সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

পুরুষশূন্য ৫ গ্রাম, ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবার পুনর্বাসনে কাজ চলছে

রংপুরে সংঘর্ষ ভাঙচুর ও হিন্দুবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২ হাজার জনকে আসামি করে ২ মামলা : গ্রেফতার ৫৩

রংপুর জেলা সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কটূক্তি ও অবমাননা করে ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার রংপুরের পাগলাপীরে সংঘর্ষ, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গঙ্গাচড়া থানায় ২৫-৩০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ২ হাজার জনকে আসামি করে গঙ্গাচড়া ও কোতয়ালী থানায় পৃথক দু’টি মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় শুক্রবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত জামায়াতের স্থানীয় পর্যায়ের এক নেতাসহ মোট ৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ঐসব গ্রামের পুরুষ মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বর্তমানে ৪/৫টি গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে আছে। আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
ঘটনার পর শুক্রবার রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ ও পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানসহ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাগণ। পরে ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু রাফা মোহাম্মদ আরিফকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল-এ) সাইফুর রহমান ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনার রাতেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনকে পুলিশ পাহারায় ঠাকুরপাড়া প্রাইমারি স্কুলে রাখা হয়েছে। সেখানে তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করেছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া গতকাল সকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ তিন হাজার টাকা ও দুই বান্ডিল করে টিন প্রদান করা হয়েছে। সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল শনিবার সকালে পাগলাপীর, শলেয়া শাহ, ঠাকুরবাড়িসহ কয়কটি এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি বেশ শান্ত রয়েছে। বিপুল সংখ্যক পুলিশ সেখানে সতর্ক অবস্থানে মোতায়েন রয়েছে। তবে ঘটনাস্থল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ৪/৫ টি গ্রামে গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় সেগুলো পুরুষশূন্য হয়ে আছে। চারিদিকে থমথমে ও ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার জুমআর দিন তারা পরিকল্পিতভাবে এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা করেছে। মন্দির ভাঙচুর করেছে এবং এই এলাকা রক্তাক্ত করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এখানে পরিস্থিতি উত্তেজিত করে এখানে একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করা। কিন্তু এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা এই সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে রুখে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে স্থানীয় প্রশাসন থেকে ঘর তৈরি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, একটি মহল দেশকে নানাভাবে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য তারা বিভিন্নভাবে পরিকল্পনা করছে। এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাক না কেন তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। এসময় দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে রংপুর পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এ হামলার ঘটনায় কারা জড়িত তা স্পষ্ট। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। ঘটনাস্থল থেকে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যিনি মারা গেছেন এবং যারা অসুস্থ তারা সবাই জামায়াত শিবিরের সমর্থক। যিনি মারা গেছেন তিনিও জামায়াতের কর্মী। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রবণতা ছিল এ ঘটনায়। সেটা মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি।
এদিকে, দোষীদের শাস্তি এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে গতকাল মানববন্ধন করেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত ঠাকুরবাড়ি এলাকায় রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকশ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মানববন্ধন করে। ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধনে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করেন। তারা এ ঘটনার জন্য স্থানীয় জামায়াত শিবিরের লোকজনকে দায়ী করেন।
এসময় স্থানীয় দুলাল চক্রবর্তী জানান, এ ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের স্থানীয়রা জড়িত। তারা উস্কানী দিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখনও আতঙ্কে আছি। আমরা নিরাপত্তা চাই। আর যেন কোন অঘটন না ঘটে। তিনি প্রশাসনের উদ্দেশে বলেন, প্রকৃত যারা অপরাধী তারাই যেন এ ঘটনায় গ্রেফতার হন, নিরপরাধ কেউ যেন গ্রেফতার না হয়। সেজন্য প্রশাসনকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
ইউএনও জিয়াউর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ঘর নির্মাণে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ১০টি পরিবারকে তিন হাজার করে টাকা সাহায্য ও ঘর নির্মাণের জন্য ঢেউটিন, শুকনো খাবার দেয়া হচ্ছে। ঘর তৈরির জন্য যা প্রয়োজন, তা দেয়া হবে। ইতোমধ্যেই ঘর নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
ওদিকে, মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবমাননা ও কটূক্তি করে ফেসবুকে পোস্টদাতা সেই টিটুর বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া এলাকায়। তার বাবা মৃত খগেন রায়। সে গত ৫ নভেম্বর ফেসবুকে মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কটূক্তি ও অবমাননা করে একটি আপত্তিকর পোস্ট দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরেই ওই গ্রাম ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এ ঘটনায় গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের লালচান্দপুর গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে টিটু রায়কে আসামি করে গঙ্গাচড়া থানায় মামলা করেন। ঘটনাস্থল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টিটু রায় গ্রামে থাকেন না। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। সেখানে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে ছোট বউকে নিয়ে থাকে। তার কাছে এলাকার অনেক লোক এবং এনজিও টাকা পায়।
ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সুনীল চন্দ্র রায় বলেন, টিটুর কাছে মানুষ অনেক টাকা পায়। সে টাউট প্রকৃতির ছেলে। চলাফেরায় মনে হবে না সে সাধারণ ছেলে’।
টিটুর নামে চালানো ফেসবুকে প্রোফাইলে তার স্ত্রী, সন্তানসহ মায়ের ছবি আপলোড করা আছে। যে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ভাঙচুর করা হয়েছে ওই বাড়ির সামনের একটি ছবি আছে গত ২৮ অক্টোবর। তার এক ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে। তার বড় মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করার পর ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন। টিটুর বিষয়ে তার পরিবারের দাবির কথা জানালে রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘টিটু এখনো গ্রেফতার হয়নি। তবে পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই বোঝা যাবে ফেসবুকে কে স্ট্যাটাস দিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২৯ অক্টোবর মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কটূক্তি ও পবিত্র মক্কা শরীফকে অবমাননা করে ফেসবুকে ছবি আপলোড ও আপত্তিকর স্ট্যাটস দেয়ার অভিযোগে টিটুর বিরুদ্ধে গঙ্গাচড়া থানায় মামলা করেন লালচাঁদপুর গ্রামের মুদি দোকানি আলমগীর হোসেন। তাকে গ্রেফতারের দাবিতে গত মঙ্গলবার এলাকাবাসী বিক্ষোভ করে পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। সেখানে ২৪ ঘন্টার সময় বেঁধে দেয়া হয়। এরপর গত শুক্রবার টিটুকে গ্রেফতারের দাবিতে জুমআ নামাজের পর স্থানীয় হরকলি বাজারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করতে কয়েক হাজার মুসল্লী সমবেত হন। মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে হিন্দু স¤প্রদায়ের ৭/৮টি বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এসময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হন হাবিবুর রহমান নামের মুসল্লী। ৬ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন অন্তত ৩০/৩৫ জন। মাহবুবুর রহমানের এক মুসল্লী এখনও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
সংশোধনী : গতকাল দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে রংপুরে পুলিশ ও মুসল্লীদের সংঘর্ষে নিহত ২’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে ভুলবশতঃ নিহত ২ জন ছাপা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ১ জন নিহত হবে। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন