শস্য শ্যামল আমাদের এ দেশে পাখির আগমন ও সমাদর অনন্তকাল ধরে। এখানে ক্ষেতে, বনাঞ্চলে ও বাগানে প্রচুর পাখি দেখা যায়। পাখিগুলো বিভিন্ন রঙ, আকার ও স্বভাবের। প্রাকৃতিক শোভা-বিস্তৃত আমাদের দেশে পাখির আবেদন চিরন্তন। শুধু তাই নয়, বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যে পাখিরাও হয়ে ওঠে স্বাতন্ত্র্য। পাখি বিশারদদের মতে, সংখ্যা ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে আমাদের দেশের পাখি সম্পদ উপমহাদেশে শীর্ষে। আমাদের গর্বের বিষয় এই যে, গোটা পৃথিবীতেই বাংলার পাখির খ্যাতি ছড়িয়ে আছে। পৃথিবীতে পাখির প্রজাতি আছে আট হাজার ছয়শ’। এর মধ্যে উপমহাদেশে আছে এক হাজার পাঁচশ’ প্রজাতির পাখি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বৃহত্তর ভারতে ১২শ’ প্রজাতির অধিক পাখি হবে না। সে তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র, বনভূমির ভূ-খÐ বাংলাদেশে সাতান্নটি প্রজাতির পাখি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। তাছাড়া প্রতি শীতে যোগ হচ্ছে সোয়া দুশ’ থেকে আড়াইশ’ প্রজাতির অতিথি পাখি।
বাংলাদেশের ঋতু-বৈচিত্র্যের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। হালকা শীতের আমেজ এখন প্রকৃতিতে। শীতকাল এলেই বংলাদেশ থেকে তিন-চার হাজার মাইল দূরের শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে অতিথি পাখি আসে এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের পলিময় সমতলে। এরপর পাখিরা ছড়িয়ে পড়ে বাংলার হাওর, খাল, বিল, নদী-নালায়। এমন কি শহরের কৃত্রিম লেকগুলোও এই ভিনদেশি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, কেনো এত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এই ভিনদেশি পাখিরা দেশ-মহাদেশ পাড়ি দিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা জগতে হাজির হয়! সাধারণত মনে করা হয়, শীতের দাপটে এবং খাদ্যের সন্ধানে। অনুসন্ধান করে জানা গেছে যে, ভালো আবহাওয়া এবং ভালো খাবারের দেশ ছাড়িয়েও এই অতিথি পাখিরা অনেক সময় আরও দক্ষিণে চলে যায়। এ জন্যে কারও কারও অভিমত ‘বংশগতিই’ এর কারণ। প্রাচীনকাল থেকেই ঋতু বিশেষে এই আসা-যাওয়া অতিথি পাখিদের বৈশিষ্ট্য। তাই প্রয়োজন না থাকলেও তারা অভ্যাসের বশে অতিরিক্ত ওড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শীতের প্রকোপ বা খাবারের অভাব দেখা দেয়ার আগেই পাখিরা দেশ ছাড়ে।
শরতে দিবালোক হ্রাস পেতে শুরু করলেই পাখিদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সূচনা হয়। পাখিরা তখন বুঝতে পারে, প্রবাস যাত্রার সময় তাদের সমাগত। শীতের পরে স্বদেশ ফেরার আগেও তারা একইভাবে চঞ্চল হয়ে ওঠে। পাখিদের দেহ উড্ডয়ন উপযোগী। আর দেশান্তরীর ক্ষেত্রে তা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার উপযুক্ত। পাখির দেহের তুলনায় সুগঠিত মাংসপেশি রয়েছে ডানাদুটির গোড়ায়। তাছাড়া তার শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থাও শক্তি যোগায়। বাতাস থেকে অক্সিজেন টেনে নেয়ার ক্ষমতা অন্যন্য প্রাণিদের তুলনায় পাখিদের অনেক বেশি। এ ছাড়া আরেকটি দিক হচ্ছে অনেক পরিব্রাজক পাখি দেশ থেকে দেশান্তরে গমনের পূর্বে শরীরে বেশ কয়েক স্তর চর্বি যোগাড় করে নেয়। এটা দীর্ঘ আকাশ যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি হিসেবে কাজ করে। ভিনদেশি অতিথি পাখিদের জীবন বিচিত্র ও রহস্যময়। তারা কী করে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে প্রতি বছর নির্ধারিত সময় আমাদের দেশে এসে শীত কাটায়, আবার একই সময় ফিরে তা বিস্ময়কর।
আজকাল বিভিন্ন দেশে অতিথি পাখিদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। অতিথি পাখিদের দিকভ্রান্তি ঘটে না। বংশগত সূত্রে পাওয়া বিশেষ গুণের কারণে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব পাখির দেহে যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যায় কম্পাস। ফলে সে হারায় না পথের দিশা। এই অতিথি পাখিদের আরও আছে কয়েকটি অসাধারণ গুণ। কোথায়, কত উপরে অনুকূল বাতাস মিলবে, তা অনুধাবন এবং ব্যবহার করার নৈপূণ্য আছে তাদের। কোনো কোনো পাখি আবহাওয়ার পূর্বাভাষ টের পায়। এদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর। আবার অতি বেগুনী রশ্মিও কারও কারও চোখে সাড়া জাগায়। খুব দীর্ঘ তরঙ্গের ধ্বনিও অতিথি পাখিদের শ্রবণেন্দ্রিয় এড়ায় না। ভিনদেশি এই পাখিরা আমাদের এই সবুজ-শ্যামল বাংলার বুকে অতিথি পাখি হিসেবে দেখা দেয় একবার নয়, দু’বার। একবার যাওয়ার সময়, অন্যবার ফেরার সময়। প্রায় পাঁচমাস গ্রাম-বাংলার জনপদে শোনা যায় এই অতিথি পাখিদের মিষ্টি মধুর কলকাকলি।
লক্ষণীয় যে, এ সময় সাইবেরিয়া, রাশিয়া, হিমালয় সংলগ্ন আসাম, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে গ্যাডওয়েল, কমন পোচার্ড, ফিস ঈগল, নর্দান পিনটেইল, বালিহাঁস, বুনোহাঁস, টিকিহাঁস, ছোট সারস, নিশাচর, কার্কিও হেরন, ডুবুরি পাখি, গায়করেণু, রাজসরালী, পাতিকুট, মরচেরংবুতি, কালোমাথা, সরালী, কালোকোট, বাটুই, ত্রিশুলা, চখাচখি, গাঙচিলসহ দেশীয় প্রজাতির বক, সারস, হাড়গিলা, রাতচোরা, ভুটই, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন পাখির সমাগম ঘটে। চলনবিলের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলার বিভিন্ন বিল-জলাশয়ে এসব পাখি খাবারের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। পানি নেমে যাওয়ায় চলনবিলের খাল-বিল, জলাশয়গুলোতে দেখা মিলছে পুঁটি, খলসেসহ ছোট বড় নানা ধরনের অসংখ্য মাছ। উপযুক্ত পরিবেশ এবং এসব মাছ খাওয়ার লোভেই নানা প্রজাতির অতিথি পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে আশ্রয় নিচ্ছে চলনবিলে। মুক্ত আকাশে ডানা মেলে ছুটে চলছে এক বিল থেকে আরেক বিলে। অপরূপ সাজে সেজে উঠছে প্রকৃতি। মাছ, দিগন্তজোড়া বিল, আর অতিথি পাখি মিলে এখানে প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। পর্যটক ও পাখিপ্রেমীদের জন্য এ দৃশ্য মনমুগ্ধকর, কিন্তু পাখি শিকারিরা পাখিদের এমন অবাদ বিচরণে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বিষটোপ-বড়শি ও বিশেষ ধরনের জালসহ নানা রকম ফাঁদ পেতে নির্বিচারে শিকার করছে এসব অতিথি পাখি। শিকারিরা এসব পাখি চলনবিলের বিভিন্ন হাটবাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি করছে। এসব এলাকার হাটবাজারের হোটেলগুলোতে বিভিন্ন অতিথি পাখি অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পাখির স্বাদ পেতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। প্রতি জোড়া বালি হাঁস ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও ইসলামিক আইন বাস্তবায়ন না হলে এ পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব নয়।
প্রিয়নবী (সা.) পশুপাখিদের কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ তার পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। রাসুল (সা.) কোনো এক প্রয়োজনে বাইরে গেলেন। আর এ সময় আমরা দু’টি বাচ্চাসহ একটি ‘হুম্মারাহ্’ (লাল ঠোঁট বিশিষ্ট ছোট পাখি) দেখতে পেয়ে তার বাচ্চা দু’টি ধরে আনলাম। খানিকটা সময় বাদে বাচ্চা দুটোর মা এসে তার দুই ডানা মাটির উপর চাপড়াতে লাগল। রাসুল (সা.) এসে এরূপ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এর বাচ্চাগুলো কে এনেছে? তার বাচ্চাগুলো তাকে ফেরত দিয়ে দাও। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তা ফিরত দিয়ে দেই। এরপর আমরা পিঁপড়ার একটি বসতি জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। প্রিয়নবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এটি কে জ্বালিয়েছে? বললাম, আমরা। তিনি বললেন, অগ্নির মালিক ছাড়া আগুন দিয়ে শাস্তির অধিকার কারোর নেই। (আবু: ২৬৭৫)।
প্রতি বছর শীতের মৌসুমে সবুজ শ্যামল এই বাংলার পথ-ঘাট-প্রান্তর অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠুক। অতিথি পাখিরা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত করুক, এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদরাসা ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন