দেশে ইয়াবা এখন মুড়ি মুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। গত ৬ বছরে ইয়াবার ব্যবহার ও বিক্রি বেড়েছে ব্যাপকহারে। সর্বনাশা এ ইয়াবা ট্যাবলেটের মরণ ছোবল দেশের সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মেট-এমফিটামিনের সঙ্গে ফরমিন মেশানোর কারণে ইয়াবা হেরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর। এটা এক ধরনের মনোউত্তেজক মাদক। ইয়াবা সেবনের ফলে সাময়িক শারীরিক উদ্দীপনা বাড়লেও কমতে থাকে জীবনীশক্তি। এর ফলে খুব দ্রæত আসক্তরা আক্রান্ত হয় দুরারোগ্য সব ব্যাধিতে। আর এর সঙ্গে সামাজিক ও পারিবারিক বহুবিধ নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি তো রয়েছেই।
এখন সরকারি হিসাবেই দেশটিতে দিনে সেবন হয় ২০ লাখ মিয়ানমারের ইয়াবা বড়ি। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে ¯্রােতের মতো ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। যেখানে ২০১০ সালে ৮১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট আটক হয়েছিল, সেখানে ২০১৬ সালে আটকের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন কোটি। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিসহ কিছু অপরাধী গোষ্ঠী ইয়াবা বিস্তারের প্রধান রুট করেছে বাংলাদেশকে। তিন কোটি ইয়াবা আটক হলে বছরে কতো কোটি ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করে? মিয়ানমারের বছরে কেবল বাংলাদেশে বিক্রিত ইয়াবার দাম আসে ২১ হাজার ৬ শ’ কাটি টাকা। অর্থাৎ এক দিনেই মিয়ানমার বাংলাদেশে পাচার করছে ৬০ কোটি টাকার ইয়াবা।
মাদক নির্মূলে পুলিশের দায়িত্বটা একটু বেশি। কিন্তু আজকাল পত্রপত্রিকাতে যা দেখছি তাতে মাদক নির্মূলের চেয়ে কতিপয় অসৎ পুলিশ মাদকের লালন করছে বেশি। পুলিশের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়ত করা, কোথাও কোথাও পুুলিশ নিজেরাই মাদক বিক্রে করার মতো ঘৃণ্য অপরাধ করছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়। মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। সরকার বলছে, ৫০ লাখ; কিন্তু বেসরকারি সূত্রমতে, ৭০ লাখেরও বেশি। তবে আমরা ধারণা করতে পারি, এর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। গৃহকর্তা-গৃহবধূও আছে। মাদক গ্রহণকারীর ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। বিশ্বের নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। এর ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়েছে শহর হতে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। বিভিন্ন মাদকের মরণ নেশায় প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে ৮-১০ বছরের শিশু হতে শুরু করে নারী এমনকি বৃদ্ধরাও। ২০০২ সালে দেশে মাদক অপরাধীর সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা ২০ শতাংশের বেশি।
২০১২ সালে চীন-থাইল্যান্ডের ‘মেকং সেফ’ চুক্তির পর থাইল্যান্ডে ইয়াবা পাচার কঠিন হয়ে গেলে এই অপরাধীরা বাংলাদেশকে টার্গেট করে এবং এখনো তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে এ কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুণ ইয়াবায় আসক্ত হয়ে নিজেদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে। কম্বোডিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক নাথান এ থম্পসন মিয়ানমার ও বাংলাদেশে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেন। জাপানের নিকেই এশিয়ান রিভিউ সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে ইয়াবা সমস্যা’ শীর্ষক ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কোথা থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকছে, কারা এর মরণ ছোবলের সবচেয়ে বড় শিকার ইত্যাদি বিষয় সবিস্তারে তুলে ধরা হয়।
সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ২০১২ সালে ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৭৭৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করে প্রশাসন। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ লাখ ৩৫ হাজার ৪৫৯ পিসে। ২০১৪ সালে ৩৫ লাখ ৫৫৪ পিস। ২০১৫ সালে ১ কোটি ৩৪ লাখ ২৬ হাজার ২৮৭ পিস। ২০১৬ সালে ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৯৬ হাজার ৭৭ পিস। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত জব্দ করা হয় ৫৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৭ পিস। পুলিশ ও র্যাবের এ পরিসংখ্যান দেখলেই অনুমান করা যায় সারা দেশে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবমতে, ঢাকায় প্রতিদিন ইয়াবার চাহিদা ২৫ লাখ। এ নেশায় আসক্তদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন। ইয়াবার মধ্যে যেসব উপাদান রয়েছে এর পুরোটাই মাদক। যারা একসময় ফেনসিডিল ও হেরোইনে আসক্ত ছিল তারা এখন ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। ইয়াবা বহন সহজ ও বেশি লাভজনক হওয়ায় দেশে অন্যান্য মাদকের তুলনায় এটি বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এসব তথ্য থেকেই অনুমান করা যায় বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এই মরণ নেশায় আসক্ত। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনের বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ২০ লাখ ইয়াবা সেবন করা হয়ে থাকে। ইয়াবার সেবন বাংলাদেশে শুরু হয় ২০০৬ সালের দিকে। এর আগে একশ্রেণির তরুণ গাঁজা বা হেরোইনের নেশায়ই বুঁদ থাকত। তাদের কাছে এখন ইয়াবাই বেশি প্রিয়। হেরইন আর গাঁজা সেবন কমে বেড়েছে ইয়াবা সেবন। ইয়াবা এসব নেশার চেয়েও ভয়ংকর নেশা। দেখা গেছে প্রথমদিকে অভিজাত শ্রেণির কিশোর ও তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যেই ইয়াবার নেশা চালু ছিল। বিশেষ করে ঢাকা শহরের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কিন্তু দ্রæত ইয়াবা স্মার্টনেস, ফ্যাশন ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। তরুণী মডেল, চলচ্চিত্রের নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, ড্যান্সার এবং তারকা জগতের অনেকেই ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। ২০১২ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মিয়ানমারে প্রস্তুত ইয়াবার বন্যা বওয়া শুরু হয়। ২০১২ সালে চীন ও থাইল্যান্ডের মধ্যে ‘মেকং সেইফ’ চুক্তির পর মিয়ানমারের মাদক উৎপাদনকারীদের জন্য পাচার কঠিন হয়ে যায়। তখন তারা বাংলাদেশকেই মাদক পাচারের প্রধান রুট করে; এখনো তা বিদ্যমান। বাংলাদেশকে মিয়ানমারের চোরাচালানিরা সফট তথা সহজ টার্গেট বানিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের রয়েছে ২৫০ কিলোমিটার সীমান্ত। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের তথ্য মতে, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে ইয়াবা সরবরাহকারী দেশ এই মিয়ানমার।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার একটি ষড়যন্ত্রের অস্ত্র হচ্ছে ইয়াবা। এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০১৬ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন রেকর্ড ৭.০৫ শতাংশ বাড়ে। চলতি বছর আরও বাড়বে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সমস্যাটা এখানেই। মিয়ানমারের ইয়াবা বাংলাদেশে আসাটা সহজ নয় বরং তা আন্তর্জাতিক কৌশল হতে পারে। বাংলাদেশে ইয়াবা সমস্যার পেছনে ষড়যন্ত্র আছে অবশ্যই। এর পেছনে অনেক দেশ রয়েছে। তারা আমাদের দেশের ক্ষতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যার পাঁচ কোটি তরুণ-তরুণী। এদের স্বাস্থ্য ও কর্মশক্তিকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। আর আমাদের যুব সমাজ ধ্বংসে তাদের ষড়যন্ত্রে সাহায্য করছি আমরা। মাদকের সাথে প্রশাসনের সম্পৃক্ততার কথাতো শুনি হরহামেশাই। কখনো কখনো মন্ত্রী আমলাদের সম্পৃক্ত হবার খবরও আছে।
পাশের দেশ মিয়ানমারের গুটির চালে গোটা বাংলাদেশ তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ইয়াবা নামক এই মরণনেশার দংশনে নীল সারা দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতিদিনই এ নেশার জগতে পা বাড়াচ্ছে নতুন নতুন মুখ। বাংলাদেশ লাগোয়া মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে অন্তত ৪৫টি কারখানায়। মিয়ানমারের শান ও ওয়া রাজ্য থেকে মরণ নেশা ইয়াবার কাঁচামাল ইয়াংগুন হয়ে রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে ও মংডুতে পৌঁছে। এসব কারখানার মধ্যে ১০টি গড়ে উঠেছে মংডু এলাকায়ই। এখন নাফ নদী পার হয়ে নৌযানে ইয়াবার চালান চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। মাদক ও অপরাধ নির্মূলবিষয়ক জাতিসংঘ কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মিয়ানমারের ইয়াবা কারখানাগুলোকে। মাদকের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় কমিটিকে (সিসিডিএসি) ইয়াবা কারখানার তালিকা দিয়ে প্রতিকার চাইছে বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। তবে কারখানা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে একটি তালিকায় মিয়ানমারকে ৪৫টি ইয়াবা কারখানার ব্যাপারে তথ্য দেয় বাংলাদেশ। তবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, এসব কারখানার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অবান্তর কথাই মিয়ানমার বারবার বাংলাদেশকে জানাচ্ছে। অথচ মিয়ানমারে সোর্স দিয়ে তল্লাশি চালায় এদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এতে ৪৫টি কারখানার তথ্য প্রমাণ মেলে। প্রতিটি কারখানা থেকে বাংলাদেশে নিজস্ব সিন্ডিকেটে ইয়াবা আসে। এসব ইয়ার অনুুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
একটি প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করা। এজন্য দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিসহ সবাইকে যে যার জায়গা থেকে মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। হুঙ্কার দিতে হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করার। আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের চেয়ে মাদক সিন্ডিকেট মোটেও শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমতে বাধ্য। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর হতে হবে। মাদকাসক্তদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর সেবামুখী কার্যক্রম জোরদার করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন