দেশের অর্থনৈতিক মূলধন এবং বিনিয়োগের অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত। ক্ষুদ্র আমানতকারী থেকে শিল্পপতি পর্যন্ত ব্যাংকের গ্রাহক। নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের প্রধানতম খাত হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংক। মূলত আমানতকারীদের সঞ্চিত অর্থই ব্যাংকগুলোর পুঁজির মূল উৎস। দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকিং খাতে বেশ কয়েক বছর ধরে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। আর্থিক এই অনিয়মের কারণে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রায় অচল হতে বসেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা তসরুফ করে বা ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়ে ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এসব লুটপাটের সাথে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালনা পর্ষদ এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যাংকের অর্থ মেরে দেয়ার সাথে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ধরা দূরে থাক, সন্দেহের তালিকায়ও রাখছে না। নামকাওয়াস্তে ব্যাংকের নিচের সারির কিছু কর্মকর্তাকে দায়ী করে চাকরিচ্যুত, গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়। অর্থ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত মূল হোতাদের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না। ব্যাংকিং খাতে অর্থ লুটপাট বন্ধে দুদক নখদন্তহীন হয়ে পড়েছে। এর প্রতিকার না হওয়ায় দিন দিন ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের লুটপাটের সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এর ফলে এ খাতটি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অর্থনীতি সচল ও গড়ে তোলার প্রধানতম ব্যাংকিং খাতটি বহু শ্রম ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্থিতিশীল ও সুসংহত অবস্থান লাভ করে। জনসাধারণের আমানত রাখা এবং ঋণ নেয়ার অন্যতম ভরসার জায়গায় পরিণত হয়। ২০০৯ সালের পর হঠাৎ করেই এ খাতটি এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটে। হলর্মাক, বিসমিল্লাহ গ্রæপ তার অন্যতম উদাহরণ। এ ধারাবাহিকতায় বেসিক ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ঋণ নেয়ার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। এসব অর্থ আর কখনো ফেরত পাওয়া যাবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বলা বাহুল্য, লোপাটকৃত এসব অর্থ জনগণের। জনগণের এই অর্থ মেরে দিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। তিলে তিলে গড়ে উঠা ব্যাংক খাতটিকে পরিণত করেছে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতার খাতে। এ অবস্থার মধ্যেই বেসরকারিভাবে নতুন নতুন ব্যাংক খোলার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে নতুন ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এসব ব্যাংক এখনো ঠিকমতো ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতে পারছে না। বিদেশি বড় ব্যাংকগুলোর সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক শুরু করতে পারেনি। ব্যাংকগুলোর সাথে কেউ বৈদেশিক বাণিজ্য করতে আগ্রহী হচ্ছে না। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এর মধ্যে দুটি ব্যাংকের পরিচালকদের আর্থিক অনিয়মেরও অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান সরকার আরও ৩টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে। বর্তমানে যেসব ব্যাংক রয়েছে সেগুলোই যথেষ্ট। সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপেও উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৯৫ শতাংশ ব্যাংকার চান না নতুন কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হোক। ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে মত দিয়েছেন ৫৫ শতাংশ। তবে ৯২ শতাংশ গ্রাহক ও ৭৫ শতাংশ ব্যাংকার চান বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর নতুন শাকা চালু করা হোক। এ প্রেক্ষিতে, নতুন করে ব্যাংক চালু করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন ব্যাংক খোলা মানেই লুটপাটের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা। দেশে সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বিদ্যমান ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ পরিচালনার সার্বিক ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। আমানতকারিরা আমানতের ওপর কাক্সিক্ষত লাভ না পেয়ে ব্যাংকের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে। তারা সঞ্চয়পত্র কেনার দিকে ঝুঁকেছে। মনে করা হচ্ছে, ব্যাংকের এই বিপুল অলস অর্থ ঋণ নেয়ার নামে লোপাট করে দেয়া হচ্ছে। নতুন ব্যাংক চালু করার পেছনেও আমানতের অর্থ লুটপাট করার অনৈতিক উদ্দেশ রয়েছে। ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, ব্যাংকের পরিচালকরাই ঋণ ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছে। অন্য ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়ে একই অপকর্ম করছে। পাশাপাশি বেনামে ঋণ নেয়াতে ব্যাংকগুলোও তার কোনো হদিস পাচ্ছে না। অর্থাৎ ব্যাংকের অর্থ লুটপাটের জন্য যত ধরনের প্রতারণামূলক পন্থা অবলম্বন করা যায়, তার সবই করা হচ্ছে। এসবের কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। যারা এ অপকর্মের সাথে জড়িত, দুদক তাদের টিকিটি পর্যন্ত ধরতে পারছে না। ব্যাংকিং খাতে চলমান এ অরাজকতা পুরো অর্থনীতিকে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের সংস্কৃতি চলছে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তা থেকে বের হয়ে আসার বিকল্প নেই। এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। একটি সমৃদ্ধ খাতকে এভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া যায় না। নামে-বেনামে ঋণ নেয়ার নামে যারাই ব্যাংকের অর্থ লুটপাটের সাথে জড়িত এবং যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। লুটপাটের সাথে জড়িত রাঘব-বোয়ালদের এড়িয়ে চুনোপুটিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ লোক দেখানো ছাড়া কিছু নয়। দুদককে অপরাধীর মাপকাঠি বিবেচনা করলে হবে না। অপরাধীর প্রভাবশালী অবস্থান বিবেচনা না করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কণ্ঠাবোধ করলে চলবে না। বর্তমানে দেশে যে ৫৭টি ব্যাংক, ২৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ৬২টি বীমা কোম্পানি রয়েছে, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ব্যাংকসহ এসব প্রতিষ্ঠান বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই নতুন করে ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। বরং বিদ্যমান ব্যাংক খাতে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে, তা কঠোর হস্তে দমন করে আস্থা ও স্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন