৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০। বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রাম। জহিরুদ্দিন আবু আলি হায়দার সাহেব এবং রাহাতুন্নেসা চৌধুরীর চতুর্থ সন্তান জন্ম নিল। রাহাতুন্নেসা ছিলেন আবু আলি সাহেবের চার স্ত্রীর মধ্যে প্রথমা। দুই পুত্র এবং এক কন্যার পর এটি তাঁদের দ্বিতীয় কন্যা। নাম তাঁর রোকেয়া। কঠোর রক্ষণশীল পরিবার। পর্দাপ্রথার কড়াকড়ি সেখানে স্বাভাবিক ঘটনা। সেই মেয়েটাকেও আত্মগোপন করতে হত। বাচ্চাওয়ালি মুরগী যেমন আকাশে চিল দেখিয়া ইঙ্গিত করিবামাত্র তাহার ছানাগুলো মায়ের পাখার নিছে লুকায়, ঠিক তেমনভাবে তাকেও লুকাতে হত। পাড়ার মেয়েরা হঠাৎ তাদের বাড়িতে বেড়াতে এলে বাড়ির লোকের চোখের ইশারায় তাকেও আড়াল খুঁজতে হত। শুধু তফাত একটাই। ‘মুরগী ছানার তো মায়ের বুকস্বরূপ একটি নির্দিষ্ট আশ্রয় থাকে, তাহারা সেইখানে লুকাইয়া থাকে।’ এ কন্যাটির ‘সেরূপ কোনো নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান ছিল না।’
৯ ডিসেম্বর ১৯৩২। রোকেয়া তখন ৫২ বছরের প্রবীণা। সেদিন ছিল শুক্রবার। ফজরের নমাজের জন্য খূব ভোরবেলায় উঠে পড়েছেন তিনি। ওজু করার পরই অসুস্থতাবোধ করতে লাগলেন। তারপরই মৃত্যু এসে কোলে তুলে নিল তাঁকে। ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। আগের রাতেও ১১ টা পর্যন্ত নিজের টেবিলে পেপার ওয়েটের নিচে পাওয়া গেল একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ। শিরোনাম ‘নারীর অধিকার’। তাতে লেখা আছে: ‘আমাদের ধর্মমতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় পাত্র-পাত্রীর সম্মতি দ্বারা। তাই খোদা না করুন বিচ্ছেদ যদি আসে.তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে, কিন্তু এটা কেন হয় একতরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা?’ ৮০ বছর পরেও এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া গেল কোথায়?
ডিসেম্বরের নয় তারিখে জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে কেটে যাওয়া ৫২টি বছরের ওই নারী জীবনও নয়-নয়, না-না, নেতি-নেতি-তে পূর্ণ। তার নিজের কথায় : ‘...আমার মতো দুর্ভাগিনী অপদার্থ বোধহয়, এই দুনিয়ায় আর একটা জন্মায়নি। শৈশবে বাপের আদর পাইনি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যহ প্রস্রাব পরীক্ষা করেছি। পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দু-বার মা হয়েছিলুম-তাদেরও প্রাণভরে কোলে নিতে পারিনি। একজন পাঁচ মাস বয়সে, অপরজন চার মাস বয়সে চলে গেছে।’ শেষে নিজের ছোটবোনের শিশুকন্যা নুরীকে নিজের কাছে রেখে বড় করছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত নুরীরও মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে ৫২ টি রোধনভরা শীতের অবসান ১৯৩২-এ। কী চেয়েছিলেন তিনি? ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এমন কী বেহিসেবি চাহিদা ছিল ওই নারীর, যার অপ্রাপ্তিতে জীবনের কানায় কানায় ভরা হাহাকার? তেমন কিছুই নয়। ইসলামের গন্ডির ভিতর নারীর অধিকার।
‘অবরোধবাসিনী’র নিজস্ব উচ্চারণে ‘আমরা যাহা চাহিতেছি তাহা ভিক্ষা নয়, অনুগ্রহের ফল নয়, আমাদের জন্মগত অধিকার। ইসলাম নারীকে সাতশত বৎসর পূর্বে যে অধিকার দিয়াছে তার চেয়ে আমাদের দাবি এক বিন্দুও বেশি নয়।’ তাঁর লেখা উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’-এর নায়িকা সিদ্দিকার মতো তিনিও সমাজকে দেখাতে চেয়েছিলেন ‘একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারীজন্মের চরম লক্ষ্য নহে। সংসার ধর্মই জীবনের সারধর্ম নহে।’ আর এই চাওয়ার পথেই যত বাধা-বিঘœ,যত ঝড়-ঝঞ্ঝা।
তার মধ্যেও আপন প্রাণের প্রদীপটিকে নিভতে দেননি ওই মহীয়সী নারী, যাঁর মধ্যে শাহানারা হোসেনের মতো কেউ কেউ ‘রাজা রামমোহন রায়ের যুক্তিবাদ’ এবং ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাবপ্রবণতা ও গভীর অনূভূতি’র মেলবন্ধন দেখে চমকিত হয়েছেন। তাই-ই ‘বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত’ রূপে সেলাম জানিয়েছেন ওই হার মানতে না-চাওয়া নারীকে, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। তাঁর প্রাণের প্রদীপটিকে দু-হাত দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি-সেই দীপশিখার নাম ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’, বেগম রোকেয়া জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন মারা গিয়েছিলেন ১৯০৯-এর মার্চ মাসে। মৃত্যুকালে দ্বিতীয়া স্ত্রী রোকেয়াকে দিয়ে গিয়েছিলেন দশ হাজার টাকা। সেই অর্থটুকু সম্বল করে সে বছরই অক্টোবর মাসের প্রথম দিনে ভাগলপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন রোকেয়া। ছাত্রীসংখ্যা মাত্র পাঁচ। তাদের মধ্যে চারজনই ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রট সৈয়দ শাহ আব্দুল মালেকের কন্যা। তাই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁর সরকারি বাসভবন ‘গোলাপ কুঠি’-তেই স্কুল চালানোর অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। ভাগলপুরের শ্বশুরবাড়িতে রোকেয়ার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল তাঁরই আত্মীয়স্বজন, বিশেষত সাখাওয়াত হোসেনের প্রথম স্ত্রীর একমাত্র কন্যা। স্কুল শুরু করার এক মাসের মধ্যে ভাগলপুরের পাট তুলে দিয়ে কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হলেন রোকেয়া। কলকাতায় আসার এক বছরের মধ্যে আবার উদ্যোগ নিলেন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। ১৯১১-এর ১৬ মার্চ ১৩ নম্বর ওয়াইলীউল্লাহ লেনের একটা ভাড়া বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রীকে দিয়ে স্থাপন করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। বছর দুয়েকের মধ্যে স্কুলটিকে উঠে আসতে হল ১৩ নম্বর ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে। আবার বছর দুই যেতে না যেতেই স্কুলের নতুন ঠিকানা হল ৮৬/এ, লোয়ার সার্কুলার রোড। ১৬২, লোয়ার সার্কুলার রোডে বর্ধিত কলেবরে বিদ্যালয়টির দিনযাপন শুরু হয় ১৯৩২-এ।
স্কুলের এই টানাটানির বৃত্তান্তই বুঝিয়ে দিচ্ছে বেগম রোকেয়ার বিদ্যালয় পরিচালনার ইতিহাসটি আদৌ মসৃণ ছিল না। প্রতিষ্ঠাত্রী নিজেই লিখেছেন, ‘...এই গরিব স্কুলকে জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য কেবল সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। দেশের বড় বড় লোক- যাদের নাম উচ্চারণ করিতে রসনা গৌরব বোধ করে, তাহারাও প্রাণপণে শক্রতা সাধন করিয়াছেন। স্কুলের বিরুদ্ধে কতদিকে কত প্রকার ষড়যন্ত্র চলিতেছে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন, আর কিছু কিছু দীনতম সেবিকাও সময় সময় শুনিতে পায়। একমাত্র ধর্মই আমাদেরকে বরাবর রক্ষা করিয়া আসিতেছে।’ আসলে, যেসব অভিভাবক তাদের মেয়েদের সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে পড়ালেখা শেখাতে পাঠাতেন তাদের ভাবটা ছিল এই যে, রোকেয়াকে ধন্য করে দিলাম। আর যারা নানা ছলছুতোয়, স্কুল কর্তৃপক্ষের পান থেকে চুন খসলেই মেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছেন, ভেবেছেন- রোকেয়াকে একটা ভালো রকম শাস্তি দেয়া গেল। এর মধ্যে ঘটেই চলেছে নানা কান্ড।
স্কুলের জন্য টাকা বার্মা ব্যাংকে রাখা হয়েছিল। টাকা রাখার দু’মাসের মধ্যে বার্মা ব্যাংক ফেল করল। মেয়েদের স্কুলে নিয়মিত যাতায়াতের জন্য মোটর বাসের ব্যবস্থা করা হল, যাতে অবরোধ প্রথায় ক্রটি না ঘটে সেজন্য চারদিকে বন্ধ করে পর্দা লাগিয়ে বাসটিকে ‘গড়ারহম ইষধপশ যড়ষব’ (চলন্ত অন্ধকূপ) বানিয়ে তোলা হল। প্রতিক্রিয়া হল দু’রকম। একদল বলল, রোকেয়া তাদের মেয়েদের ‘জীতে জী কবরমে ভর রহি হ্যাঁয়।’ কাল থেকে তাদের মেয়েরা আর স্কুলে আসবে না। আর এক দল বলল, ‘মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দা দেয়া হয়েছে, তা বাতাসে উড়িয়ে গাড়ি বেপর্দা করে।’ সুতরাং পর্দা ঠিকঠাক মতো না লাগানো হলে ‘খবিস’, ‘পলিদ’ ইত্যাদি উর্দু দৈনিকে স্কুলের বদনাম করে সংবাদ প্রকাশিত হবে। স্কুলে মেয়েদের ব্যায়াম এবং গান বাজনা চর্চার ব্যবস্থা করা হল। ব্যস! পরদিন থেকে উর্দু কাগজে স্কুল ও রোকেয়ার নামে নানা গালমন্দ শুরু হয়ে গেল।
অথচ এই স্কুলটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বেগম রোকেয়াকে কত রকম আপসই না করতে হয়েছিল! সরকার অধিগ্রহণ করে স্কুলটার নাম বদলে ‘এড়াবৎহসবহঃ ঐরময ঊহমষরংয ঝপযড়ড়ষ ভড়ৎ গঁংষরস এরৎষং’ করতে চাইল। সাখাওয়াত সাহেবের নাম মুছে দিতে চাইল। তাতেও আপত্তি ছিল না রোকেয়ার-স্কুলটা তো বাঁচুক। অবরোধ প্রথা, পর্দাপ্রথার আজন্ম বিরোধী তিনি। অথচ তিনি স্বেচ্ছায় অবরোধবাসিনী হয়েছিলেন, এমনকি বাইরের পুরুষদের সামনে বোরখা পরেও বের হতেন না। ‘সওগাত’ পত্রিকায় লেখিকাদের ছবি ছাপা হত। কিন্তু পর্দার খাতিরে রোকেয়া তাঁর ছবি ছাপারও অনুমতি দেননি। সব ওই স্কুলটার জন্য। ‘সওগাত’ এর সম্পাদককে লিখিত একটি পত্রে তিনি জানিয়েছেন- ‘আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়মকানুনগুলো পালন করছি।’
আজ থেকে ১৩২বছর আগে জন্মেছিলেন তিনি। আজ ৮০ বছর ধরে তিনি শায়িতা সোদপুরে তাঁর এক আত্মীয়ের গোরস্থানে। অথচ আর এক বছর পরই তার স্কুলটির একশো বছর পথচলা পূর্ণ হবে। কবি গোলাম মোস্তাফা যথার্থই লিখেছেন- ‘বাংলার যদি কোথাও তীর্থক্ষেত্র থাকে/সে তবে তোমার এই সমাধি- রেখে গেলে তুমি যাকে।’ সাময়িক আপসে নারীর লড়াই শেষ হয়ে যায় না বরং তা খুঁজে নেয় শতায়ু হওয়ার উপকরণ-রোকেয়া বোধহয় তারই সাক্ষ্য বহন করেছেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন