সা¤প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এব্যাপারে আমাদের অনেকের ধারণাই নেতিবাচক। স¤প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার পাঠকদের কাছে প্রশ্ন ছিল ‘চিকিৎসাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে করণীয় কী?’ প্রায় সব পাঠকই এ ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেছেন যে আমাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে শৃঙ্খলার অভাব প্রকট; ফলে চিকিৎসাব্যবস্থায় মানুষের আস্থা বিলীয়মান এবং যার প্রায় সম্পূর্ণ দায় চেপেছে চিকিৎসকদের উপর। নিঃসন্দেহে ডাক্তারি একটি মহান পেশা। প্রশ্ন হচ্ছে, চিকিৎসাক্ষেত্রে এই বিশৃঙ্খলার পেছনে চিকিৎসকদের দায় কতটা? তার আগে জানতে হবে আমাদের দেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নে ও নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসকরা কতটা সম্পৃক্ত।
আমাদের সাম্প্রতিক ঘটনাই বেশি মনে থাকে। তারমধ্যে দু’টি ঘটনা আমাদের ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রথমটি কুমিল্লার খাদিজা আক্তারের। তার গর্ভে দুটি সন্তান থাকলেও গত ১৮ সেপ্টেম্বর চিকিৎসক অপারেশন করে একটি সন্তান বের করেন এবং অন্যটি টিউমার বলে অপারেশন শেষ করেন। বাড়িতে যাওয়ার পর দীর্ঘ এক মাস তার পেটে ব্যথা ছিল। পরে পেটের ব্যথা বাড়তে থাকলে খাদিজা উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ২৫ অক্টোবর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। দ্বিতীয় অপারেশনের পর তার গর্ভে থাকা অন্য সন্তান মারা যায়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঢাকার পারভীন আক্তারের। গত ১৬ অক্টোবর প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, পরে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
সেখানে তার কাছে ১৫শ’ টাকা চাওয়া হয়। টাকা না দেওয়ায় সেখান থেকে তাকে অন্য কোথাও যেতে বলা হয়। পরদিন তাকে নেওয়া হয় আজিমপুর ম্যাটারনিটিতে। কিন্তু হাসপাতালের একজন আয়া চিকিৎসা হবে না বলেই তাকে টেনে দোতলা থেকে নিচে নামায়। হাসপাতাল থেকে বের হতেই প্রসব বেদনায় রাস্তার ওপর বসে পড়ে সে এবং সেখানেই সন্তান প্রসব করে। প্রথমে নড়াচড়া করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই নবজাতক নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কখনো একটি জন্ম যে মৃত্যুর মতোই শোকাবহ হতে পারে, ওই ঘটনা তা আরেকবার প্রমাণ করলো।
এই শিশু দু’টির মৃত্যুর জন্য আমরা কাকে দায়ী করবো? চিকিৎসককে না চিকিৎসাব্যবস্থাকে? নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রেখে বলেছিলেন, ‘এটি একজন মানুষের জন্য ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য এক বিশাল অগ্রযাত্রা।’ উপরের ঘটনাগুলো হয়ত সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে নাম না জানা দু’টি শিশুর মৃত্যু, কিন্তু মানবাতার জন্য বড় ধরনের ধাক্কা! পরিসংখ্যান বলছে, সারাবিশ্বে প্রতিবছর ৪০ লাখ শিশু জন্মের প্রথম ২৮ দিনের মধ্যেই মারা যায়। কিন্তু সারাবিশ্বে কতজন মা’কে টাকার অভাবে রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হয়?
বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে। যে জাতি যত উন্নত হবে তার স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার তত প্রয়োজন হবে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও এই তিনটি বিষয়কে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। অনেকেই মনে করেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে সরকারি খরচে পড়াশোনা করে যারা ডাক্তার হচ্ছেন, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া অন্য সব সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি খরচে পড়াশোনা করে যারা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নিয়োগ পাচ্ছেন, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন তো?
চিকিৎসাক্ষেত্র একটা ব্যবস্থাপনা যেখানে প্রশাসক, ব্যবস্থাপক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই সম্পৃক্ত। একটি হাসপাতালে ডাক্তারদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ট্রেড ইউনিয়নের নামে হাসপাতালের ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপতৎপরতা চিকিৎসাক্ষেত্রে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ¤øান করে দিতে পারে। তবে এটাও ঠিক, কিছু অসৎ কর্মীদের অপতৎপরতা সত্তে¡ও আমাদের অনেক হাসপাতাল সেবা প্রদানে আন্তরিক। হয়ত একারণেই বারডেম হাসপাতালে প্রতিদিন তিন হাজার রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে; হয়ত একারণেই জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের জীবন রক্ষাকারী ইনজেকশন বিনামূল্যে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।
আমাদের মেট্রোপলিটন শহরগুলো এখন আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর উড়াল সেতু দিয়ে মোড়ানো। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার; গত অর্থবছরে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশ। খাদিজা বা পারভীনের মতো সাধারণ মানুষ যারা এই দেশে বাস করে, তারা নিশ্চয়ই এই দেশ নিয়ে গর্ব করে। পেটে সন্তানকে রেখেই সেলাই করে দেওয়ার পর খাদিজা যখন দীর্ঘ ৩৭ দিন পেটে ব্যথার যন্ত্রণা সহ্য করে ছিলো, কিংবা ৯ মাস ১০ দিন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে প্রসব বেদনায় ছটফট করতে করতে পারভীন যখন ঢাকা শহরের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরছিলো, তখন নিশ্চয়ই তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো জীবন কত কঠিন এবং চিকিৎসা পাওয়া কত কঠিন।
সাধারণত সমাজে যারা নিয়ম ও আইন তৈরি করেন, সেটা তারা নিজেদের সুবিধার দিক বিবেচনা করেই করেন। তবে চিকিৎসাক্ষেত্রে নিয়ম ও আইন সেবাগ্রহীতার সুবিধার দিক বিবেচনা করেই হওয়া উচিৎ। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নীতিমালা প্রণয়নে ও নিয়ন্ত্রণে যারা আছেন, ধারণা করি সবাই স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা নন; অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও নিশ্চয়ই আছেন। চিকিৎসাক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নে ও নিয়ন্ত্রণের সময় তারা সবাই অন্তত খাদিজা আক্তার, পারভীন আক্তারদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্টটা একটু অনুভব করার চেষ্টা করবেনÑ এমনটাই প্রত্যাশা করছি।
লেখক : শিক্ষক, দ্য কার্টার একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চাঁদপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন