শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

তেইশ মার্চ একাত্তর : কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব

১৯৭১ সালের তেইশ মার্চ ছিল এদেশে পাকিস্তানের শেষ প্রজাতন্ত্র দিবস। ক’দিন পরই পাকিস্তানের ইতি ঘটে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে একটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিবর্তন আসে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বা পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে জন্ম নেয়স্বাধীন রাষ্ট্রÑ বাংলাদেশ।
একাত্তরের গোটা মার্চ মাসই ছিল উত্তাল। অগ্নিঝরা। আন্দোলন-সংগ্রামে কেবল পূর্ব পাকিস্তানই নয়, সমগ্র পাকিস্তানের গণমানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একচ্ছত্র নেতা আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছয়দফা কর্মসূচির স্বপক্ষে রায় দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলা ও বাঙালির মুক্তি সনদ ছয়দফা কর্মসূচিকে ‘ছয়দফার রেফারেন্ডাম’ বলে ঘোষণা।
পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রী প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমি শাসকগোষ্ঠী বরাবরই বাংলা ও বাঙালির প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ছিল। ’৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুতি, ’৫৮ সালে আয়ুবী সামরিক স্বৈরশাসন, সংবিধান বাতিল, ’৬২ সালে মনগড়া সংবিধান প্রণয়ন, এবডো-প্রডো জারি, গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আপসহীন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বারবার মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার এবং সর্বোপরি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রজুতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নগ্ন চেহারা প্রকাশ পায়। এমতাবস্থায় ১৯৬২ সালে সাবেক ছাত্রনেতা, রাষ্ট্র সমাজচিন্তক, তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামেও অভিহিত। তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের ‘নিউক্লিয়াস’-এর কার্যক্রম রাজধানী ঢাকা থেকে মফস্বল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগের ছয়দফা এবং সংগ্রামী ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক এগারো দফা কর্মসূচির মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-যুব গণআন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনের পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য উত্থাপিত দাবি জাতীয় দাবিতে রূপান্তরিত হয়। এসময় রব-সিরাজ-সিদ্দিকী-মাখনের নেতৃত্বাধীন ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ বাংলা ও বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে বীরত্ব ও কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর নেতা চতুষ্টয় ছিলেন ডাকসুর তৎকালীন জনপ্রিয় ভিপি, ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আব্দুর রব, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি অনলবর্ষী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকী এবং ডাকসুর জি এস ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখন (অকালপ্রয়াত, তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি)।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলাধীন জগৎসী গোপালকৃষ্ণ হাই স্কুলের মেট্রিকুলেশনের ছাত্রাবস্থায় পঞ্চাশের শেষভাগ ও ষাটের দশকের শুরুতে ‘হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন, রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলনে’- “ছাত্র হত্যার বিচার চাই, কুখ্যাত হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল কর” (যদিও তখন রিপোর্টে কি ছিল জানতাম না, বুঝতাম না) শ্লোগান দিয়ে তৎকালীন মহকুমা সদর মৌলভীবাজার আসতাম। অতঃপর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির ভালোমন্দ এবং দেশের হালচাল দেখেশুনে ছাত্রলীগে যোগদান করি। সত্তর দশকের শুরুতে প্রথমে মৌলভীবাজার কলেজ শাখা, অতঃপর মৌলভীবাজার মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পাই। তৎকালীন ইকবাল হল- বর্তমানের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছিল ছাত্রলীগ নেতাদের ঘাঁটি ও আস্তানা। সাংগঠনিক কাজে ইকবাল হল এবং ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় অফিস ৪২, বলাকা ভবনে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শ ও সহচর্যে যাবার সুযোগ পাই। নেতৃবৃন্দ খুবই ¯েœহের চোখে দেখতেন, এখনও দেখেন। পূর্বে উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ ছাড়াও আরো চারজন কেন্দ্রীয় নেতার (যারা স্বাধীনতা-সংগ্রামের সময় মুজিব বাহিনীর চার আঞ্চলিক অধিনায়ক ছিলেন) সঙ্গে কাজকর্মে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করি। এই চার নেতা হলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি (পঁচাত্তরের পনের আগস্ট সপরিবারে নিহত), আব্দুর রাজ্জাক (মরহুম) এবং তোফায়েল আহমদ (বর্তমানে বাণিজ্যমন্ত্রী)। মুজিব বাহিনীর এই চার আঞ্চলিক অধিনায়ক স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাংবাদিকতার সুবাদে বাংলার বাণীর স্থানীয় প্রতিনিধি হিসাবে বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনির কাছে যাবার সুযোগ পাই। বাংলার বাণী তখন সাপ্তাহিক হিসাবে পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসের এক কোণ থেকে বের হত।
একাত্তরের মার্চ মাসে উত্তাল দেশ। ক্ষমতা হস্তান্তরে পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের টালবাহানা, আলোচনার নামে সৈন্য মোতায়েন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ডাকসু ভিপি আ স ম রব কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, পল্টন ময়দানে শাহজাহান সিরাজ কর্তৃক স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, সাত মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং তারই ‘আহ্বানে’ অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি আইন ও প্রশাসন অকার্যকর হয়ে যায়। প্রশাসন ও জনগণ তখন চলতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে। দেশব্যাপী তখন পতপত করে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা, গণহত্যার প্রতিবাদে কালো পতাকা। পাকিস্তানি প্রশাসন ও পাকিস্তানি পতাকা তখন ক্যান্টনমেন্ট আর সামরিক দপ্তরসমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
তেইশ মার্চ, একাত্তর। পাকিস্তানের ‘প্রজাতন্ত্র দিবস। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। ৬৮ সালে মৌলভীবাজার কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী নিয়ে আমি আমার পিতার পরামর্শ মোতাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ক্লাসে ভর্তি হই। তখন থেকে আমি ঢাকাবাসী এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকা-ে নিয়োজিত। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান ও সংঘটিত করার জন্য আমি মৌলভীবাজার চলে আসি। তখনকার পরিচিত ও জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল- “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার নেতা-আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব” ইত্যাদি
একাত্তরের তেইশ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচি হিসাবে মৌলভীবাজার মহকুমা সদরস্থ চৌমুহনায় এদিন বিকাল ৩টায় এক বিশাল ছাত্র গণজমায়েত আহ্বান করা হয়। ঐ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহকুমা ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী। সভাটি পরিচালনায় ছিলেন ছাত্রলীগ মহকুমা শাখার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নূরুল ইসলাম মুকিত। ঐ বিশাল সমাবেশের প্রধান অতিথি, মহকুমা ছাত্রলীগের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা মুজিবুর রহমান মুজিব (এই নিবন্ধকার, বর্তমানে আইনজীবী ও সাংবাদিক) বিপুল করতালি এবং মুহুর্মুহু জয় বাংলা শ্লোগানের মাধ্যমে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন, জিন্নাহ সাহেবের ছবি পুড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি উড়ান। চৌমুহনাস্থ মুক্তা স্টুডিও সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের আলোকচিত্র নিজস্ব ক্যামেরায় ধারণ করে।
বাংলাদেশের ন্যায় সমগ্র মৌলভীবাজার মহকুমায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। শুধুমাত্র কমলগঞ্জে পাকিস্তানপন্থীরা পতাকা উত্তোলন এবং প্রতিরোধ দিবস পালন করতে দেয়নি। এই সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে আমরা সদলবলে পরদিন ২৫ মার্চ কমলগঞ্জ যাই, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি এবং সাবরেজিস্টারি অফিস মাঠে আমি এক জনসভায় ভাষণ দিয়ে পাকিস্তানপন্থীগণকে রাজনৈতিকভাবে আমাদের মোকাবেলা করার আহ্বান জানাই।
পঁচিশ মার্চই ছিল পাকিস্তানের শেষ দিন। ঐদিন কালরাত্রিতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকহানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, শুরু করে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ। দেশ ও জাতির সেই মহাক্রান্তিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক দেশপ্রেমিক মেজর স্বদেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘোষণা দেন- I major Zia, on behalf of our great leader Bongo Bondhu Sheikh Mujibur Rahman do hereby declare the Independence of Bangladesh.
শুরু হয় জীবন দেয়া-নেয়ার এক মহাসমর, বাংলা ও বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ মহাসমরের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর। স্বাধীন বাংলাদেশ না হলে তেইশ মার্চ একাত্তর প্রতিরোধ দিবসের কুশীলবগণকে হয়তো ফাঁসিকাষ্টে ঝুলতে হত, আমাকেও।
লেখক: সিনিয়র এডভোকেট- হাইকোর্ট, মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সভাপতি- মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব, কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন