পূব প্রকাশের পর
সৈন্যদের মধ্যে এসব নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামাত না।’
শিয়ারশোল স্কুলে নজরুলের শিক্ষক ছিলেন নিবারণচন্দ্র ঘটক। বিপ্লবী দল যুগান্তর এর সদস্য ছিলেন তিনি। দলের হয়ে বিপ্লবের জন্য কর্মী সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে কর্মীদের দীক্ষাও দিতেন। এই নিবারণ ঘটকের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন নজরুল। কিন্তু ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিপ্লবী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার হন নিবারণ, বিচারে পাঁচ বছরের কারাদন্ড হয় তাঁর। নিবারণ ঘটক আটক হওয়ার পর দলের অন্য কর্মীদের শনাক্ত করার জন্য গোপনে তদন্ত চালায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। তখন নিবারণের ঘনিষ্ঠ ছাত্র হিসাবে নজরুল ছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষের সন্দেহের তালিকায়। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবু প্রাথমিকভাবে তাঁকে সন্দেহ করা হয় এবং তাঁর ছাত্রবৃত্তি কয়েক মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়। যুগান্তর কর্মী ও নজরুলের জীবনীকার প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্যে, ‘আমি দু’জনেরই (নিবারণ ও নজরুল) কাছের মানুষ হিসাবে এটা বুঝেছিলাম যে নজরুল যুগান্তর দলের কর্মী ছিলেন কিন্তু কাজ করার মুখেই নিবারণ ঘটক হয়ে গেলেন গ্রেফতার।’ পরে নজরুল নিজেও মুজফ্ফর আহমদের কাছে স্বীকার করেছিলেন, নিবারণ ঘটকের মতবাদে একসময় দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি।
এক্ষণে নিশ্চয় এটুকু অনুমান করা দুঃসাধ্য হবে না যে, সেই ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে সেই সময় করাচিতে সেনাবাহিনীর ভেতরে ও বাইরে বিপ্লবীদের একটা দল তৎপর ছিল, যাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নজরুলের এবং সেনাবাহিনীর এই বিপ্লবী গোষ্ঠীর মাধ্যমেই নিয়মিতভাবে বিপ্লবের সংবাদ সংগ্রহ করতেন নজরুল। অধিকন্তু তৎকালের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সেনা সেন্সরশিপের কারণে বাংলাদেশ থেকে সংবাদ ও বইপত্র সরাসরি নজরুল পর্যন্ত পৌঁছানো ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বাঙালি পল্টনের সৈনিক ও স্বদেশি আন্দোলনের বিভিন্ন বিপ্লবীর লেখা থেকে জানা যায়, প্রথম মহাযুদ্ধকালে বাঙালি পল্টনসহ বেশ কিছু ভারতীয় সেনা ইউনিটে পরিকল্পিতভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বিপ্লবীদের। হতে পারে নজরুল নিজেও এ-ধরনের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ভালো ছাত্র হওয়া সত্তে¡ও লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন পল্টনে। তবে এটি কেবলই অনুমানমাত্র, এ-বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা কষ্টসাধ্যই বটে।
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালেও রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ করা যায় বেশ ভালোভাবে। এখানে স্বল্প পরিসরে তাঁর একেবারে প্রথম দিকের দুটি রচনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি গল্প, দ্বিতীয়টি কবিতা-‘ব্যথার দান’ কবির প্রথম দিকে লেখা গল্প। রুশ বিপ্লবের মাত্র দুই বছর পর ১৯১৯ সালে পল্টনে বসে তিনি লিখেন গল্পটি। এর প্রধান দুই চরিত্র দারা ও সয়ফুল। মূলত-এদের ভারত থেকে লালফৌজ যোগ দেওয়া সৈনিক হিসাবে দেখিয়েছিলেন তিনি। যেমন, গল্পে সয়ফুলের গলায় শোনা যায়, ‘ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই লালফৌজে যোগ দিলুম। এ পরদেশীকে তাদের দলে আসতে দেখে তারা খুব উৎফুল্ল হয়েছে। মনে করছে, এদের এই মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর করে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নিঃস্বার্থপরতা প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তি সঙ্ঘের একজন।’ উল্লেখ্য, ‘ব্যথার দান’ গল্পে ‘লালফৌজ’ শব্দটি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় প্রকাশকালে তা পালটে দেওয়া হয়েছিল।
১৯২০ সালে পল্টন থেকে ফিরে এলেন নজরুল। ১৯২২ সালে রুশ বিপ্লবকে ভারতে আহŸান করে লিখলেন বিখ্যাত প্রলয়োল্লাস কবিতা। আর এই কবিতায় রুশ বিপ্লবকে তুলনা করা হল প্রলয় শব্দের সঙ্গে। এই কবিতায় আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য পাগল/সিন্ধু পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল। এই দুই পঙক্তিতে উন্মোচিত হয়েছে রুশ বিপ্লবের স্বরূপ।
আজীবন রুশ বিপ্লবের আদর্শকে নিজের সৃষ্টি ও কর্মকান্ডে প্রতিফলিত করেছেন নজরুল ইসলাম। তাঁর বিভিন্ন রচনা, পত্রিকা সম্পাদনা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ করা গেছে বিচিত্র মাত্রায়। সবশেষে দুটি তথ্য দিয়ে এ লেখার ইতি টানব ভারতে রুশ বিপ্লবের প্রকাশ্য ধারক ও বাহক কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন নজরুল। অন্যদিকে, রাশিয়ার জনগণও এই কবিকে বিপ্লবী প্রলেতারীয় রোমান্টিক কবি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ষশেষ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন