শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষ যেন দিন দিন পশুর চরিত্রকেও হার মানাচ্ছে। পশুর হৃদয়ে আবেগ বলতে কিছুই থাকে না। সে যা-ই ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। তার জন্য অবশ্য তাকে দোষ দেয়া যায় না। কেননা পশুর সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে ভালমন্দের বিচার না করে শিকার ধরে খাওয়া। তাই কোনো পশুর মধ্যে নিজের সন্তান ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর প্রতি যেমন ভালবাসার আবেগ থাকে না- তেমনি করে ন্যায়-অন্যায় বোধও থাকে না। অরণ্যের রাজত্বে অরণ্যের আইনই চলে। সেখানে যার শক্তি আছে সে-ই রাজত্ব করতে পারে। দুর্বলরা মার খায় কিংবা বলা যায় অন্যের খাবারে পরিণত হয়। অরণ্যের রাজত্বে আইনকানুনের বালাই নেই কিংবা সেখানে কোর্টকাচারি বলতেও কিছু নেই। আমরা সবাই জানি অরণ্যের রাজত্বে কেউ নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। কারণ অরণ্যের রাজত্বে যেসব প্রাণীকুল বাস করে তারা মানুষ নয়। তারা জ্ঞান, মেধা, বুদ্ধিহীন প্রাণী অর্থাৎ পশু। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করেন পশুদের মধ্যে কি একেবারেই মমত্ববোধের কোনো চিহ্ন নেই। আমরা কি সংবাদপত্রে মাঝে-মধ্যে দেখি না কুকুরের দুধ খেয়ে বড় হচ্ছে বিড়াল ছানা। আবার এমন কথাও শুনে থাকি কিংবা মাঝে মধ্যে পত্র-পত্রিকায় দেখে থাকি হরিণের দুধ খেয়ে বড় হচ্ছে সিংহের বাচ্চা। এসব হয়তো সংখ্যায় খুব কম। হাতেগোনা বিষয়। তারপরও বলা যায়, পশুরাও মাঝে-মধ্যে সৌজন্যবোধের পরিচয় দিয়ে থাকে। অরণ্যের রাজত্বে প্রাণীদের হৃদয়ের সৌজন্যবোধ দেখে অনেক সময় মানুষদেরকে লজ্জা পেতে হয়। তবে মানুষ লজ্জা পায় কি না জানি না। যদি তারা লজ্জা পেত তাহলে মানুষই থাকতো। একশ্রেণীর হিংস্র মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করতো না। শিশুদের হত্যা করে উল্লসিত হয়ে উঠতো না। মানুষ অরণ্যের আইন দ্বারা চালিত হতে পারে না। মানুষ চালিত হয় রাষ্ট্রের আইন দ্বারা। রাষ্ট্রের আইন মানুষই তৈরি করে থাকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য। মানুষ ভালমন্দ বোঝে বলেই নিজের স্বার্থে আইন সৃষ্টি করেছে এবং যত দিন যাবে মানুষ নিজেকে রক্ষা করার জন্য নতুন নতুন আইন তৈরি করবে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তার রেশ কাটতে না কাটতেই কুমিল্লায় দুই শিশুকে হত্যা করেছে মৃত দুই শিশুর সৎভাই। আজ আমরা যদি সংবাদপত্রের সংবাদগুলোর পরিসংখ্যান করতে যাই তাহলে দেখতে পাব দেশে শিশু-কিশোর হত্যার একটা মহোৎসব চলছে। প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায় কেবল দেখা যায়, একশ্রেণীর মানুষ অরণ্যের পশুকেও হার মানাচ্ছে। কিছুসংখ্যক মানুষ এতটাই পিশাচ হয়েছে যে, বড়দের ওপর প্রতিশোধ নিতে কিংবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কোমলমতি শিশুদের শিকার বানাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদে বলা হয় যে, বাহুবলের চার শিশুকে হত্যা করা হয় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে। বাহুবলের চার শিশু হত্যাকা-ের পর সারাদেশে হাহাকারের বাতাস বইছে। তার রেশ কাটতে না কাটতেই কুমিল্লায় সহোদর দুই ভাইকে (স্কুলছাত্র) হত্যা করেছে তাদেরই সৎভাই। যেসব শিশু হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে সেই সব কোমলমতি শিশু জানে না কি তাদের অপরাধ। যে বয়সে তাদের বই-খাতা নিয়ে স্কুলে গিয়ে অ আ ক খ শেখার কথা- সেই বয়সে লাশ হতে হচ্ছে তাদের স্বজনদের দ্বারা কিংবা হিংস্র পশু মনোবৃত্তিসম্পন্ন অমানুষদের দ্বারা। দেশে একশ্রেণীর মানুষ অরণ্যের আইন জারি করতে চায়। আজ দেশের আনাচে-কানাচে শিশুরা হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে, বলাৎকারের শিকার হচ্ছে কিংবা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক মানুষের বিকৃত রুচির বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এক লেখায় বলেছিলেন, ট্রেনে যাবার সময় আমাদের দেশের গ্রামগুলোকে খুব সুন্দর মনে হয়। কিন্তু সাবধান, তুমি সেখানে যেও না। সেখানে ভাই ভাইয়ের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে। আমরা জানি, আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে থাকে দলাদলি। সেই দলাদলি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। অনেক সময় পঞ্চায়েত প্রথা নিয়েও দলাদলি হয়ে থাকে। বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রামেও নাকি পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে দলাদলি ছিল। অভিযোগ রয়েছে সেখানে অনেক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে। এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চারটি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। একশ্রেণীর মানুষের মানসিক বিকৃতি কতটা নিম্নগামী হচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারি শিশু হত্যাকারীদের কার্যকলাপ দেখে। অপরাধ বিজ্ঞানীরাও তা-ই বলছেন। বলছেন, এই যে কোমল প্রাণ শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে তা হল অপরাধীদের বিকৃত মানসিকতার লক্ষণ। এছাড়া অপরাধীরা শিশুদের হত্যা করে মৃত শিশুদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে চায়। এটা অপরাধীদের কৌশল। যাতে হত্যাকা-ের শিকার শিশুদের মা-বাবা কিংবা আত্মীয়-স্বজনরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে কোনদিন মাথা তুলে আর দাঁড়াতে না পারে। তার মধ্যে আছে আবার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ। বাহুবলের চার শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর তার স্বজনরা নাকি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। পুলিশ নাকি তাদের পাত্তাই দেয়নি। এসবই অভিযোগ। পুলিশ তখনই সক্রিয় হয় যখন চার হতভাগ্য শিশুর লাশ বালিচাপা অবস্থায় পাওয়া যায়। খুনিরা এই চার শিশুকে হত্যা করে বালিচাপা দিয়ে লাশ গুম করার চেষ্টা করে। কিন্তু অপরাধীরা জানে না পাপ কোনদিন বিনা চ্যালেঞ্জে যায় না কিংবা চাপা থাকে না। একদিন তা প্রকাশ পাবেই।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি দেখে অনেকেই মনে করে থাকেন, আমরা এমন এক অবস্থায় বসবাস করছি, যে অবস্থায় পকেটে টাকা থাকলে যা ইচ্ছে তা-ই করা যায়। মানুষ এটাও মনে করে, প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল স্তরে একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ বসে আছে যারা নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য কিংবা নিজেদের স্বার্থে অনৈতিক লাভের আকাক্সক্ষায় অপরাধীদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এই যে একশ্রেণীর মানুষের এমন মনোবৃত্তি অপরাধ করলেও টাকার জোরে বড় কর্তাদের ম্যানেজ করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সকল অপরাধ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, এসব মনোবৃত্তি অপরাধীদের অপরাধ করতে আরও বেশি করে উৎসাহিত করে থাকে। এই শ্রেণীর লোভী মানসিকতাসম্পন্ন লোকেরাই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে অপরাধ সংঘটিত করে থাকে। তারাই শিশুদের অপহরণ করে। আবার তারাই শিশুদের হত্যা করে বালিচাপা দিয়ে লাশ গুম করে থাকে। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের সমাজে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। সমাজের সকল স্তরে উন্নতির ছোঁয়া লাগছে। এই পরিবর্তনের বাতাস সবাইকে স্পর্শ করছে না। কিছু মানুষ মনে করে আত্মস্বার্থবাদীরাই উন্নতির ছোঁয়া পাচ্ছে। সমাজের একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে উন্নতির ছোঁয়া দেখে অন্য একটা শ্রেণীর মানুষজন না পাওয়ার বেদনায় দিন দিন জেদী হয়ে যাচ্ছে। এই জেদ থেকেই না পাওয়া মানুষের দল অপরাধী কিংবা অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। অপরাধ বিজ্ঞানীদের এই অভিমত কতটকু সত্য জানি না। আমরা যা বুঝতে পারি তা হল- মানুষের মধ্যে একটা অসম প্রতিযোগিতা চলছে। এই অসম প্রতিযোগিতার যারা পাকা খেলোয়াড় তারা ন্যায়-অন্যায় বোধের কোনো ধার ধারে না। ওরা নিজের প্রাপ্যটুকু ছিনিয়ে আনতে গিয়ে এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করতে পারে না। সামাজিক দুর্নীতির ছায়াতলে যারা বড় হয়, তারাতো আর স্বাভাবিক মানুষ থাকে না। তারা সত্যটাকে উড়িয়ে দিতে চায় মিথ্যার বাতাসে কিংবা তারা সাদা-কালো পার্থক্য করে নিজেদের স্বার্থের বেড়াজালে।
আজ মানুষ যেন আর মানুষ থাকছে না। একেকটা মানুষ হয়ে যাচ্ছে নরঘাতক। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, আর তা হলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একশ্রেণীর নেতা আছেন তারা নিজেরা যেমন অপরাধ করেন তেমনি অপরাধীদের লালন-পালন করে থাকেন। এখন প্রশ্ন হল- আমাদের কি করা উচিত? কয়েকজন অপরাধীকে ফাঁসিতে লটকালেই কি সকল অপরাধের অবসান হয়ে যাবে? কিংবা একজন অপরাধীকে ক্রসফায়ার করলেই কি দেশের সকল শিশু নিরাপদ থাকবে। সবাই বলবেন না। কয়েকজন অপরাধীকে ফাঁসিতে লটকালে কিংবা একজন অপরাধীকে ক্রসফায়ার করলেই সকল অপরাধের অবসান হবে না। দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী মনে করে সকল অপরাধের অবসান করতে হলে বৈষম্যহীন সামাজিক পরিবর্তন আনতে হবে। যে পরিবর্তন মানুষের মনকে অপরাধী করে তুলবে না। আমরা দেশবাসী তেমন একটা পরিবর্তন চাই, যে পরিবর্তনের হাওয়ায় ভেসে মানুষ বুঝতে পারবে, রাষ্ট্র মানুষের জন্যÑ কোনো শিশু হত্যাকারীর জন্য নয়। মানুষের মন থেকে যখন বৈষম্যের সকল কালিমা মুছে যাবে তখন মানুষ তার প্রাপ্যটুকু পেয়ে বুঝবে, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থায় সবাই তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান থাকে বলেই শ্রেণী স্বার্থের প্রশ্নটা সেখানে আসে না। শ্রেণী স্বার্থের প্রশ্ন যেখানে আসে না সেখানে কোনো ধরনের বৈষম্যও থাকে না বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থায় একজন পুলিশ অফিসার, একজন ডাক্তার, একজন আইনজীবী, একজন প্রকৌশলী কিংবা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা অর্থাৎ রাষ্ট্রের সকল স্তরের দায়িত্ববান ব্যক্তিরা অনৈতিক কর্মকা- চালানোর চিন্তাই করতে পারবেন না। সবাই থাকবেন সচেতন। একটা রাষ্ট্রের সকল স্তরের দায়িত্ববান ব্যক্তি যখন তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন হয়ে যাবেন তখন সমাজের নষ্ট ব্যক্তিরা সাহস পাবে না নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য কোমলমতি শিশুদের হত্যা করতে কিংবা একজন সৎভাই স্বপ্নেও সাহস করবে না বিমাতার ঘরের ছোট ছোট ভাইদের হত্যা করে সম্পত্তি গ্রাস করার। কেননা বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থায় অপরাধীরা ভাল করে বুঝে নেবে কোন থানায় গিয়ে দেশের অতি সাধারণ মানুষদেরও হয়রানির শিকার হতে হবে না। একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাও বুঝে নেবেন দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। তাই বলছিলাম যারা শিশুদের হত্যা করে তাদের রাষ্ট্রকেই বুঝিয়ে দিতে হবে, কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনদিন শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারী অর্থাৎ মানুষ হত্যাকারীকে ছাড় দেয়া হয় না। অপরাধীরা যখন বুঝে নেবে বৈষম্যহীন পরিবর্তনের ছোঁয়ায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো অসৎ রাজনৈতিক নেতাও সাহস করবে না অপরাধীদের পক্ষে কথা বলতে তখনই দেখা যাবে বাহুবল কিংবা কুমিল্লায় হত্যাকা-ের শিকার শিশুদের মতো আর কোনো শিশুকে অপঘাতে মরতে হচ্ছে না। আমরা কি আমাদের সন্তানদের জন্য দেশমাতৃকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে পারি না ?
লেখক: কবি, গল্পকার ও আইনজীবী
কালীবাড়ী রোড, হবিগঞ্জ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন