শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

রিজার্ভ থেকে অর্থচুরি নজিরবিহীন

প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার ‘চুরি’ হয়ে গেছে। এ ঘটনা বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা এখন ফিলিপাইনের ক্যাসিনোর জুয়ার আসর থেকে চলে গেছে ভিন্ন গন্তব্যে। এটা আমাদের জন্য যেমন লজ্জার, তেমনি ব্যর্থতার। সরকার ও অর্থমন্ত্রীর কাছে অবশ্যই এ বিষয়ে একটা সঠিক ব্যাখ্যা দেশ ও জাতি দাবি করে।
ইতোমধ্যে নৈতিক দায় স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেছেন। দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার-খ্যাত বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবিরকে। এত বড় রিজার্ভ চুরির ঘটনা বাংলাদেশ তথা বিশ্বে যেমন নজিরবিহীন, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে একদিনে এত ব্যাপক রদবদলও নজিরবিহীন। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ঘটনার নেপথ্যের নায়কদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা না করে শুধু পদত্যাগ, অব্যাহতি, ওএসডি প্রাথমিক একটি পদক্ষেপ হতে পারে কিন্তু এটাই সমাধান নয়। লুট হওয়া টাকা ফেরত আনা এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। না হলে ভবিষ্যতেও এমন ঘটনার আশঙ্কা থেকে যাবে।
এই বিপুল পরিমাণ টাকা চুরির ঘটনা ঘটে ৪/৫ ফেব্রুয়ারি। এ সম্পর্কিত খবর ফিলিপাইনের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ইনকোয়েরে’র গত ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি চলে আসে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকে ২৩ ফেব্রুয়ারি বোর্ড সভা, ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ অডিট কমিটির সভা হয়েছে। কিন্তু কোন সভাতেই বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের এ রহস্যজনক আচরণে সন্দেহের ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। পত্রিকা পড়ে জেনেছেন অর্থমন্ত্রী। ঘটনা আড়ালের চেষ্টা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।’ অসন্তোষ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেন। অর্থ সচিবতো নয়ই; এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকেও ভয়ঙ্কর চুরির ঘটনাটি জানানো হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, তদন্তের স্বার্থে কৌশল হিসেবে গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ভিতরের কেউ ছাড়া এতো বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির ঘটনা ঘটা অসম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারগুলোতে ম্যালওয়ারসহ বিভিন্ন ভাইরাস প্রতিরোধে ফায়ারওয়াল-ইউটিএমের মতো সিস্টেমও ছিল। কিন্তু সন্দেহভাজনরা যে পিসি ব্যবহার করেছে সেখানে ফায়ারওয়াল-ইউটিএম নিষ্ক্রিয় (ডিঅ্যাক্টিভেটেড) করা ছিল।
সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে জারিকৃত সার্কুলারে ভারতীয় নাগরিক বিশ্বব্যাংকের সাইবার বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানার মৌখিক পরামর্শে বর্তমান নতুন সফটওয়্যার সংযোজন করা হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য নতুন এ সফটওয়্যার সরবরাহও করবেন রাকেশ আস্তানা। রাকেশ আস্তানার মৌখিক পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সকল বিভাগ, ইউনিটে ও সার্ভারসমূহে তার সরবরাহকৃত সফটওয়্যার (সিকিউরিটি প্যাচ) ইনস্টল করা হচ্ছে। তবে রাকেশ আস্তানার পরামর্শে এবং তারই সরবরাহকৃত নতুন সফটওয়্যার ইনস্টলের আদেশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারা নিরাপত্তার পরিবর্তে দেশের আর্থিক খাতে নতুন করে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি রাকেশ আস্তানা বলেছেন, যতটুকু দেখেছি মনে হয়েছে এটা আনঅথোরাইজড ট্রানজেকশন। বাইরে থেকেই এ হ্যাকিং করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কারও যোগসাজশ আছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা ফেডারেল রিজার্ভের ব্যাপার। যারা এটা সেখানে হ্যান্ডেল করেন তাদের কোনো গোলমাল হয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ কোনমতেই তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবে না। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন দোষ নেই।’ রাকেশ আস্তানা ও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, যুবক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ‘লুণ্ঠন’ ও জালিয়াতিতে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও শাসকদলের নেতৃবৃন্দসহ রাঘববোয়ালদের নাম উঠে আসলেও তাদের বিচার না হওয়ায় লুটপাটের ঘটনা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। লোক দেখানো তদন্ত ও কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতার কারণেই ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাটের ঘটনায় দেশের আর্থিক খাতে ধস নামবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা। সমস্ত ব্যাংক আজ ফোকলা হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আর্থিক খাত ভেঙ্গে পড়বে।
বলা হচ্ছে, সুইফট নেটওয়ার্ক হ্যাক করে টাকা চুরি করা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত সুইফট নেটওয়ার্ক হ্যাক হওয়ার কোন নজির নেই। টাকা লেনদেনের অর্ডার পাস করার ক্ষেত্রে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয় সেগুলো খুবই নিয়ন্ত্রিত। একটি নির্দেশনা দিতে গেলে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫টি স্থান থেকে কনফার্মেশন নিতে হয়। তাই এই টাকা চুরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত নন তা একেবারে অবিশ্বাস্য। ধাপে ধাপে একাধিক স্তরে দায়িত্বশীলরা জড়িত ছিলেন বলেই মনে হয়। একই সঙ্গে ওইসব নির্দেশনা দিতে যে কোড ব্যবহার করা হয় তা ওই কম্পিউটার ছাড়াও নেবে না।
৮শ’ কোটি, ৪ হাজার কোটি বা ৫ হাজার কোটি লুট হলেও এ অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে কিনা বলা মুশকিল। এখন লুটপাট এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে, মানুষের বোধ নেই- এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। মানুষের টাকা ব্যাংকের এটিএম কার্ড থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে। সম্পত্তির নিরাপত্তা, জীবনের নিরাপত্তা কোথাও নেই। এটিএম বুথের টাকা চুরি হওয়ার পর ব্যাংকগুলোকে কঠোর নজরদারি ও নিরাপত্তার কথা বলা হলেও কর্তৃত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভই অনিরাপদ!
এ অবস্থা চলতে থাকলে টোটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংকটের মুখে পড়বে। এই অশান্তি, অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের হতে হবে সৎ, চরিত্রবান, দায়িত্ববান এবং বিশ^স্ত। পাশাপাশি আধুনিক এবং প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ। তা না হলে আমরা যতই আধুনিক এবং প্রগতিশীল হই না কেন, দুর্নীতি এবং ব্যাংকের অর্থ চুরি কোনটাই বন্ধ হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন