আবু তালহা খন্দকার, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। টগবগে এই তরুণের স্বপ্ন ছিল বাবার মতো ব্যবসায়ী হবে। তার সে স্বপ্ন পূরণ হলো না। এর আগেই তার জীবনের ছেদরেখা অংকিত হয়ে গেছে। ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে সে মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছে। গত রোববার সকাল সাড়ে ছ’টায় দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য টিকাটুলির বাসা থেকে বের হওয়ার পরই সে ছিনতাইকারীদের মুখোমুখী হয়। ছিনতাইকারীরা তখন একটি রিকশা থামিয়ে ছিনতাই করছিল। সে তাদের বাধা দেয় এবং একজন ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলে। এ সময় অন্য দু’জন ছিনতাইকারী তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে সঙ্গী ছিনতাইকারীকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত আবু তালহাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এভাবেই একজন মেধাবী ও উজ্জ্বল তরুণের জীবনের জবনিকাপাত হলো। তার এ মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক প্রকাশের শক্তি কোনো ভাষায় নেই। রাজধানীতে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য কতটা বেড়েছে এ ঘটনা থেকে তার প্রমাণ মেলে। উল্লেখ করা যেতে পারে, টিকাটুলি ও সন্নিহিত এলাকায় অনেকদিন ধরেই ছিনতাইকারীদের উপদ্রব চলছে। রাত-দিন বলে কথা নেই, যে কোনো সময় ছিনতাইকারীরা রাস্তায় নেমে পথচারীদের টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নিচ্ছে। ১৯ সেপ্টেম্বর ওয়ারীতে এরকম এক ছিনতাইয়ের সময় একজন রিকশাচালক আহত হয়। পরে এলাকাবাসী একজন সন্দেহভাজন তরুণকে মারধোর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সঙ্গতকারণেই ওয়ারী, টিকাটুলি, আর কে মিশন রোড, যাত্রাবাড়ী প্রভৃতি এলাকার অধিবাসীরা ছিনতাইকারীদের ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকে। পুলিশ-টহল মাঝে-মধ্যে দেখা যায়। তারপরও কিভাবে ছিনতাইকারীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, সেটাই প্রশ্ন।
সর্বিক বিবেচনায় রাজধানীর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। ছিনতাই, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি সমানেই চলছে। পথে তো বটেই, বাসা-বাড়িতেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। কিছুদিন ধরে চুরি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। নানা অসিলায় বাসা-বাড়িতে ঢুকে মালামাল নিয়ে যাওয়ার মতো দস্যুতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে যদিও বলা হচ্ছে, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে; কিন্তুু বাস্তবতা এ দাবির সত্যতা প্রমাণ করে না। একদিকে গুম, তুলে নেয়া এবং পুলিশের বিভিন্ন শাখার পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি ইত্যাদি চলছে অন্যদিকে ছিনতাইকারী-রাহাজানসহ বিভিন্ন দুস্কৃতকারী চক্রের অপতৎপরতাও অব্যাহত আছে। এ অবস্থায় কারো পক্ষেই নিরাপদ ও স্বস্তি বোধ করা সম্ভব নয়। যার অবস্থা যেনই হোক, প্রত্যেকেই তার জানামালের নিশ্চিত নিরাপত্তা চায়। এ নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব অবশ্যই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের। এক্ষেত্রে কোনো উপেক্ষা, অবহেলা এবং ওজর-আপত্তির সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করিনা। আইনশৃংখলা সুরক্ষার তাকিদেই রাজধানীতে থানা ও পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এর সুফল তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। বলা হয়ে থাকে, লোকসংখ্যার অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। তাছাড়া যানবাহন ও সাজসরঞ্জামেরও অভাবও আছে। হয়তো এ কথা বেঠিক নয়; কিন্তুু যতটুকু সংগতি ও সামর্থ আছে ততটুকুরই কি ব্যবহারই ঠিকমতো হচ্ছে? সম্ভবত হচ্ছে না। হলে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ও জননিরাপত্তা এতটা উদ্বেগের বিষয় হতো না কখনো। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ তার মূল দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সময় দিতে পারছে না। রাজনৈতিক ও অন্যান্য কাজে তাকে অধিক ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে মূল দায়িত্ব পালনে ভাটা পড়েছে। আর এই সুযোগে দুস্কৃতকারী ও অপরাধীরা তাদের অপকর্ম ও অপতৎপরতা বাড়ানোর মওকা পাচ্ছে। বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
সুষ্ঠু আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এবং নিশ্চিত নাগরিক নিরাপত্তা জীবনযাপন, আয়-রোজগার, কাজকর্ম, অর্থনৈতিক তৎপরতা ইত্যাদির পূর্বশত। নিরাপত্তার অভাব বা অনিশ্চয়তা নিয়ে কোনো কিছুই ঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। এই বিবেচনা সামনে রেখে নাগরিক নিরাপত্তা যথাযথ করার কোনো বিকল্প নেই। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি প্রভৃতি অপরাধ অব্যাহত থাকার একটি বড় কারণ, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়না এবং বিচার প্রক্রিয়াও দীর্ঘসূত্রী। প্রতিটি ঘটনার যদি স্বল্পতম সময়ে তদন্ত ও বিচার কাজ নিষ্পন্ন হতো, অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত হতো তাহলে এসব অপরাধ অনেক কমে আসতো এবং নতুন অপরাধী সৃষ্টির হারও কমে যেতো। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম যেভাবে বেড়ে গেছে, আমরা মনে করি, পুলিশের অভিযান ও টহল বাড়ানো গেলে তা কমতে পারে। সেই সঙ্গে ছিনতাইকারীদের কোঠর শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে, যাতে এ অপকর্মে কেউ জড়িত হতে সাহস না পায়। রাজধানীর প্রতিটি থানা-পুলিশকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ও তৎপর হতে হবে। আবু তালহার মতো আর কোনো তরুণের, আর কোনো ব্যক্তির যেন ছিনতাইকারীদের ছুরিতে প্রাণ দিতে না হয়, আমরা সর্বোত্মভাবে সেই কামনাই করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন