ইলিশ প্রজননের সঠিক সময় কোনটি এ প্রশ্নের উত্তর মিলছেনা। নিষেধাজ্ঞার উঠে গেছে। জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ। গত ১ অক্টোবর থেকে ২২ দিন নিষেধাজ্ঞার সময়ে বাংলাদেশের পদ্মা-মেঘনার সুস্বাদু ইলিশের মেলা বসেছে ভারতের গঙ্গা পাড়ে। বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তর এবং মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয় এই বিষয়ে এখনো অন্ধকারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমন্বয়হীনতাই এর জন্য দায়ী।
জানা গেছে, যে সময়ে বাংলাদেশের সাগর, মোহনা ও নদীগুলোতে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রনালয় এবং মৎস্য অধিদপ্তর ইলিশ প্রজণন সময় নির্ধারণ করে মা ইলিশ রক্ষায় মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, ঠিক সে সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মিলেছে ফারাক্কার গঙ্গা নদীতে। সেখানের জেলে মৎস্যজীবী, পাইকার, ক্রেতা-বিক্রেতাদের মিলনমেলা বসেছে প্রতিদিন গঙ্গা নদী পাড়ে। গঙ্গাপাড়ে ইলিশের এ মেলা অতীতে কখনো দেখা মেলেনি। সেখানকার স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ী মানিক চন্দ্র দাস জানান, নিমতিতার গঙ্গা থেকে বেরিয়েছে পদ্মা। সেই বাঁকা পথেই বাংলাদেশের ইলিশের ঝাঁক ঢুকেছে ফারাক্কায়। গত এক সপ্তাহ থেকে ফারাক্কা ব্যারেজের উজানে ১৫ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশের ঢল নেমেছে। অসময়ে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ায় মহাজনদের ভিড় জমেছে গঙ্গা পাড়ে। মৎস্যজীবীদের কাছ থেকে ৭শ’ থেকে ৮শ’ গ্রাম সাইজের ইলিশ পানির দামে ক্রয় করছেন আড়তদাররা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ইলিশ ক্রয় করতে এলাকার সাধারন মানুষ ভিড় জমাচ্ছে ফারাক্কার গঙ্গা নদীর পাড়ে। মানিক দাস আরো জানান, প্রচুর ইলিশের দেখা মিলতেই শত শত মৎস্যজীবী ধুলিয়ান, হাজারপুর, অর্জনপুর, মহেশপুর এলাকায় গঙ্গায় নেমে পড়েছে। ঐ সময় ওপার বাংলায় ইলিশ ধরা বেআইনী ছিল কিন্তু জেলেদের বক্তব্য এসব ইলিশ বাংলাদেশের। এ দেশের মাছতো ধরা পড়ছে না। নিউ ফারাক্কার বøক অফিসের পাশেই পাইকারি মাছের বাজার সেখানেও ইলিশের ঢল নেমেছে। মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ জানান, সাধারন সময়ে ফারাক্কার বাজারে প্রতিদিন ইলিশ আসতো ৪-৫ মণ। গত এক সপ্তাহে এ পরিমাণ বেড়ে দাড়িয়েছে হাজার থেকে দেড় হাজার মণে। এসব ইলিশের বেশীরভাগের ওজন ৫শ’ থেকে ৮শ’ গ্রামের নিচে। প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে দু’শ টাকা। ৪শ’ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে। তিনি আরো জানান এ সময় বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশের ঝাঁক বাংলাদেশের পদ্মা-মেঘনায় মিঠা পানিতে ডিম ছাড়তে আসে। এসব মাছ কোন কারণে ফারাক্কার গঙ্গায় চলে এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. সুভাষ চন্দ্র চক্রবর্তী ইনকিলাবকে বলেন, বন্যার কারণে ফারাক্কার গেটগুলো খুলে দেওয়ায় পানি ওভার ফ্লো হয়ে পদ্মা-মেঘনা হয়ে সাগরে যায়। মা ইলিশ এই স্রোতের বিপরীতে এসে ডিম ছাড়ছে। এই সময় নদীর পানির ফ্লো ছিল বেশী যে কারনে পদ্মা-মেঘনার মিঠা পানির ইলিশ ঢুকে পড়েছে ফারাক্কার গঙ্গায়। নিষেধাজ্ঞা শেষে গত তিন দিনে মা ইলিশ ধরা পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন একজন গর্ভবতী মা যথাসময়ে সন্তান প্রসব নাও করতে পারেন। কারন এর দিনক্ষন ১০ দিন আগে পরে হতে পারে। একই প্রবণতা মা ইলিশের ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু মাছ অর্ধেক ডিম ছেড়েছে আবার কোন মাছ ডিম ছাড়েনি। এক্ষেত্রে ১০ দিন আগে ও পরে হতে পারে। ধরা পড়া ইলিশের পেট লুজ থাকে এর অর্থ হচ্ছে সে পুরোপুরি ডিম ছাড়তে পারেনি।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. হারুনুর রশীদ বলেন প্রজণন ঋতু নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছের জিএসআই পরিমান পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। জিএসআই হলো ডিমের ওজন ও দেহের ওজনের অনুপাতের শতকরা হার। সাধারনত প্রজনন ঋতুতে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়ে গত ৫ বছরের জিএসআই এর পরিমাপ থেকে জানা গেছে বাংলাদেশে ইলিশ সাধারনত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত প্রজণন করে। সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে জিএসআই ১০-১১ থেকে বেড়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে এসে সর্বোচ্চ ১৫-১৭ পর্যন্ত পৌছায়। নভেম্বরে সেটা হঠাৎ করে কমে যায়। ১৫-১৭ জিএসআই ইলিশের ভরা প্রজণন মৌসুম নির্দেশ করে।
সব ধরনের ইলিশ ধরার উপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা শেষ হয়েছে। এরপর গত তিন দিন ধরে জেলেরা নতুন উদ্যমে ইলিশ ধরা শুরু করেছে। তাদের জালে ধরা পড়ছে বড় বড় ইলিশের ঝাঁক। এদের মধ্যে অধিকাংশই মা ইলিশ। যে সব ইলিশের পেটে রয়েছে ডিম। ইলিশের ডিম পাড়ার মৌসুম শেষ হলেও মা ইলিশের পেট ভর্তি ডিম দেখে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে মৎস্য বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেছেন, ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা সময়সীমা ২২ দিনের বেশী বাড়ানো যায় কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে। মৎস্য গবেষকরা বলেছেন, বিশেষ করে জেলেদের এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত ও গবেষণা করেই অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে ইলিশ প্রজননের মৌসুম ধরা হয়েছে। এটা নিয়ে আরও গবেষণারও প্রয়োজন রয়েছে।
এদিকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর জেলেরা নতুন উদ্যমে নেমে পড়েছেন নদীতে। তাদের জালে ধরা পড়া ইলিশ দেশের প্রতিটি মাছের বাজারে। ঢাকার কারওয়ান বাজারে মাছের আড়তদার মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন ইলিশ আগের চেয়ে অনেক সস্তা। কারন হিসেবে তিনি বলেন, এখনো ইলিশের পেটে ডিম রয়েছে। এছাড়া ডিম ছাড়ার পর মা ইলিশের স্বাদ কম থাকায় এর চাহিদাও কম।
মৌসুমের পরে ইলিশের পেট ভর্তি ডিম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ইলিশ প্রজণন শাখা) মাসুদ আরা মমি ইনকিলাবকে বলেন, অক্টোবর মাস শেষ হলেও মা ইলিশের পেটে ডিম থাকতেই পারে। কারণ আমাদের দেশের ইলিশের মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তারা সারা বছরই ডিম ছাড়ে। তবে মূল মৌসুমে কত পরিমাণ ইলিশ ডিম ছাড়ল সেটাই বিষয়। ইলিশের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে, একটি মা ইলিশ গড়ে ২৩ লাখ ডিম ছাড়ে। তবে একসাথে তারা সব ডিম ছাড়ে না। কখনও অর্ধেক আবার কখনও থেমে থেমেও ডিম ছাড়ে। তবে গড় ডিমের অর্ধেক সংরক্ষণ করতে পারলেই যথেষ্ট। এসব ডিমের জাটকাগুলো রক্ষা করার দিকে নজর দিতে হবে। এক সময় মা ইলিশ ধরার উপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। ইলিশ যেই সময়ে বেশী পরিমান ডিম ছাড়ে সেটিকেই মৌসুম ধরা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে অক্টোবরের প্রথম দিকেই তারা বেশী ডিম ছাড়ে। প্রথম দিকে ১১ দিনের জন্য ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। গত বছর থেকে সরকার ১১ দিনের পরিবর্তে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা বহাল করেছে। মনে হয় এটিই সঠিক সময়। সারা বছরতো আর নিষেধাজ্ঞা রাখা যাবে না।
ভারতের ফারাক্কার গঙ্গায় পদ্মার ইলিশের জাটকা ধরা পড়া প্রসঙ্গে মাসুদ আরা মমি আরো বলেন, গঙ্গায় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশের জাটকা ধরা পড়ার বিষয়টি এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। এ বছরেই বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। পত্রিকায় প্রকাশের পর মৎস্য বিভাগ বিষয়টি আমলে নিয়েছে। এর উপরে গবেষণা চলবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন