শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আলু উৎপাদন-হিমাগার শিল্পে ধসের শঙ্কা

১৫ লাখ মেট্রিক টন ফেলে দিতে হবে

হোসাইন আহমদ হেলাল | প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিকল্প খাদ্য আলু উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে চলতি বছরই সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে কৃষক। দেশের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল এবং ভাতের বিকল্প খাদ্য আলু উৎপাদনে এ সাফল্য অর্জন হলেও সরকারি অব্যবস্থাপনায় ধস নামার সম্ভাবনা রয়েছে এ খাতে। এ বছর ১ কোটি মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঠিক উদ্যোগের অভাবে কৃষক এবং হিমাগার মালিকদের এবার লোকসান হবে ১২ হাজার টাকার বেশি। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহে লিখিতভাবে দাবি রেখেও প্রতিকারে সরকারি আশ্বাস মেলেনি। ফলে আগামীতে আলু উৎপাদন ও হিমাগার শিল্পে ব্যাপক ধস নামবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। মারাত্মক ক্ষতির আগেই এ শিল্পকে বাঁচাতে তারা প্রধানমন্ত্রীর জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, বিগত ১৫ বছরের মধ্যে এ বছর আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৩৯২টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা হয় ৫৩ লাখ মেট্রিক টন। অবিক্রিত আলুর পরিমাণ রয়েছে ২৯ লাখ ১৫ হাজর মেট্রিক টন। এ অবিক্রিত আলুর আনুমানিক বাজার মূল্য রয়েছে ৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকার মতো। কৃষিভিত্তিক হিমাগার শিল্পের প্রভাব ও সহায়তায় বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। ঘর-বাড়ি, কল-কারখানা স্থাপন ও রাস্তাঘাট তৈরির কারণে আবাদি জমি দ্রæত কমে যাচ্ছে। এ কারণে ধানের উৎপাদন কমছে। এক একর জমিতে ৫০ মণ ধান উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে একইভাবে এক একর জমিতে আলু উৎপাদন হয় ৩শ’ মণ। আগামী ৫ বছর পর দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২০ কোটিতে। তখন দেশে খাদ্যাভাব মারাত্মক রূপ ধারণ করবে। ধারণা করা হচ্ছে, তখন কৃষকের উৎপাদিত আলুই ভাতের বিকল্প হিসেবে স্থান পাবে। বাংলাদেশের সাড়ে ৩ কোটি কৃষকসহ ৫ কোটি মানুষ আলু উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। আলু জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। চলতি মৌসুমে আলু রফতানি আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে আলু। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে বারবার অবহিত করেও কোনো সুফল পায়নি। এরপর থেমে থাকেনি, গত ২৯ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী বরাবর দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হিসেবে কৃষকদের উৎপাদিত আলু ব্যবহার বৃদ্ধি, ত্রাণকার্যে, কাবিখা, বিজিএফ, বিজিডি ও এমএস-এ আলু বিতরণের পাশাপাশি রফতানি বৃদ্ধি করতে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেছেন। এ চিঠির বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় কোল্ড স্টোরেজ সমিতি গত ২৯ সেপ্টেম্বর একই মন্ত্রণালয়ে আবার লিখিত দাবি তুলে ধরেছেন। তাতে মেলেনি কোনো আশ্বাস। গত ৬ নভেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রধান বীজতত্ত¡বিদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সভা আয়োজন করে। সে সভার আলোচ্য বিষয় ছিল দেশের চাহিদা অনুযায়ী খাবার আলু, রফতানিযোগ্য আলু এবং প্রক্রিয়াজাত শিল্পের ব্যবহার উপযোগী আলু, উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ, উপযুক্ত জাত নির্ধারণ ও আবাদি এলাকার পরিমাণ নির্ধারণ, রফতানি বৃদ্ধির কৌশল নির্ধারণ। এ সভায় কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের ৭ দফা দাবি বিষয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেছি। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভাতের বিকল্প আলু খাওয়ার জন্য জনগণকে সচেতন করতে সব মিডিয়াসহ প্রচার মাধ্যমে প্রচারে উদ্যোগ গ্রহণ, আলুর খাদ্যাভ্যাস বৃদ্ধির জন্য সরকার অথবা বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (বিপিসি) কর্তৃক তহবিল বরাদ্দ করে দেশের ৪৬০টি উপজেলায় আলুর খাদ্য মেলা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা, ত্রাণকার্যে কাবিখা, ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ড ও ওএমএস এবং রোহিঙ্গাদের বিতরণের ব্যবস্থা করা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, এতিমখানা, কারাগার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন আবাসিক হলে বাধ্যতামূলক আলুর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ প্রদান, আলু রফতানি বাজার সৃষ্টিকরণ, প্রণোদনা বৃদ্ধিকরণ এবং কৃষি, বাণিজ্য, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল গঠন করে রফতানি সমস্যা চি‎িহ্নত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আলু উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণনে কৃষকদের মাঝে ভর্তুকি প্রদান, হিমাগার মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ পরিশোধ ও পূর্ণ ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা। মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, চলতি মৌসুমে ৫৩ লাখ মেট্রিক টন আলু হিমাগারে সংরক্ষিত ছিল। নতুন আলুর মৌসুম কাছাকাছি চলে আসায় ১৪০০ টাকার প্রতি বস্তা আলু বিক্রি করতে হয়েছে ৭০০ টাকা। লোকসান দিয়ে ইতোমধ্যে ২৪ লাখ মেট্রিক টন আলু বাজারজাত করা হয়েছে। অবিক্রিত রয়েছে ২৯ লাখ। এর মধ্যে ১০ লাখ মেট্রিক টন বীজ আলু হিসেবে বিক্রি হবে। নতুন আলু আসার আগ পর্যন্ত ৪ লাখ মেট্রিক টন খাবার জন্য বাজারে বিক্রি হতে পারে। বাকি ১৫ লাখ মেট্রিক টন অবিক্রিত থাকবে। এ অবিক্রিত আলুর মূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা হবে। এ আলু ফেলে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তিনি আরো বলেন, চলতি বছর আলু উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনে কৃষকদের লোকসান হবে ৫ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, হিমাগার মালিকদের লোকসান হবে ৪ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা, গতকাল সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয়ে উপরোক্ত বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য লিখিত আবেদন জানানো হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য।
জরুরি ভিত্তিতে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে আসছে মৌসুমে আলু উৎপাদন কমে যাবে। মারাত্মক ধস নামবে হিমাগার শিল্পে।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট কামরুল চৌধুরী গোর্কী বলেন, আলু অবিক্রিত থাকা ও অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করায় কৃষক সর্বসান্ত হচ্ছে। একই সাথে হিমাগার মালিকরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবেন। কৃষিবান্ধব সরকার হিসেবে আমরা দাবি করছিলাম আলুর খাদ্যাভ্যাস বৃদ্ধিকরণ, রফতানি প্রণোদনা ২৫ শতাংশ ধার্যকরণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিদ্যুৎ বিলের ২০ শতাংশ রিবেট প্রদানের জন্য, তাও হয়নি। তিনি আরো বলেন, বিদেশে আলু রফতানিতে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা প্রচলিত ছিল। রাশিয়াতে আলু রফতানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা ধার্য করার জন্য কৃষিমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ ধার্য করেন, অথচ গরু, মহিষের নাড়িভূড়ি, শিং ও রগ রফতানির বিপরীতে ১০% ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আলু রফতানিতে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নগদ প্রণোদনা বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। ভারতে বর্তমানে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৪.৬০ টাকা। এ জন্য বাংলাদেশের আলু রফতানির সম্ভাবনা নেই। যে কারণে এ বছর অবিক্রিত আলু ফেলে দেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। হিমাগার একটি কৃষিভিত্তিক শিল্প। বাংলাদেশ ব্যাংক ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি থাকা সত্তে¡ও বিদ্যুৎ বিল ২০ শতাংশ রিবেট প্রদানের বিষয়ে আজও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যে কারণে অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয়, শ্রমিক মজুরি, ব্যাংক ঋণ, সীমাহীন বিদ্যুৎ বিল, ডিজেল জেনারেটর চালানোর খরচ দিয়ে মালিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে- আলু খেলে কৃষক বাঁচবে।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বীজ উইং) মো: আশরাফ উদ্দিন আহমদ ইনকিলাবকে বলেন, হিমাগার মালিকদদের জন্য আমাদের করার কিছু নেই, যা করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আমরা কৃষকদের উৎপাদনে সহযোগিতা করতে পারি। এছাড়া অন্য কিছু নয়।
এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: মোশাররফ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের ৭ দফা দাবির বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। যদি এ সংক্রান্ত কোনো আবেদন সংশ্লিষ্ট সংগঠন করে থাকে তা এখনো পর্যন্ত আমার কাছে পৌঁছেনি। আবেদনটি হাতে পেলে অবশ্যই যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও হিমাগার মালিকরা বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে আলু উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও বিপণনের ব্যর্থতা খুঁজে বের করে জরুরি ভিত্তিতে কৃষি, বাণিজ্য, খাদ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্যবস্থা নেয়া অপরিহার্য। কোনোভাবে এ সাফল্য হারানো যাবে না। এটি ধরে রাখতে পারলে অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখতে সামর্থ্য হবে। কৃষকরা উৎসাহিত হবে, দারিদ্র্যতা দূর হবে। কিন্তু এ খাতে ধস নামলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দারিদ্র্যতা বাড়বে। বাড়বে বেকারত্ব। তারা জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন