কায়েম করা হয়। দেশকে এ অভিশাপ থেকে মুক্ত করে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠার পেছনে গৌরবজনক অবদান ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের।
কিন্তু দেশে এভাবে গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা চলুক তা চাইছিল না যেমন সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাকাক্সক্ষী নেতা, তেমনি তা পছন্দ ছিল না একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠাকারী রাজনৈতিক দলটির। এর প্রমাণ মেলে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে যখন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন, তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত এ বিবেচনায় যে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি।
এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, প্রধান নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাইতে সামরিক শাসকের শাসন তাঁর কাছে অধিক প্রিয় মনে হয়েছিল। বলা বাহুল্য এটা তাঁর গণতন্ত্র ঐ প্রীতির প্রমাণ বহন করে না। গণতন্ত্রের অর্থ শুধু যেনতেন প্রকারে লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া নয়। প্রকৃত গণতন্ত্রে বিরোধী মতের অনুসারীদের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি তথা সভা-সমাবেশ ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচির অবাধ স্বাধীনতার পাশাপাশি নিয়মিত ব্যবধানে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করতে হয়। আমাদের দেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা একাজে সবচাইতে উপযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে থাকার কথা- জেনারেল এরশাদের সুদীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনকালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যুগপৎ এরশাদবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যায়। তবে বাস্তবতার খাতিরে একথাও যে কোন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক স্বীকার করে নিতে বাধ্য যে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যতটা আন্তরিক ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও যদি ততটা আন্তরিক থাকতেন তা হলে এরশাদের শাসন অত দীর্ঘায়িত হতে পারতো না। যাই হোক, এরশাদের শাসনামল অবসানে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দেশের দুই প্রধান দল একমত হয়। সেই মোতাবেক তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত দেশে প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এই প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন খুবই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। এই নির্বাচনে নিজস্ব ভোট কেন্দ্রে ভোটদানের পর শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন কেউ যেন আবার নির্বাচনে হেরে গিয়ে এর মধ্যে কারচুপি আবিষ্কার না করেন। পরে যখন নির্বাচনের সম্পূর্ণ ফলাফল জানা গেল, দেখা গেল আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, তখন তিনি অবলীলা ক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনের সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে! তাঁর এই বক্তব্যে নতুন করে প্রমাণিত হয়, নির্বাচনের সুষ্ঠুতার অর্থ হতে হবে তার নিজের দলের বিজয়ী হওয়া। বলা বাহুল্য এটাও তাঁর গণতন্ত্রে বিশ্বাসের প্রমাণ বহন করে না।
জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে এ দেশের ইতিহাসের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম এ নির্বাচন নানা কারণেই এদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য একটি নির্বাচন ছিল। প্রথমত, এ নির্বাচনে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক নেত্রী পরাজিত হন, আর রাজনীতিতে পূর্ব অভিজ্ঞতাহীন এক নবাগত নেত্রীর কাছে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আন্তরিক নিরাপেক্ষ ভূমিকা। দ্বিতীয় কারণে এ নির্বাচন প্রমাণ করে এদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের যথার্থতা প্রমাণিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে এরশাদ পরবর্তী প্রথম নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন এবং তার মেয়াদ শেষে প্রধানত, তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবিতেই দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে বিধিবদ্ধ করা হয়।
এরপর এই বিধান মোতাবেক দেশে বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এর ফলে দেশের দুই প্রধান দল পর পর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু অতিরিক্ত ক্ষমতার ক্ষুধা এই সুন্দর ব্যবস্থাকেও এক পর্যায়ে পচিয়ে ফেলে এবং এই ফাঁকে অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করে সেনাসমর্থিত সরকারের নামে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার গঠন করে মাইনাসটু ফর্মূলার মাধ্যমে দেশে দুই নেত্রীকে অন্তরীণ করে দুই দলের তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের হাতে দুই দলের নেতৃত্ব ন্যস্ত করার এক জঘন্য ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ভাগ্যভালো দুই দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রবল বিরোধিতার ফলে এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়।
এ পর্যায়ে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী অসাংবিধানিক শক্তির বিরুদ্ধে দেশের সর্বত্র ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে এবং তাদের বিচারের দাবিও ক্রমশ জোরদার হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে অন্যতম নেত্রী শেখ হাসিনা আশ্বাস দেন তিনি ক্ষমতায় গেলে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাদখলকারী সরকারের সকল কাজের বৈধতা দান করবেন। এরপর ঐ অবৈধ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়, তাতে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। নতুন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা এক-এগারোর অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ার প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে পালনের ফলে তারা দেশে-বিদেশে সর্বত্র এখনও স্বাধীনভাবে চলাফরা করতে পারছেন।
এদিকে শেখ হাসিনা পরবর্তীকালে পূর্ব সমঝোতা মোতাবেক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে অন্যতম প্রধান দল বিএনপি পূর্ববর্তী সমঝোতা লঙ্ঘনের অভিযোগে সে নির্বাচন বয়কট করে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্বাচন বয়কটের ফলে গোটা নির্বাচন হয়ে পড়ে অনেকটাই মূল্যহীন। নির্বাচন কেন্দ্রে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে সরকারী দলের নেতাকর্মীরা তাদের ইচ্ছা মোতাবেক ব্যালট পত্রে সিল মেরে প্রদত্ত ভোট সংখ্যা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তোলার সুযোগ গ্রহণ করেন। এভাবেই ৫ জানুয়ারির তথাকথিত ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা নতুন করে ক্ষমতাসীন হন।
দেশে-বিদেশে সর্বত্র বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা চলায় বর্তমান সরকারে এখন হয়ে উঠেছে আরো বেপরোয়া। ফলে ৫ জানুয়ারির পর পৌর নির্বাচন এবং সর্বশেষ চলছে ইউপি নির্বাচনের ব্যবস্থা। সর্বত্র একই এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে চলেছে সরকার। জোর জবরদস্তি নির্বাচনী মহড়ার মাধ্যমে সকল পর্যায়ে শাসক দল আওয়ামী লীগ একই পন্থায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এগিয়ে চলেছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনেই সরকারী দলীয় প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে স্মরণকালের ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেন। বাকি যেসব আসনে ভোট হয় সেখানেও কিভাবে ভোট জালিয়াতি হয় তার বিবরণ ইতোপূর্বেই দেয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদের এ নির্বাচনের মতো হাস্যকর নির্বাচন ইতিপূর্বে কখনো হয়নি। এ নির্বাচনের ফলে সংসদে বিরোধীদলের নেতা হয়েছেন জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ, যিনি সংসদে তাঁর প্রথম ভাষণেই সরকারকে তার সকল সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, ঐ বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের স্বামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে তাঁর সরকারী দায়িত্ব পালন করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় খুশি হয়ে সংসদে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ভালোই হয়েছে, সংসদে তাদের খিস্তি খেউড় শুনতে হচ্ছে না।
প্রশ্ন জাগে, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের বক্তব্যকে যিনি খিস্তি খেউড় মনে করেন তিনি কি আদৌ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন? গণতন্ত্রে তো বিরোধীদলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন একটি মৌলিক কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। স্বাধীনতা যেমন যে কোন রাষ্ট্রের মর্যাদার জন্য অপরিহার্য তেমনি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদাকে পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এক হিসাবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র একই মুদ্রার ওপিঠ এপিঠ। স্বাধীনতা যেমন যেকোন জাতির মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য, তেমনি যে কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র অপরিহার্য। আধুনিক বিশ্বে কোন রাষ্ট্রের জন্য স্বাধীনতা যেমন অপরিহার্য এবং স্বাধীনতা না থাকা তেমনি অকল্পনীয়, তেমনি রাষ্ট্রের নাগরিকদের তথা জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্র না থাকার কথা কল্পনাও করা যায় না।
স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র পরস্পর অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। যে দেশে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা তথা গণতন্ত্রের কোন মূল্য থাকে না, সে দেশের নাগরিকরা দেশের জন্য গভীর একাত্মতা অনুভব করতে সক্ষম হয় না। ফলে সে দেশের স্বাধীনতাও সম্পূর্ণ নিরাপদ হয় না। দেশের স্বাধীনতাকে অজেয় ও দুর্ভেদ্য তুলতে দেশে ব্যাপক গণতন্ত্র চর্চার প্রয়োজন অপরিহার্য। একারণে জাতির নিরাপত্তার স্বার্থেই দেশে গণতন্ত্রকে জোরদার করে তুলতে হবে। গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী কোন শক্তি বা গোষ্ঠী কখনও স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি বলে বিবেচিত হতে পারে না। অন্য কথায়, স্বাধীনতার বৃহত্তর স্বার্থেই দেশে গণতন্ত্র চর্চা জোরদার করে তুলতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন