শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

ধরে রাখতে চায় আ.লীগ পুনরুদ্ধারে তৎপর বিএনপি, বসে নেই জাপা

কুমিল্লা-৪ : দেবিদ্বারে বইছে নির্বাচনী হাওয়া

| প্রকাশের সময় : ১৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে : কুমিল্লা-৪ সংসদীয় আসন। দেবিদ্বার উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ আসন থেকে ১৯৭৩ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির নির্বাচিত এমপিরা জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সেই দিক থেকে বড় সব দলেরই প্রাপ্তি রয়েছে আসনটিতে। ৯১ থেকে ২০০১ সালের মোট তিনটি নির্বাচনে জয় পেয়ে দেবিদ্বারকে বিএনপির ঘাঁটিতে পরিণত করেছিলেন মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী। টানা ১৬ বছর ক্ষমতার একচ্ছত্র প্রভাবে মঞ্জুর মুন্সী ছিলেন দেবিদ্বারের দাপুটে এমপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির এ ঘাঁটিতে আঘাত করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম গোলাম মোস্তফা। ২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আসনটি ওঠে আসে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের হাতে। একাদশ নির্বাচনেও এ আসনটি চায় আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতাই মুখিয়ে রয়েছেন।শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জোটে যদি জাতীয় পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) থেকে যায়, তা হলে আসনটি যাতে ওই দুই দলের একটিকে ছেড়ে এমন কৌশলী হয়ে এগুচ্ছে জাপা ও ন্যাপ। অপরদিকে, বিএনপি চাইছে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেবিদ্বার বিএনপিতে মঞ্জুর মুন্সীর মতো হেভিওয়েট নেতা ছাড়াও বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল খান আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের কাছে মনোনয়ন চাইবেন।
কুমিল্লা-৪ দেবিদ্বার আসনে ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত হন ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহাম্মদ। ১৯৮৬ এবং ৮৮ সালে জাতীয়পার্টির প্রার্থী এ এফ এম ফখরুল ইসলাম মুন্সী এমপি নির্বাচিত হন। তিনি এরশাদ সরকারের অর্থ-উপমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ’৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির মঞ্জুরুল আহসান মুন্সীর কাছে মাত্র ১১ শ’ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন ন্যাপের প্রার্থী সাবেক এমপি অধ্যাপক মোজাফফর আহাম্মদ। ৯৫ সালে ফখরুল ইসলাম মুন্সী আওয়ামী লীগে যোগদান করে ৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মঞ্জুরুল আহসান মুন্সীর কাছে পরাজিত হন। ওই নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন জাতীয়পার্টির এ বি এম গোলাম মোস্তফা। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফখরুল ইসলাম মুন্সী পরাজিত হন বিএনপি প্রার্থী মঞ্জুরুল মুন্সীর কাছে। এরপর থেকেই মঞ্জুর মুন্সী চারদলীয় জোট সরকারের প্রভাবে বেপোরোয়া হয়ে উঠেন। অরক্ষিত জনপদে পরিণত হয় দেবিদ্বার। এমপি মঞ্জুর মুন্সীর হাতে আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নানাভাবে নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় বিভিন্ন অভিযোগে মঞ্জুর মুন্সীকে জেলে যেতে হয়েছিল। মামলার কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি মঞ্জুর মুন্সী। মনোনয়ন দেয়া হয় তার স্ত্রী মাজেদা মুন্সীকে।
এদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আগে জাপা নেতা এ বি এম গোলাম মোস্তফা যোগদান করেন আওয়ামী লীগে। ওই নির্বাচনে দেবিদ্বার আসনে আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে বিএনপি প্রার্থী মাজেদা মুন্সীকে হারিয়ে বিজয়ী হন গোলাম মোস্তফা। সহজ-সরল প্রকৃতির নেতা হওয়ায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বেশ কিছু নেতাকর্মীর কার্যকলাপে বিতর্কিত হয়ে ওঠেন তিনি। মেয়াদের শেষের দিকে সবকিছু এ বি এম গোলাম মোস্তফা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। বিএনপিবিহীন ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোট থেকে প্রার্থী করা হয় জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন রাজুকে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন দেবিদ্বার আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও আওয়ামী লীগ নেতা রৌশন আলী মাস্টার। নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থী রাজুকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। নির্বাচিত হওয়ার পর কেবল দেবিদ্বারের উন্নয়নই নয়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত মজবুত করার কাজেও নামেন। একসময় দেবিদ্বার আওয়ামী লীগ অনেক কঠিন পরিস্থিতি পার করেছে। সাংগঠনিক দিক থেকে দেবিদ্বার আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে অনেক বেশি সুসংগঠিত। এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের হাত ধরেই দেবিদ্বার আওয়ামী লীগের বর্তমান পথচলা হয়ে ওঠে দ্ব›দ্ব-বিভেদের ঊর্ধ্বে।
দেবিদ্বার আওয়ামী লীগের একাধিক তৃণমূল নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারুণ্যের প্রভাব পড়েছে দেবিদ্বারে। রাজী ফখরুলের বিচক্ষণতা, সাংগঠনিক দক্ষতায় সবাই মুগ্ধ। দেবিদ্বারজুড়ে এখন আওয়ামী লীগের জোয়ার। আগামী নির্বাচনে এ জোয়ার ধরে রাখতে হলে নৌকার প্রার্থী হিসেবে রাজী ফখরুলের বিকল্প নেই বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। এমপি রাজী ফখরুল জানান, তিনি দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সাংগঠনিকভাবে দলের ঐক্য সংহত করছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড জনগণের সামনে তুলে ধরছেন। তিনি আশাবাদী, তার কর্মকান্ড মূল্যায়ন করে দল তাকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে। এদিকে দেবিদ্বার আওয়ামী লীগে আরো অনেক নেতা রয়েছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করছেন। তারাও দলের কাছে মনোনয়ন আশা করছেন। আর মনোনয়ন আশায় মুখিয়ে থাকা এসব নেতাদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাবেক এমপি এ বি এম গোলাম মোস্তফা, সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ এম হুমায়ুন মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রৌশন আলী মাস্টার, দেবিদ্বার উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এ কে এম শফিকুল আলম কামাল ওরফে ভিপি কামাল।
এদিকে হাতছাড়া হওয়া আসনটি পুনরুদ্ধারে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। দেবিদ্বারে দলটিতে গ্রুপিং না থাকলেও নেতৃত্বের পরিবর্তন চায় অনেকেই। দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের অনেকেই মনে করেন, আগামী নির্বাচনে এমন ব্যক্তিকেই প্রার্থী করা উচিত, যাকে নিয়ে অতীত ইতিহাসের ঘাঁটাঘাঁটি হবে না। ২০০১ সাল থেকে ওয়ান-ইলেভেনের আগ পর্যন্ত দলীয় এমপি ও অনেক নেতাকর্মীর বিষয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। এসব বিষয়গুলো দলীয় হাইকমান্ডের নজরে রাখতে হবে। তবে দেবিদ্বার বিএনপির একটি অংশ মনে করে, সাবেক এমপি মঞ্জুরুল মুন্সীর হাত ধরেই সম্ভব আসনটি পুনরুদ্ধার করা। এ বিষয়ে মঞ্জুরুল মুন্সী নিজেকে ওয়ান ইলেভেনের সময়ে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত দাবি করে জানান, তার ওপর দলের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। তিনি চারবার নির্বাচন করেছেন। তার মধ্যে একবার তিনি মনোনয়ন চেয়েছেন তিনবারই দল তাকে মানোনয়ন দিয়েছে। আগামীতে দল তাকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবেন। আর অন্য কাউকে দিলে তার জন্য কাজ করবেন। অপরদিকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান জানান, বড় দল তাই মনোনয়ন প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। তবে দল যাকেই মনোনয়ন দেবে তার হয়ে আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকতে হবে।
এদিকে আওয়ামী লীগ মহাজোটের হয়ে আগামীতেও প্রার্থী হওয়ার আশা করছেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু। একইভাবে মহাজোটের মনোনয়নের আশায় রয়েছেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রধান অধ্যাপক মোজ্জাফর আহম্মেদের স্ত্রী আমেনা আহম্মেদ। তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি। মহাজোটের শরীক ওই দুইটি দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ইকবাল হোসেন রাজু ও আমেনা আহম্মেদ আগামী সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৪ আসনে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে সমানতালেই কৌশল অবলম্বন করে এগুচ্ছেন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন