রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বঙ্গে প্রথম বোখারী শরীফ পড়ান সোনারগাঁয়ে শেখ আবু তাওয়ামা

কে এস সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

(১৫ জানুয়ারি প্রকাশিতের পর)
সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত এবং তৎকালীন ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও পূর্বপাক জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সেক্রেটারী জেনারেল আলহাজ মাওলানা ওবাইদুল হক সংকলিত এবং ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থে লেখক যমিরুদ্দীন আহমদ কৃত ছিরাতুশ শরফ নামক পুস্তকের ৪৫ পৃষ্ঠার বরাতে প্রদত্ত তথ্যটি পরিবেশিত হয়েছে। এতে আরো জানা যায় যে, শেখ শরফ উদ্দীন আবু তাওয়ামা তাঁর পরিবারবর্গসহ দিল্লী ত্যাগ করেন এবং তাদের মধ্যে স্বীয়ভ্রাতা মাওলানা হাফেজ মঈনুদ্দীনও ছিলেন। ছিরাতুশ শরফের বর্ণনায় শেখ আবু তাওয়ামার যে পারিবারিক পরিচিতি রয়েছে তা অন্য কোনো গ্রন্থে বা লেখায় দেখা যায় না, পরিবারবর্গসহই তিনি দিল্লী ত্যাগ করেন।
শেখ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামা কোন তরিকার সাধক ছিলেন সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও ডক্টর আবদুল করিমের পুস্তিকা বাংলার সুধী সমাজে তার কিছুটা আভাস রয়েছে। তিনি পঞ্চদশ শতকের জৈনপুরের বিখ্যাত সূফী মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী কর্তৃক জৈনপুরের শর্কী সুলতান ইবরাহিম শর্কীর নিকট লিখিত একখানি পত্রের বরাতে উল্লেখ করেছেন যে, নরকটিতে শেখ আহমদ দামেস্কীর কয়েকটি বিখ্যাত শিষ্য আছেন। কদরখানী তরীকার বারজন প্রধান সূফীর অন্যতম হযরত শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামা (যার প্রধান শিষ্য শেখ শরফউদ্দীন মানেরী) সোনারগাঁয়ে সমাহিত আছেন। (পৃ: ১০)
শেখ আবু তাওয়ার দিল্লী হতে সোনারগাঁয়ে আগমনের কাহিনীটি চমৎকার। তার সপরিবারে দিল্লী ত্যাগ করে সঙ্গে সোনারগাঁয়ে উপনীত হতে যথেষ্ট সময় লেগেছে। কেননা পথিমধ্যে তাঁকে এক স্থানে কিছুদিন অবস্থান করতে হয় এবং সেখানে এমন এক সাধকের আতিথ্য গ্রহণ করতে হয়, সাধক হিসেবে যার বিশাল খ্যাতি ছিল এবং যার পুত্র আবু তাওয়ামার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পরবর্তীকালে সুখ্যাতির শির্ষে পৌঁছে ছিলেন। ঘটনাটি নি¤œরূপ বর্ণিত হয়ে থাকে :
সুলতান বলবনের নির্দেশে আল্লামা হযরত মাখদুম শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামা (র:) সপরিবারে দিল্লী হতে সোনারগাঁ আসার পথে বিহারের মানের নামক স্থানে হযরত শরফউদ্দীনের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি মাখদুমে জাহান নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি শেখ আবু তাওয়ামাকে বিশেষভাবে সেবাযতœ করেন। ফলে দুই সাধকের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। উল্লেখ্য, শেখ ইয়াহিয়া মানেরী ছিলেন শরফউদ্দীনের পিতা। আবু তাওয়ামার জ্ঞানগরিমা ও ব্যূৎপত্তিতে মুগ্ধ হয়ে ইয়াহিয়া মানেরীর বালক পুত্র শরফউদ্দীন তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং পিতার অনুমতিক্রমে তিনি শেখ আবু তাওয়ামার সাথে সোনারগাঁয়ে চলে আসেন। এটি হিজরী ৬৬৮ মোতাবেক ১২৭০ খ্রিস্টাব্দের কথা।
সোনারগাঁয়ে তার আগমনের তারিখ সম্পর্কে মতভেদ আছে। ডক্টর আব্দুল করিম এ মতভেদ দূর করার চেষ্টা করেছেন এইভাবে :
সৈয়দ আবদুল হাই এর নুজহাত উল খাওয়াতীর গ্রন্থ অবলম্বনে ডক্টর মুহাম্মদ ইসহাক মনে করেন যে, শেখ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামা সুলতান সামসউদ্দীন ইলতুতমিশের আমলে (১২১০-১২৩৬) সোনারগাঁয়ে আগমন করেন। ডক্টর সগীর হাসান আন মাদুরী মানাকিবউল আসফিয়া নামক গ্রন্থ অবলম্বনে বলেন যে, যেহেতু শেখ শরফউদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরী ১২৬৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং যেহেতু তিনি ৬/৭ বৎসর বয়ক্রমকালে তাঁর শিক্ষক শেখ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামার সাথে সোনারগাঁয় আগমন করেন সেহেতু শেখ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামা এবং শেখ শরফউদ্দীন ইয়াহয়া মানেরী ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবনের আমলে সোনারগাঁ আগমন করেন। ডক্টর মুহাম্মদ ইসহাকের মত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তার প্রধান সূত্র নুজহাত উল খাওয়াতীর গ্রন্থ সাম্প্রতিককালে দক্ষিণাত্যের হায়দরাবাদ হতে প্রাণীত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং এর সাক্ষ্য সমসাময়িক গ্রন্থ “মানাকীব উল আসফিয়ার সাক্ষ্যের পরিপন্থী। কিন্তু সগীর হাসান সাহেবের মত ও পুরাপুরি গ্রহণযোগ্য নয় কারণ শেখ শরফউদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরীর সোনারগাঁ আমনের সময়কার বয়স সম্পর্কিত তাঁর উক্তি বা অভিমত তার সূত্র মানাকিব উল আসফিয়া কর্তৃক সমর্থিত নয়। মানাকিব উল আসফিয়ায় পরিষ্কার উল্লেখিত আছে যে, শেখ শরফউদ্দীন ইয়াহিয়া “বয়প্রাপ্ত হলে এবং বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে কিছু ব্যুৎপত্তি লাভ করার পরও তিনি শেখ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামার সাক্ষ্যৎ পান এবং তাঁর সাথে সোনারগাঁ আগমন করেন। সুতরাং বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে, সোনারগাঁ আগমনকালে শেখ শরফউদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরীর বয়স অন্তত পক্ষে ১৫/২০ বছরের কম ছিল না। ১২৬৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হলে ১২৭৮-১২৮৩ খ্রিস্টাব্দের আগে তিনি সোনারগাঁ আসতে পারেন না। সোনারগাঁয় মুসলমান শাসনের বিবরণ প্রদানের পর ডক্টর করিম বলেন, সুতরাং মনে হয়, ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে (সুলতান বলবন যখন বাংলাদেশ আক্রমণ করেন) তখন থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে শেখ শরফউদ্দীন আবু তওয়ামা সোনারগাঁয়ে আগমন করেন। (পৃ: ২০-২১)
সোনারগাঁয় আগমনের পর শেখ আবু তাওয়ামার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তাঁর পরিবারবর্গের মধ্যে তাঁর পুত্র মওলানা হাফেজ মঈনুদ্দীনও ছিলেন। তাঁর ভূমিকা সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই। তাছাড়া শেখ শরফউদ্দীন ইয়াহিয়া  মানারীর সাথে শেখ আবু তাওয়ামার কন্যার বিয়ে হয়েছিল বলেও বিবরণ হতে জানা যায় কিন্তু তাদের কোনো সন্তানাদি ছিল কিনা সে ব্যাপারেও ইতিহাস নীরব। অবশ্য শেখ আবু তাওয়ামা সোনারগাঁয় অবস্থান করে ইসলামী শিক্ষা ও ইসলাম প্রচারে যে অবদান রাখেন তার বিক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। শেখ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামা ছিলেন একজন হানাফী ফকীহ আলেম এবং রসায়ন শাস্ত্রেও ছিল তাঁর অগাধ পা-িত্য। তিনি সোনারগাঁয়ে আগমনের পর সেখানে স্থায়ী আস্তানা তথা খানকাহ স্থাপন করেন এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি শিষ্যদের জন্য একটি আলাদা খানকাহ এবং ছাত্রদের জন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এভাবে দেশ-বিদেশ থেকে বহু ছাত্র ও সাধক সোনারগাঁয়ে আসতে থাকেন। অচিরেই সোনারগাঁ ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার একটি কেন্দ্র পরিণত হয়ে যায়।
মাওলনা ওবাইদুল হক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বাংলাদেশের পীর-আউলিয়াগণে বলেন, তিনি শুধু তাছাউয়াফ সাধনা কিংবা ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, রসায়ন শাস্ত্র, প্রকৃতি বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়েও তাঁহার পা-িত্ব প্রতিভার তুলনা ছিল না। বর্তমান ঢাকা জিলার সোনারগাঁয়ে অবস্থিত তাঁর খানকাহ থেকে শিক্ষা লাভ করে মখদুম মাওলানা শরফউদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরীর মত জগদ্বিখ্যাত দরবেশের অভ্যুদয় সম্ভবপর হয়েছিল। তিনি সোনারগাঁয়ে একটি বিরাট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সেকালে সোনারগাঁয় কেবল বাংলা নয় সমগ্র পাক-ভারতেই শিক্ষার সংস্কৃতির বড় কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলার মুসলিম সমাজ গঠনে এই মহাজ্ঞানী সাধনের অবদানের সত্যি তুলনা হয় না। -(পৃ ঃ ৪১৪)
মাওলানা ওবাইদুল হক শেখ আবু তাওয়ামা রচিত একটি কিতাবেরও উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, মখদুম সাহেব তাঁহার লিখিত খানেপুর নেয়ামত কিতাবের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে লিখিয়াছেন, মাওলানা শরফউদ্দীন আবু তওয়ামা একজন বড় আলেম ছিলেন এবং সমস্ত ভারতবর্ষের লোক তাঁহাকে সম্মান করিতেন, তাহার জ্ঞান ও এলেম সম্পর্কে দ্বিমত ছিল না। নামে হক কিতাবটি তাহারই রচিত। পৃ : ৪১৩।
মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী তাঁর হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাসÑ এ বঙ্গে ইসলাম প্রচার ও হাদীস শিক্ষা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথম যুগে যাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে হজরত শাহ জালাল তাবরেজীর পর দ্বিতীয়  নম্বরে শায়খ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামার নাম (মৃত: ৭০০ হি: মো: ১৩০০ইং) উল্লেখ করছেন। লেখক তাতে শেখ আবু তাওয়ামার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রদান করেছেন। লেখকের মতে তিনি হিজরী ৬৬৮ মোতাবেক ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে আগমন করেন। আর তিনি একটি মাদ্রাসা ও খানকাহ স্থাপন করেন। জীবনের শেষ অবধি তিনি তথায় হাদীস তফসীর প্রভৃতি এলেম ও মারফতের আলো বিস্তারে ব্রতী থাকেন। শেখ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা সংস্কৃতি, তাহজীব-তমদ্দুম প্রভৃতি দিক থেকে সোনারগাঁকে প্রকৃতই সোনারগাঁয়ে পরিণত করেছিলেন বলে আধুনিক গবেষকগণ মনে করেন। শেখ আবু তাওয়ামা প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রটিকে সীমিত ও প্রচলিত অর্থে মাদ্রাসা বলে আখ্যায়িত করা হলেও সেকালে এটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমর্যাদার অধিকারী ছিল। সোনারগাঁয়ের এ জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষাগতমান ও মর্যাদা তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের তথা ইরাকের বাগদাদ, মিশরের আল-আজহার, মরক্কোর ফেজ, মালীর তিম্বুকতু এবং স্পেনের সেভিল, কর্ডোভা ও গ্রানাডা মাদ্রাসার সমপর্যায়ের ছিল বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং তৎকালীন বাংলাদেশের অন্য মাদ্রাসাগুলোরও একই অবস্থা ছিল।
সোনারগাঁ মাদ্রাসার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে শেখ আবু তাওয়ামা প্রতিষ্ঠিত এ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও ফারসী ভাষায় লিখিত মুসলিম প-িত মনীষীদের প্রন্থাবলী ও অন্যান্য মুসলিম দেশের শিক্ষায়তনে পড়ানো হত তাই নয়, এদেশীয় মনীষীদের লেখা গ্রন্থাবলীও পড়ানো হতো বলে গবেষকদের রচনাবলী হতে জানা যায়। বর্তমান বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ইতিহাসবিদ মরহুম ফারুক মাহমুদের ভাষায়Ñ
পনের শতকের বিশ্ব বিখ্যাত সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা কর্তৃক সহি বোখারীর হাদিসমালা গ্রন্থের উপরে রচিত ভাষ্য গ্রন্থখানির একটি পা-লিপি বাগদাদের গ্রন্থাগারে এখনো সযতেœ রক্ষিত আছে। বাবু বুদ্ধিজীবীর কল্যাণে বাঙালি মুসলমানেরা আবু তাওয়ামার নাম ভুলে গেলেও মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৮০ সাল দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক (মরহুম) আখতার উল আলম বাগদাদের গ্রন্থাগারে শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার লিখিত পা-লিপিটি দেখতে পান। দেশে ফিরে ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ (মরহুম)কে সঙ্গে নিয়ে আখতার-উল-আলম সোনারগাঁয়ের এক অবহেলিত পল্লীতে লতাগুলোর জঙ্গল সাফ করে শেখ আবু তাওয়ামার কবর জিয়ারত করেন। অনেক কষ্টে উদ্ধার করেন বৃটিশ প্রতœতত্ত্ব বিভাগের ১৯০৪ সালের সংরক্ষণ ফলক সম্বলিত সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ও তাঁর কিংবদন্তী খ্যাত বিচারক কাজী সিরাজের সমাধি। (ইতিহাসের অন্তরালে পৃ: ১০৯)
প্রতি বছর ১২ মাঘ শেখ শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামার ওমর মহাসমারোহে উদযাপিত হয়ে থাকে। (সমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন