আবারও এসেছে বিজয় দিবস। বছরের তেরোটি পার্বণের মতো একটি নয়, বরং দেশপ্রেমের অঙ্গীকারে উজ্জীবিত হয়ে ঐক্য, সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষাকল্পে শপথের দিন। বিভেদের মধ্যে ঐক্যের জায়গা বাংলাদেশের চিরনন্দিত গৌরব। দেশের লালসবুজের পতাকার ছায়াতলে আমির-ফকির, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সাম্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার দিন বিজয় দিবস।
বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জন্ম নেওয়া আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা, বাক-স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক চরম বৈষম্যই স্বাধীনচেতা নাগরিকদের স্বাধীন ভুখÐ অর্জনে পাগলপারা করে তুলেছিল। হানাদার পাকিস্তানিদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অসংখ্য দেশপ্রেমিকের, শহিদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় এই স্বদেশভূমি।
অনায়াসে বলা যায়, নিশ্চয়ই সেদিনের পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল নিপীড়ন, শোষণের অবসান ঘটিয়ে আত্মমর্যাদা রক্ষার লড়াই। দেশের বীর সেনানীদের বুকে নিশ্চয়ই ছিল আরও সুনির্দিষ্ট কিছু স্বপ্ন। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা, আইন-সব ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাবে, দেশের মানুষের অভাব কমবে, শিক্ষার হার বাড়বে, বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চা হবে। অন্যায়, অবিচার কমবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে-এসব সাধারণ স্বপ্ন।
লক্ষ লক্ষ বীর শহিদের রক্তের বিনিময়ে লাভ করা বিজয় দেশের একাংশ লোকের স্বার্থের ফন্দিতে স্বাদহীনতায় পরিপূর্ণ, একথা বর্তমান দেশের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে চোখ রাখলে সহজেই প্রতীয়মান হয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগ ও অকল্পনীয় দুঃখ-কষ্ট এবং অগণিত শহিদের তাজা রক্তে রঞ্জিত জয়গাথার ইতিহাসে কলঙ্কের বিষাক্ত ছাপ আঁকতে ব্যস্ত একাংশ মসনদলোভী সুবিধাবাদী। আজ স্বাধীনতা লাভের ৪৬ বছর পূর্ণ হলেও অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার অদ্যাবধি অনিশ্চিত। বিজয় দিবসে নেতাদের গরমাগরম ভাষণে সারা দেশে উৎসবের দামামা বাজলেও বিজয় দিবসের মতো পবিত্র দিনে লব্ধ প্রতিশ্রæতির বাস্তবায়নে সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা কতটুকু সফল হয়েছেন, তা অবশ্যই কোটি টাকার প্রশ্ন।
বিজয় দিবসে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার বুলি আউড়ে কোনো লাভ নেই। জনগণের অধিকার ফিরিয়ে না এই বুলি ফাঁকা আওয়াজ বৈ কিছু নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সামাজিক ন্যায়, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক্-স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ইত্যাদি একে অপরের পরিপূরক। আমাদের চারদিকের বাস্তবতার দিকে তাকালে মনে হয়, স্বাধীনতার আপন স্বকীয়তা হারাতে বসেছে।
অবশ্য আমাদের দেশে স্বাধীনতা লাভের পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সৌজন্যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল কিছুটা উন্নত হয়েছে কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলাদেশে বেকারত্ব, কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি, রাজনীতিতে পারিবারিক ট্রাডিশন অত্যধিক ভাবাবেগজনিত বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ বেড়েই চলেছে। দারিদ্র বিমোচন, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার শপথ নেওয়া হোক, তবেই ফিরবে স্বাধীনতা, ঘুচবে স্বাদহীন নাগরিক জীবনের ক্ষুধাযন্ত্রণার ভয়ানক অনুভূতি।
পরিশেষে বলব, আসুন আজকের এই শুভদিনে বিজয়ের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে শপথ গ্রহণ করি-রক্তে রঞ্জিত মর্যাদা আমরা কখনও ক্ষুন্ন হতে দেব না দুর্নীতি, অন্যায়, শোষণ কিংবা উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তির কাছে। আমরা বিশ্বাস করি একতার শক্তিতে। আমরা বিশ্বাস করি সততার শক্তিতে। আমরা কোনো বাধাকেই বাধা মনে করি না এবং ভবিষ্যতেও তা করব না। সংগ্রাম চালিয়ে যাব সত্যের পথে, দেশের বুক থেকে আগ্রাসী অন্যায়, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি সমস্যার কালো ছায়া দূর না-হওয়া পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য হোক অবিচল, আদিগন্ত ঐক্য এবং নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন