শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

বিজয় দিবসে প্রত্যাশা সফলতা ও ব্যর্থতার খতিয়ান

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ, উন্নয়ন, শান্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, মূল্যবোধ এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ননের সূচকে স্বাধীনতার ৪৬ বছরে আমাদের অর্জন কতটুকু এসেছে তা মূল্যায়নের দাবি রাখে। এই ৪৬ বছরে আমাদের অর্জনকে যদি নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করি তাহলে দেখা যাবে অর্জন কিন্তু কম নয়। তবে আমরা আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পূর্ণ হলেও আমরা এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। আমরা ২০১৫ সালেই কেবল নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। যেসব দেশের মাথাপিছু আয় ১০৪৫ ডলার বা তার নিচে তাদের নি¤œ আয়ের দেশ বলা হয়। যেসব দেশের মাথা পিছু আয় ১০৪৬ ডলার থেকে ১২৭৩৬ ডলার তাদের মধ্যম আয়ের দেশ বলা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার। সেই হিসাবে আমরা নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশ। আর ২০১৬-২০১৭ সালে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ১৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে এখনো দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। কয়েক লক্ষ মানুষ বস্তিতে বাস করে। দেশের সকল মানুষ এখনো শিক্ষিত হয়নি। সকল মানুষ এখনো বিদ্যুত সুবিধা পায়নি, পায়নি চিকিৎসা সেবা এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সুবিধা। মাদকের ভয়াবহতা যুব সমাজকে গ্রাস করেছে। ফেনসিডিল, ইয়াবা আর হেরোইন আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান বরাবরই উপরে। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি স্থায়ী আসন গেড়েছে। দেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) কর্তৃক ২০১৭ সালের ১ মে প্রণীত ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলাপিং কান্ট্রিজ : ২০০৫-২০১৪ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে এক অর্থ বছরে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১০০০ (এক হাজার) কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জিএফআই কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫৮৮ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলাপিং কান্ট্রিজ : ২০০৪-২০১৩ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০০৪ সালে ৩৩৫ কোটি ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৮ কোটি ডলার, ২০০৭ সালে ৪১০ কোটি ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৬১৩ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৫৪১ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি ডলার এবং ২০১৩ সালে ৯৬৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এসব অর্থ বাংলাদেশিরা বিদেশে পাচার করেছে। যদি ১ ডলারের গড় মূল্য ৭৫ টাকা হিসাব করা হয়, তাহলে এ দশ বছরে পাচার হওয়া অর্থের বাংলাদেশি টাকায় পরিমাণ ৪,১৯,১০০ কোটি টাকা। আর শুধুমাত্র ২০১৪ সালে পাচারকৃত মুদ্রার বাংলাদেশি মান হচ্ছে ৭৫০০০ কোটি টাকার বেশি এবং গড়ে প্রতি বছর পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৪১,৯১০ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেহেতু প্রতিবছরই অর্থ পাচার হয়েছে, সুতরাং অর্থ পাচারের এই ধারা ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালেও অব্যাহত থাকাটা স্বাভাবিক। এদিকে ২০১৪ সালের জুন মাসে ইউএনডিপি কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতার পর থেকে চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ শতাংশ। সে হিসাবে গত চার দশকে প্রায় ৩ (তিন) লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই অর্থ যে দেশের শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরা পাচার করেছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কারণ এদেশের সাধারণ মানুষেরা অর্থ পাচারের কথা কল্পনাও করতে পারে না। এসব টাকা যে ব্যাংক থেকে গ্রহণ করা ঋণেরই একটি অংশ, তাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
ব্যাংকগুলোতে এখন খেলাপী ঋণের পাহাড় এবং এর পরিমাণ এক লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আইনী প্রক্রিয়ায়ও টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলো ভারাক্রান্ত এবং অস্থিরতার মুখোমুখি। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতেই হবে। কারণ ব্যাংক স্থিতিশীল এবং গতিশীল না হলে অর্থনীতিও স্থিতিশীল এবং গতিশীল হবে না। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পুলিশ মানুষের আস্থা এবং নির্ভরতার প্রতীক হলেও, পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন মানুষ খুন হচ্ছে, না হয় গুম হচ্ছে। নারী নির্যাতন এবং ইভটিজিং বেড়ে চলেছে। ভোটাধিকার নিয়ে এখনো মানুষ উদ্বিগ্ন। জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট এবং জাতি আজ বিভক্ত। ঐক্যের পরিবর্তে সর্বত্রই আজ অনৈক্যর সুর। অথচ, অন্যান্য দেশ জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে আজ উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং শান্তির পথে অগ্রসরমান। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে যেসব দেশের অবস্থান ছিল আমাদেরই কাতারে, সময়কে যথাযথ এবং পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে তারা আজ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। দারিদ্র্য, অশিক্ষা আর হতাশাকে জয় করে তারা আজ উন্নত, শিক্ষিত এবং ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিংগাপুর তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আর আমরা কলহ আর বিবাদে সর্বদাই ব্যস্ত। অপ্রয়োজনীয় এবং অহেতুক কাজে ব্যয় হচ্ছে আমাদের মূল্যবান সময়।
এদিকে যানজটের কারণে ঢাকা শহর বিপন্ন। বিশ^ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, যানজটে বছরে ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকা আর প্রতিদিনই নষ্ট হচ্ছে ৩২ লক্ষ কর্মদিবস। সংস্থাটির মতে, তীব্র যানজটের কারণে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় গড়ে ৭ কিলোমিটার এবং ২০২৫ সাল নাগাদ ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার। গত ২০ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার উন্নয়ন সম্ভাবনা’ শীর্ষক বিশ^ব্যাংকের এক সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ^ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেছেন, ১০ বছর আগেও ঢাকায় যানবাহনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকায় যানজটের জন্য প্রাইভেট কারের অত্যাধিক উপস্থিতিই দায়ী। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, এই বছরের মে মাস পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বাসের চেয়ে সাত গুণ বেশি প্রাইভেট কার চলেছে। এ অবস্থায় ঢাকা শহরকে যানজটের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য প্রকৌশলী এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে আজ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
খাদ্য উৎপাদনে আমরা এখনো স্বনির্ভর হতে পারিনি। দেশের চাহিদা অনুযায়ী চাল উৎপাদন আমরা করতে পারিনি। বন্যার কারণে প্রতি বছর অনেক ধান নষ্ট হয়ে যায়। এ বছর বাঁধ ভেঙ্গে হাওর ডুবে যাবার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ২০১৭ সালের বছর জুড়েই চাল নিয়ে আলোচনা চলেছে এবং চালের বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। চালের দাম বাড়ার কারণে গরীব মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদা মিটাতে গিয়ে সরকারকে প্রচুর পরিমাণে চাল আমদানি করতে হয়েছে। এ অবস্থায় খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং তার জন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি কৃষি জমিকে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশ এখন একটি নতুন সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আর সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এতগুলো আশ্রয়হীন মানুষকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিরাট মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন। কিন্তু এতগুলো মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে আশ্রয় দেয়া এবং তাদের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নেয়া এবং তাদের নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে দেয়াটাই হচ্ছে এই সংকটের একমাত্র সমাধান। আর এই সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘসহ আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে হবে। আর এই সমস্যা যত তাড়াতাড়ি সমাধান হয় ততই বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ।
এতক্ষণ কেবল সমস্যার কথা বলেছি। এবার আমাদের সফলতার কিছু কথা বলি। শিক্ষার হার বেড়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। পরীক্ষায় নকল বন্ধ হয়েছে কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস অব্যাহত রয়েছে। তাই যে কোন উপায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে হবে। আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করে চলেছি। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা আমাদের জন্য একটি অনন্য মাইলফলক। আমরা ১৫০০০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সীমা অতিক্রম করেছি। আমরা এখন বিশ্ব পরমাণু ক্লাবে প্রবেশ করেছি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা এ সফলতা অর্জন করেছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের ৩২তম দেশ। নারীর শিক্ষা, বাল্যবিবাহ বন্ধ এবং নারীর ক্ষমতায়নে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। ২০০৯ সালে সরকারি চাকুরিতে নারীর সংখ্যা ছিল ২২৭১১৪ জন, ২০১৫ সালে এর সংখ্যা হচ্ছে ৩৭৮৩৫৪ জন। বর্তমান প্রশাসনে ১০ সচিব, ৬ ডিসি, ১৬ এডিসি এবং ১০৬ উপজেলার ইউএনও নারী। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপে তিন পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে এবং সেগুলো হল টি-শার্ট, ছেলেদের শার্ট এবং ট্রাউজার এবং শর্টস। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৮.১৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। একই সময়ে মোট রপ্তানি মূল্য ছিল ৩৪.৬৫ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং দেশের রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮১ ভাগই পোশাক খাত থেকে অর্জিত হয়েছে। পোশাক শিল্পের এ অর্জন আমাদের ধরে রাখতে হবে।
পোশাক খাতের পর সবচেয়ে বেশি আয় করেছে রেমিট্যান্স খাত। বিদেশে বর্তমানে প্রায় ৮০ লক্ষ বাংলাদেশি কর্মরত আছে। তারা ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে যথাক্রমে ১৪.৯৬, ১৫.৩৬ এবং ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব কতটুকু, তা সহজেই অনুমেয়। এ খাতে যেন আরো সমৃদ্ধি আসে, তার জন্য সরকারকে আরো উদ্যোগ নিতে হবে। চামড়া শিল্পেও আমরা এগিয়ে চলছি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাত আয় করেছে ১২৩ কোটি ডলার আর এর স্থানীয় বাজার হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ঔষধ শিল্পে আমাদের সফলতা ঈর্ষণীয়। এদেশে ঔষধের আভ্যন্তরীণ বাজার মূল্য ১৩০০০ কোটি টাকা। এর ৯৮ শতাংশই আমরা নিজেরা পূরণ করছি। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ১২৭টি দেশে ঔষধ রপ্তানি করে। যুক্তরাষ্টের বাজারেও আমরা ঔষধ রপ্তানি করছি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮৩৭ কোটি টাকা মূল্যের ঔষধ রপ্তানি করেছে। ঔষধ শিল্পের এই অগ্রযাত্রাকে আরো দ্রæতায়িত করতে হবে। শিশুর খেলনা রপ্তানিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের শিশুদের হাতে বাংলাদেশের তৈরি খেলনা শোভা পাচ্ছে। ৫ বছরে এই খাতে রপ্তানি বেড়েছে ২ হাজার গুণের বেশি এবং মোট রপ্তানির অর্ধেক হয় ফ্রান্স, স্পেন ও জাপানে। চলতি বছরের (জানুয়ারি-জুলাই) ৭ মাসে এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ৯ লাখ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দেশের অর্থনেতিক উন্নয়নে সরকার যে ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠা করছে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। জাপানের হোন্ডা মোটর কর্পোরেশন মোটর সাইকেল প্রস্তুতের জন্য বাংলাদেশে হোন্ডা কারখানা স্থাপন করছে। এটা বিদেশি বিনিয়োগের একটি মাইলফলক।
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা অতিব উজ্বল। জাতিসংঘের ৫৬টি মিশনের ৫৪টিতেই বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেছে। ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত ৩০ বছরে ১৩২৬১৮ জন শান্তিরক্ষী শান্তি মিশনে কাজ করেছে। বর্তমানে ১২টি মিশনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত হাজার শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। বিগত ১০ বছরে এই খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ১.২৮ বিলিয়ন ডলার। সোনালী আঁশ বলে পরিচিত পাটের সুদিন আবার ফিরে আসছে। পাট এবং ছত্রাকের সাতটি জিনের পেটেন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের কোথাও নতুন জাতের বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে এখন থেকে অর্থ দিতে হবে। ২০১১ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর হাতে যে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাটের ব্যাগ তুলে দেয়া হয়েছিল সেগুলো কিন্তু বাংলাদেশের তৈরি। ১৯৭০ সালে যেখানে ৯ লাখ একর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে, সেখানে ২০১৭ সালে ২০ লাখ একর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। সাথে সাথে পাট পণ্যের ব্যবহার, চাহিদা এবং রপ্তানি বাড়ছে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে আমরা নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। ২০১৬ সালে এখাতে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ২২ লাখ টন। মাছের রাজা ইলিশের উৎপাদনেও আমরা সফলতা অর্জন করেছি। ১৯৯০ সালে যেখানে ইলিশ উৎপাদন হতো ১.৮২ লাখ টন, সেখানে ২০১৬ সালে এসে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ টন। ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে চলছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে পেয়ারা উৎপাদনে সপ্তম এবং আম উৎপাদনে অষ্টম। বার্ষিক ফল রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। বয়লার মুরগী এবং ডিম উৎপাদনে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে এখন প্রতি সপ্তাহে ৯৫ লাখ থেকে ১ কোটি ১০ লাখ মুরগীর বাচ্চা প্রয়োজন হয় এবং এর পুরোটাই আমরা নিজেরা উৎপাদন করছি। ডিমের উৎপাদনও বেড়েছে। ২০১৫-১৬ বছরে এদেশে ১১৯১ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। ডেইরি শিল্পের উন্নয়নেও আমরা এগিয়ে চলছি। বর্তমানে দেশে দুধের চাহিদা ১৪০ লাখ টন এবং আমরা উৎপাদন করছি ৭০ লাখ টন। ডেইরি শিল্পের বিকাশে সরকার কাজ করছে এবং এই সেক্টরকে এগিয়ে নিতে হবে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও আমরা এগিয়ে চলছি। বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ করছে এবং সেই জাহাজ বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করছে। সিমেন্ট উপাদনেও আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং রপ্তানি করছি। রড, টেউটিন, সিরামিক, টাইলসসহ নির্মাণ সামগ্রীতেও আমরা স্বনির্ভরতা অর্জন করেছি। আমাদের এই সফলতা সম্মানের এবং গৌরবের। আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সবার সম্মিলিত প্রয়াস অপরিহার্য।
তবে সমস্যার কথা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। অতীতের যা কিছু ভুল এবং অন্যায়, তাকে চিরতরে বিদায় করে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য সর্বদা প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এদেশেই আমরা জন্মেছি, এদেশেই আমরা বসবাস করব এবং এদেশকেই আমাদের গড়তে হবে। তাই নিজেদের কল্যাণের স্বার্থেই আসুন, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই এবং দেশের উন্নতির জন্য কাজ করি। মনে রাখতে হবে, ঐক্যেই শক্তি, ঐক্যেই শান্তি। ঐক্যবদ্ধ জাতি মানেই ঐক্যবদ্ধ শক্তি। অপরদিকে অনৈক্য মানে বিভক্তি, যা একটি জাতিকে দিন দিন কেবল দুর্বল করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ৩০০ আসনের মাঝে ১৫৩টি আসনেই কোন নির্বাচন হয়নি। এসব আসনের সংসদ সদস্যরা সবাই বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত। বিএনপি জোট এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমানে সংসদের বিরোধী দল আবার সরকারেরই অংশ। এদিকে নতুন সংসদ নির্বাচনের দিন দ্রæত ঘনিয়ে আসছে। এই নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। একই সাথে এই নির্বাচন হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং স্বতঃস্ফুর্ত। তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে আরো বহু দূর। শান্তি, উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের স্থায়ীত্ব ও বিকাশের স্বার্থে আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই। আসুন, আমরা হিংসা, বিদ্বেষ এবং হাহাহানি বন্ধ করি। প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসা এবং মায়ার বন্ধনে জীবনকে সাজাই। আসুন, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করি, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানক রূপ দেই, মাদককে নির্মূল করি, নারী নির্যাতন বন্ধ করি, মানুষের মৌলিক অধিকার এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করি।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন