শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মায়ের দুধের বিধান: ইসলাম ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে

মাও: গোলাম কিবরিয়া রাকিব | প্রকাশের সময় : ৮ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইসলাম শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ বিষয়ে কুরআনুল কারীমের সূরা বাক্বারার ২৩৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন -“মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ন দুই বছর দুধ পান করাবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা লুকমান এর ১৪ নং আয়াতে এ ব্যাপারে আরো ইরশাদ করেন -“ আমিতো মানুষকে তার পিতা মাতার প্রতি সদাচরনের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারন করে। এর পর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে” সূরা আহকাফ এর ১৫ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে -“তাকে গর্ভ ধারন করতে ও দুধ ছাড়াতে লাগে এিশমাস।
সূরা কাসাস এর ৭নং আয়াতে বর্নীত হয়েছে - “আমি মুসার মায়ের অন্তরে ইঈিতে নির্দেশ দিলাম তাকে দুধ পান করাও। উপরোক্ত বর্নীত আয়াত সমূহ থেকে বোঝা যায় যে, শিশুকে পূর্ণ দুই বছর মায়ের দুধ পান করাতে পারবে। প্রয়োজনে আরো ছয়মাস সময় বাড়ানো যেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বলা আছে যে, শিশুকে কম বেশি দুই বছরই দুধ পান করানো উচিত। মা ও শিশুর শারীরিক অসুস্থতার অবস্থায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিশুকে বুকের দুধ পান করানো থেকে বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফের ২য় খন্ড ৮৯১৬ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের সন্তানদের দেহপসারিনী ও পাগলিনীর দুধ পান করানো থেকে বিরত রাখ। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে জানা যায় দেহপসারিনী ও পাগলীনির দুধ পানে শিশু ‘হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এমনকি এইডস ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মায়ের দুধ পান করানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করে রাসূল (সা:) আরো ইরশাদ করেছেন যা নিহায়াফি গরীবিল হাদিস গ্রন্থের ৩য় খন্ডের ১৬২ নং পৃষ্টায় উল্লেখ রয়েছে- আল্লাহ মুসাফিরদের উপর থেকে চার রাকআত বিশিষ্ট নামাজের অর্ধেক রহিত করে দিয়েছেন। আর মুসাফির স্তন্যদানকারী ও গর্ভবতী মহিলা থেকে রমযানে রোজা রাখার বাধ্যবাধকতাও উঠিয়ে দিয়েছেন।আমিরুল মু’মিনিন হযরত ওমর ফারুক (রা:) এর শাসন আমলের প্রথম দিকে যেহেতু মাতৃদুগ¦ পানরত শিশুরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আর্থিক অনুদান পেত না সেহেতু মায়েরা শিশুদের জন্য অনুদান পাওয়ার আশায় তাড়াতাড়ি বুকের দুধ ছাড়িয়ে দিতেন।এ অবস্থা লক্ষ করে হযরত ওমর (রা:) শিশুদেরকে বুকের দুধ দানে মায়েদের উৎসাহিত করার লক্ষে জন্মের পর থেকেই এই আর্থিক অনুদান চালু করেন।
এ কথা নিদ্বিধায় বলা যায়, আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞান শিশুকে মাতৃদুগ্ধ দানের ব্যাপারে যে গুরুত্বের কথা বলছে সে গুরুত্বের কথা ইসলাম আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বেই ঘোষনা করেছে। আজকে বিশ্বব্যাপী মাতৃদুগ্ধ পানের ব্যাপারে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এমনকি বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর পহেলা আগষ্ট।“বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস” পালিত হচ্ছে তা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। শিশুর জন্য মায়ের দুধ অপরিহার্য। মায়ের বুকের দুধ হচ্ছে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানযুক্ত আল্লাহ প্রদত্ত এমন তৈরি খাবার যা শিশু সহজেই হযম করতে পারে এবং শিশুর শরীর সহজেই কাজে লাগিয়ে দেহের বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিশুর শরীর- দেহের খাদ্য চাহিদার যে পরিবর্তন ঘটে মায়ের বুকের দুধের উপাদানে অনুরুপ পরিবর্তন প্রতিদিনই ঘটতে থাকে। তাই শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই। যে তাপমাত্রা বাচ্চার শরীর সহজেই এই দুধকে গ্রহন করে কাজে লাগাতে পারে বুকের দুধে ঠিক সেই তাপমাত্রাই পাওয়া যায়। মায়ের বুকের দুধে বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধক উপাদান থাকে। যেমন- আই. জি. এ (IGA) ল্যাকটোফেরিন এবং লাইসোজাইম। এছাড়াও মায়ের দুধে প্রচুর শ্বেত রক্তকনিকা থাকে সেগুলো আবার আই. জি. এ (IGA) ল্যাকটোফেরিন, লাইসোজাইম ইন্টারফেরন তৈরী করে। বাইফিজিস ফ্যাকটর নামে আরও একটি পদার্থ মাতৃদুগ্ধে পাওয়া যায়। এগুলো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করে। যার ফলে বাচ্চার দেহে ডায়রিয়া, কানপাকা রোগ, শ্বাসনালীর রোগ কম হয়। এছাড়াও মাতৃদুগ্ধ পানে হৃদপিন্ডের রোগ, করোনারী, হার্টডিজিজ, খাদ্যনালীর রোগ ইত্যাদি প্রতিরোধ করে। মায়ের দুধ পানে শিশুর চেহারা লাবন্য সৃষ্টি করে, বাকশক্তি ও সাধারন বৃদ্ধি বিকাশে সাহায্য করে। যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করান তাদের জরায়ু তাড়াতাড়ি গর্ভধারনে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে, ফলে তলপেটের থলথলে ভাব ক্রমান্বয়ে চলে যায়। দ্বিতীয়ত গর্ভধারনের সময় শরীরে যে চর্বি জমা হয় তা বাচ্চাকে দুধপান করালে নি:শেষ হয়ে যায়। আর তা মায়ের শারীরিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে। স্তন্যদাকারী মায়েদের প্রসব পরবর্তী স্রাব তুলনামূলক অনেক কম হয়। যে মায়েরা বাচ্চাকে দুধপান করান তাদের স্তন ক্যান্সারের হার তুলনামূলক ভাবে অনেক কম হয়। এছাড়াও মাতৃদুগ্ধদানের মাধ্যমে মা ও শিশুর মাঝে এমন একটি মানষিক বন্ধন রচিত হয় যা চিরস্থায়ী। এবারে কৃত্রিম দুধের অপকারিতা নিয়ে কিছু বর্ণনার মাধ্যমে আজকের আলোচনা যবনিকা টানবো। কৃত্রিম দুধ বানানো হয় পানি মিশিয়ে এবং পরিবেশন করতে হয় বিভিন্ন পাত্রে রেখে। এ ব্যাপারে ব্যবহৃত হয় বিশেষ ধরনের দুধের বোতল (ফিডার) এবং বাবারের বোটা বা বান। কৃত্রিম দুধ বলতে আমরা সচরাচর কৌটার গুড়া দুধকেই বুঝে থাকি। অবশ্য গরুর দুধ-ছাগলের দুধকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কেননা এগুলোর কোনটাই শিশুর শরীরের সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ন তাপমাত্রায় এবং উপাদানে পাওয়া যায় না। দিনে দিনে শিশুর শরীরের চাহিদায় যে পরিবর্তন ঘটে কৃত্রিম দুধ দ্বারা তা পূরন সম্ভব নয়। যেহেতু কৃত্রিম দুধে পানি মিশাতে হয় এবং বাচ্চার মুখে দুধ প্রবেশ করানোর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পাত্রের সাহায্য নিতে হয় সেহেতু রোগজীবানু দ্বারা সংক্রামনের মারাতœক সম্ভাবনা এতে থেকে যায়। ঠিক সে কারনে দেখা যায় যারা বোতলের দুধ খায়, জন্মের পর প্রথম চার থেকে ছয় মাস পর্যন্ত কৃত্রিম দুধ পানকারী শিশুদের ডায়রিয়া প্রকোপ মায়ের দুধপানকারী শিশুদের তুলনায় ত্রিশগুন বেশি। মায়ের বুকের দুধ ছাড়া অন্য কোন দুধ পান করলে এতে শিশুর এলার্জি সৃষ্টি হতে পারে। এর কারনে তাদের মধ্যে একজিমা, এজমা এবং খাদ্যনালীর ব্যথা দেখা দেয়। বর্তমানে শিশুদের ডায়বেটিস এর অন্যতম কারন হিসেবে গরুর দুধের আমিষকে চিহ্নিত করা হয়। কৃত্রিমদুধে শিশুর শরীর অতিরিক্ত মোটা হয়ে যায় এবং তা থেকে হৃদরোগেরও কারন হতে পারে। সুতরাং এ কথা প্রতীয়মান হয় যে শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধ আল্লাহ প্রদত্ত এক অফুরন্ত নেয়ামত। আসুন এই নেয়ামতের যথাযথ অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হই। আল্লাহ কবুল করুন। আমীন।
লেখক : খতিব, প্রাবন্দিক ও উপস্থাপক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Mohammad Kowsar ১২ আগস্ট, ২০২০, ১২:৫৬ পিএম says : 0
আড়াই বছরের দলিল দেন নাই।
Total Reply(0)
মিসবাহুল জান্নাত ৪ মে, ২০২১, ৪:৪৩ পিএম says : 0
দুই বছরের বেশি দুধ খাওয়ানোর পক্ষে কোন দলীল আছে?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন