জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর আহ্বান এবং চাপ সত্তে¡ও বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার নানা টালবাহানা করছে। এ ইস্যুতে দেশটি একেক সময় একেক অজুহাত দেখাচ্ছে। শুরুতে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে বলে বললেও এখন তা বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে, এমনকি সুপারিশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঘঁষামাজা করছে। গত ২৩ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মিয়ানমার সফর করেন। সফর শেষে তিনি জানিয়েছেন, আনুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে ১০টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও মিয়ানমার একতরফাভাবে আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিষয়টি বাদ দিয়েছে। সফরে তিনি মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেনেন্ট জেনারেল কাইও সোয়ের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি অং সান সু চির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। আসাদুজ্জামান খান কামাল একটি দৈনিকের সাক্ষাৎকারে সফর নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। তাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মাণ হয়, এ সফর থেকে ফলপ্রসূ কোনো অর্জন নেই। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, আন্তর্জাতিক চাপ সরলে মিয়ানমার কিছুই করবে না। আক্ষরিক অর্থেই বোঝা যাচ্ছে, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক কোনো আহŸান কিংবা চাপকেই তোয়াক্কা করছে না।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধ ও স্বদেশ ভূমিতে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে গত বৃহস্পতিবার টেলিফোন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। তিনি রাখাইনে সহিংসতা ও রোহিঙ্গা নিধন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাকিদ দিয়েছেন। মিয়ানমারের জেনারেলকে টিলারসনের ফোন করার মধ্য দিয়ে এটাই স্পষ্ট হয় যে, রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যায় দেশটির সেনাবাহিনীই মূলত দায়ী এবং সেই হিসেবেই আসল ব্যক্তিকেই তিনি ফোন করেছেন। নরঘাতক সেনাবাহিনীর সাথে সেখানের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরাও যুক্ত। আন্তর্জাতিক এত অনুরোধ, আহŸান এবং চাপ সত্তে¡ও রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়ন থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এক চুলও সরে আসেনি। বরং রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় এবং তারা বাঙালি এ সিদ্ধান্তে অটল রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক চাপ ও বিশ্ব জনমতের কারণে দেশটি মাঝে মাঝে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেব-নিচ্ছি বলে বিবৃতি দিলেও, বাস্তবে তার কোনো উদ্যোগ নেই। দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চির বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে উঠলেও তার কোনো বিকার নেই। তার নিস্ক্রিয় ও নীরব ভূমিকা প্রমাণ করে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তা তিনি সমর্থন করেন। অথচ রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে তার যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তা তিনি করেননি। বলা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘কলের পুতুল’ হয়ে আছেন তিনি। এদিকে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের কীভাবে ফিরিয়ে নেবে, এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সাথে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রæপ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই ওয়ার্কিং গ্রæপের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু করার কথা রয়েছে। মিয়ানমারের বর্তমান আচরণ থেকে প্রতীয়মাণ হচ্ছে, সে এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরেও যেসব আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সেখানে কেবল যুক্তি-পাল্টা যুক্তির বিষয়টি উঠে এসেছে। মিয়ানমার এটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে, যদিও মুখে বলছে, তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। সু চি আশ্বাস দিয়েছেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার পর, তারা যাতে বাংলাদেশে আর না আসে এ ব্যবস্থা করবেন। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আশাপ্রদ কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
অনির্দিষ্ট কাল ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ বোঝা অত্যন্ত চাপ হয়ে উঠতে পারে। শুরুতে বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ত্রাণ ও অনুদান এসেছে, তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। যতই দিন যাবে রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের পুরো দায় বাংলাদেশের উপর এসে পড়বে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার আন্তর্জাতিক চাপও কমে আসবে। বিষয়টি আড়ালে চলে যাবে। আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্তে¡ও মিয়ানমার কালক্ষেপণের এ কৌশলই অবলম্বন করে চলেছে। বলা যায়, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেশটি অনেকটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাকে বাধ্য করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আনান কমিশনের সুপারিশের আওতায় রোহিঙ্গাদের নিরপদে ফিরিয়ে নেয়া এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশকেও জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনী টানবাহানাকারী ও ওয়াদাভঙ্গকারী হিসাবে ইতোমধ্যে নিজেদের পরিচয় সুনির্দিষ্ট করেছে। তাদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ-আলোচনায় সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর অবস্থান ও পদক্ষেপই বেকল এই সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান নিশ্চিত করতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন