এবার যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করতে পারেনি বিএনপি। সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যেতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্স চলার কারণে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ-জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছেন, সরকার জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেয়নি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ইচ্ছা করেই জিয়ার মাজারে যায় নি। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্সের কারণে তাদেরকে জিয়ার মাজারে কম লোক নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এদিকে ৭ নভেম্বর উপলক্ষে ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার ‘অনুমতি’ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছিল বিএনপি। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এ কথা জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ৯ নভেম্বর টিএসসিতে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘১২ নভেম্বর বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে সরকার। আর এটাই সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিকে সহযোগিতা।’ নিঃসন্দেহে এটা একটা শুভ লক্ষণ। এর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবহমান লু-হাওয়ার পরিবর্তে সুশীতল বায়ু প্রবাহ শুরু হতে পারে।
এটাতো অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এ দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহের মোড় পরিবর্তনের দিন হিসেবে এ দিবসের একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। আজকের প্রজন্ম সে দিনের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করতে পারবে না। কেননা, ১৯৭৫ সালের সে আবেগ-উৎকণ্ঠার সংমিশ্রণে সৃষ্ট এক অভূতপূর্ব সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী তারা নয়। ফলে ৭ নভেম্বরের চেতনাবিরোধীরা এ দিবস সম্পর্কে তাদের বিপরীত ধারণা দিতে পারে। শুধু পারে বললে ভুল হবে, এ প্রক্রিয়া তারা আরো অনেক আগে থেকেই শুরু করেছে। তারা যে কিছুটা সফল হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী জনতার বিপ্লব এ দেশের রাজনীতির গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। সেদিন যদি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিপ্লব সফল করতে সক্ষম না হতেন এবং দেশবাসী যদি তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা না করতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। বলা বাহুল্য, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত বিপ্লব ছিল অনিবার্য। ওই বছর ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়, খোন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকার তা পূরণ করতে পারেনি। বরং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নিয়ে সরকারের ভেতরে বাইরে নানা ধরনের দ্ব›দ্ব-সংঘাত ক্রমেই ব্যাপক আকার ধারণ করছিল। ১৫ আগস্টের অভ্যুথানকারী সেনা অফিসারদের সঙ্গে সিনিয়রদের দ্ব›দ্ব চরম আকার ধারণ করে। জুনিয়র অফিসাররা বঙ্গভবনে অবস্থান করে সরকার চালাচ্ছিল। এ সময় নব নিযুক্ত সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এ সম্পর্কে সাংবাদিক আমিনুর রহমান সরকার তার ‘৭ নবেম্বর বিপ্লব বনাম ভ্রান্তিবিলাস’ বইয়ে লিখেছেন, “সিনিয়ররা চাচ্ছিলেন মেজররা সেনানিবাসে ফিরে এসে তাদের কমান্ড মেনে চলুক। কিন্তু ফারুকরা নিরাপত্তাহীনতা ও ক্ষমতা গ্রহণের উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সেনানিবাসে ফিরে যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। ছয় জন ক্যু নেতা তাদের ট্যাঙ্ক বহর ও সেনাসামন্ত নিয়ে বঙ্গভবন নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। অপর দিকে সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) খালেদ মোশাররফ ও ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিল সেনানিবাস নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। এই দুই সিনিয়র অফিসার প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছিলেন যে, তারা এক দেশে দুই সেনাবাহিনী- এই অবস্থাকে কোনক্রমেই মেনে নেবেন না। খালেদ ও জামিল রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে আগস্ট অভ্যুত্থানকে মেনে নিতে পারেননি। ... বিবদমান এ দু’পক্ষের মাঝে অবস্থান করছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান”(পৃষ্ঠা ২২)।
বস্তুত জিয়াউর রহমান ও ওসমানী চাচ্ছিলেন দু’পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা। কিন্তু ইতোমধ্যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত নেন। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল যে অভ্যুত্থান সংঘটিত করেন, তার স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র তিনদিন। এই স্বল্পস্থায়ী অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফ সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন এবং জোর পূর্বক তাকে সেনা প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন। অতঃপর তিনি নিজেকে মেজর জেনারেল ঘোষণা করে সেনা প্রধানের পদ গ্রহণ করেন। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময়টা ছিল বঙ্গভবন ও সেনানিবাসের মধ্যে ক্ষমতার টাগ অব ওয়ারের সময়। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ হলো, ওই ঘটনাকে সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্য এবং দেশবাসী মেনে নিতে পারেনি। বিশেষত খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখলের পরদিন ৪ নভেম্বর তার মা ও ভাইয়ের নেতৃত্বে মিছিলের ঘটনা জনমনে এ ধারণা প্রবল করে তোলে যে, এ অভ্যুত্থান বাকশাল সরকারের পক্ষে হয়েছে এবং এ সুযোগে নিকট প্রতিবেশী একটি দেশের হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটতে পারে। পাশাপাশি জিয়াউর রহমানকে বন্দী করার ঘটনা সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে গোটা সেনানিবাস জুড়ে চলতে থাকে অস্থিরতা।
সেনা সদস্যদের একটি অভ্যুত্থান কীভাবে বিপ্লবে পরিণত হতে পারে ৭ নভেম্বর তার অনন্য দৃষ্টান্ত। ঘটনা সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকরা ঘটালেও এর সাথে সম্পৃক্ত হয় সাধারণ জনগণ। সেনাবাহিনী ও জনগণের এমন ঐক্য ছিল অভূতপূর্ব। এর কারণ ছিল জনগণ যেটা প্রত্যাশা করছিল, সেনা সদস্যরা ঠিক সে কাজটিই করেছিল। যার ফলে সেদিন সিপাহী-জনতাকে পরষ্পর কোলাকুলি এবং ট্যাঙ্কের ওপর উল্লাস নৃত্য করতে দেখা গেছে।
বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারার মোড় পরিবর্তনের দিন। সেদিন দেশপ্রেমিক বীর সিপাহী ও জনতার মধ্যে যে সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা এদেশের স্বার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করার লক্ষ্যে আধিপত্যবাদী শক্তি প্রণীত নীলনকশাকে নস্যাত করে দিয়েছিল। সিপাহী-জনতার সে বিপ্লব যদি সফল না হতো, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আর অক্ষুণœ থাকতো কিনা সন্দেহ।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন