ঈশ^রগঞ্জ (ময়মনসিংহ) থেকে আতাউর রহমান : আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে মনোনয়ন প্রতিযোগিতা। সাবেক এমপিদের পাশাপাশি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন নবীনরাও। ফলে জমে উঠেছে প্রবীণ ও নবীনদের মনোনয়ন লড়াই। এই লড়াইয়ে নবীণদেরকে নিয়ে শঙ্খায় রয়েছেন প্রবীণরা। দলীয় মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড ও স্থানীয়ভাবে জনমত গড়ার লক্ষ্যে উপজেলার প্রতিটি গ্রাম ও হাটবাজারে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণায় তৃণমূল নেতাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে উচ্ছ¡াস, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা ভোটারদের মাঝে ফিরতে শুরু করেছে চাঞ্চল্য। এ প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগের ছয়জন, বিএনপির ছয়জন, জাতীয় পার্টি একজন, এলডিপিতে একজন করে প্রার্থী রয়েছে। ইতোমধ্যে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলীয় প্রার্থী হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করে মাঠে নেমে পড়েছেন। ফলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি শোডাউনসহ দান-অনুদান। তারা মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে গ্রামে গ্রামে গিয়ে সর্বস্তরের জনসাধারণসহ দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। কে কাকে ঘাঁয়েল করে নিজের মনোনয়ন নিশ্চিত করবেন, সে প্রতিযোগিতা জমে ওঠেছে এ আসনটিতে।
ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনটি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির এ তিন দলের কাছেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ উপজেলায় মোট ভোটার রয়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার ৭৮৭ জন, পুরুষ এক লাখ ৩৮ হাজার ২৯২ জন ও মহিলা এক লাখ ৩২ হাজার ৪৯৫ জন। এ সংসদীয় আসনটিতে জাতীয় পার্টি তিনবার, আওয়ামী লীগ তিনবার ও বিএনপি তিনবার ও একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় লাভ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ আসনে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল কাদির, ১৯৭৯ ও ১৯৯৬ সালে (১৫ ফেব্রæয়ারি) বিএনপি থেকে অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী (তৎকালীন বস্ত্রমন্ত্রী) মো. হাসিম উদ্দিন, ১৯৮৮ ও ২০১৪ (বর্তমান সংসদ) সালে জাতীয় পার্টি থেকে ফখরুল ইমাম, ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে খুররম খান চৌধুরী, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মো. আব্দুছ ছাত্তার, ২০০১ সালে বিএনপি থেকে শাহ নুরুল কবির শাহীন এমপি নির্বাচিত হন।
একসময়ে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ এ আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট থেকে বর্তমান এমপি (জাপা) ফখরুল ঈমাম আবারো মনোনয়ন পাবেন বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি। আসনটি ধরে রাখতে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডপর্যায়ে কমিটি গঠন করে গণসংযোগ অব্যাহত রাখলেও ভোটবিহীন এমপি হওয়াতে সাধারণ ভোটারদের মাঝে তার অবস্থান কিছুটা দুর্বল।
এদিকে চাচা-ভাতিজার দ্ব›েদ্ব বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ। একদিকে চাচা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শিল্প ও বাণিজ্য-বিষয়ক সম্পাদক সাবেক এমপি আব্দুছ ছাত্তার, অপরদিকে তারই আপন ভাতিজা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান সুমন। দুই জনের মধ্যে পাল্লা দিয়ে চলছে গণসংযোগসহ দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি। কে কার চেয়ে বেশি জনবল দেখাতে পারবেন এ নিয়ে চলছে শোডাউন। সাবেক এমপি আব্দুছ ছাত্তার এ আসন থেকে দুইবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এ উপজেলায় উন্নয়ন কর্মকাÐের প্রথম রূপকার হিসেবে সাধারণ ভোটারদের মাঝে রয়েছে তার আলোচনা। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির পদ লাভের পর উপজেলা সভাপতি পদ হারালে নেতাকর্মীদের সাথে কিছুটা দূরত্ব বাড়ে। এরপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টির এমপি নির্বাচিত করা। তবে দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, আবার তৃণমূল থেকে তিনি দলকে সু-সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আব্দুছ ছাত্তার জানান, সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে এবারো দলীয় মনোনয়ন তিনিই পাবেন বলে দৃঢ় আশা তার। তবে তৃণমূল নেতারা ধারণা করছেন, এবার তার মনোনয়ন ভাগিয়ে নিতে পারেন ভাতিজা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান সুমন। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাÐ ও তরুণ প্রার্থী হিসেবে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে মাহমুদ হাসান সুমনের রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। যথাযথভাবে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে জেলা নেতাদের কাছে তার বেশ সুনাম রয়েছে। মসজিদ, মাদরাসা, মন্দিরসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদানসহ মাঠে ময়দানে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেন, যদি তৃণমূলের জনপ্রিয়তা যাচাই করে মনোনয়ন দেয়া হয়, তা হলে দলীয় মনোনয়ন এবার তিনিই পাবেন। অপর দিকে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট সৌমেন্দ্র কিশোর চৌধুরী দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে নিরিবিলি যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনিই মনোনয়ন পাবেন বলে শতভাগ আশা প্রকাশ করছেন। আওয়ামী লীগের মনোয়নয়প্রত্যাশীদের মধ্যে আরো রয়েছেন বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সদস্য ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিকেলসের পরিচালক অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক, তিনি মসজিদ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাÐে অংশগ্রহণ করায় রয়েছে আলোচনা। এদিকে দলীয় সভানেত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম বিপিএম জানান, একজন প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবারের মনোনয়ন তিনিই পাবেন বলে শতভাগ আশাবাদী। দলটি থেকে আরো মনোনয়ন চাইবেন সাবেক ছাত্রনেতা তরিকুল হাসান তারেক।
এ আসনে বিএনপি থেকে দলীয়ভাবে ছয়জন প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও তৃণমূল নেতারা শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে ভাবছেন দুইজনকে। একজন সাবেক এমপি শাহ নুরুল কবীর শাহীন, অন্যজন তরুণ মেধাবী নেতা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু। ২০০১ সালে এ আসন থেকে নির্বাচিত হন শাহ নুরুল কবীর শাহীন। এমপি থাকাকালীন সময়ে উন্নয়ন ও সুশাসনের কথা সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এখনো উচ্চারিত হয়। তবে নেতাকর্মীদের সাথে সু-সম্পর্ক না রাখায় দলীয়ভাবে হয়েছেন কোণঠাসা। হ্রাস পেয়েছে জনপ্রিয়তা। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আ.লীগের প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন শাহ নূরুল কবীর শাহীন। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে সম্পর্কহীনতা, বিগত উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় নেতাকর্মীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন বলে জানান দলীয় নেতাকর্মীরা। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি বলেন, কিছু নেতাকর্মী রাজনৈতিকভাবে ফায়দা নেয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালায়। আবারো তিনিই মনোনয়ন পাবেন বলে আশা প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে তরুণ নেতা হিসেবে ইতোমধ্যে দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন প্রকৌশলী লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু। দলীয় নেতাকর্মীদের মামলাসহ বিভিন্ন বিপদ-আপদে এগিয়ে যাওয়া, মসজিস-মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান, দুস্থ অসহায় মানুষের সহযোগিতা, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া ইত্যাদি কর্মকাÐের জন্য দল ও দলের বাইরে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠছেন তিনি। সাধারণ ভোটাররা তাকে রাজনৈতিক কর্মকাÐে সম্পৃক্ততাকে আশির্বাদ হিসেবে দেখছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দদের সাথে ভালো সম্পর্ক, উপজেলার তৃণমুল নেতাকর্মীদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা ও গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তাই তার মনোনয়ন পাওয়ার হাতিয়ার। তাই দলীয় মনোনয়ন এবার তিনিই পাবেন বলে শতভাগ আশাবাদী। মনোনয়ন প্রত্যাশী উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আওরঙ্গজেব বেলাল জানান, দীর্ঘদিন যাবত তিনি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এবার মনোনয়ন তিনিই পাবেন বলে আশাবাদী। এদিকে জেলা (উত্তর) যুবদলের সভাপতি কামরুজ্জামান লিটন পোস্টার ও ফেস্টুুনের মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তবে তিনি এবার মনোনয়ন পাবেন বলে জানিয়েছেন। অপরদিকে সাবেক ছাত্রনেতা বর্তমানে সউদী আরব (পশ্চিম) বিএনপির উপদেষ্টা প্রফেসর ড. কাজী মঞ্জুরুল হক সেলিম এবার মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান তিনি। দলটি থেকে আরো মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন সাবেক ছাত্রনেতা শেখ এমদাদুল হক মিলন। তিনি জানান, ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দলের কাজ করে যাচ্ছেন। এবার তিনিই মনোনয়ন পাবেন বলে আশা করছেন।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের এলডিপি থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এম এ বাশার আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থিতা ঘোষণা করে এলাকায় গণসংযোগ ও নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করায় সাধারণ মানুষের কাছে বেশ আলোচিত হয়ে ওঠেছেন। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের পক্ষে তিনিই মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী। যেই আসুক মাঠের লড়াই হবে ২০ দলীয় জোট ও মহাজোটের মধ্যেই, আর জোটগত নির্বাচন হলে এ আসন থেকে মহাজোটের পক্ষ থেকে মনোয়নয়ন পেতে পারে জাতীয় পার্টি। সে ক্ষেত্রে এ আসনে আওয়ামী লীগের কপাল পুড়লেও সহজেই বিজয় কেড়ে নিতে পারবে বিএনপি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন