গোটা বিশ^ই এখন সবুজ অর্থনীতির কথা ভাবছে। প্রতি বছর ৫২ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে বিশ^ব্যাপী। এ কারণে বিশ^ সবুজায়নের পথে অগ্রসর হতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বিশে^ এখন সবুজের সমারহের চেয়ে জঞ্জালের সমারহ বেশি। ইট, বালু, সিমেন্ট আর রডের নির্মিত দালান কোটা, শপিংমল এগুলো সবুজকে ধ্বংস করছে। গাছ এখন খুঁজতে হয় বিশেষত ঢাকার বিশেষ-বিশেষ এলাকায় গিয়ে। গাছ যে অর্থনীতির চালিকা শক্তি প্রযুক্তিবিদরাও ভুলে গেছে এবং এর মাসুল দেয়াও শুরু হয়ে গেছে। ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ রাজধানীতে আয়োজিত একটি কর্মশালায় বলা হয়েছে, দ্রæত এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোতে বায়ু এবং পানি দূষণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শুধু বায়ু দূষণের ফলে বছরে যে ক্ষতি হচ্ছে তার আর্থিক পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এক শতাংশের উপরে। এছাড়া শহরের দূষণ বৃদ্ধির ফলে শিশুদের আই-কিউ বা মেধার বিকাশ হ্রাস পাচ্ছে। এটা ¯œায়ুবিক অসুখের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মশালায় প্রধান অতিথি পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, দেশের সবুজ অর্থনীতির অভাবে জিডিপির ৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে দুর্নীতির কারণেও ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির ৩ শতাংশ। এটা অবশ্যই অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের সংবাদ। ২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলের ৫৩ লাখ মানুষ। আমরা মনে করি, পরিবেশ সুরক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনোই টেকসই হয় না। শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে পরিকল্পিতভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করতে হবে। দেশে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব শিল্প গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোক্তাদের এ ব্যাপারে সুপরিকল্পিত নীতিমালা অনুসরণ ও যথাযথ সুযোগ-সুবিধার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। একইভাবে বায়ু ও পানি দূষণের কারণ সম্পর্কে জনসচেতনতাও গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় এসবই সবুজ অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। প্রকৃতির ভারসাম্য এবং পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে এমন অর্থনীতি আমাদের কাম্য। গোটা বিশ^ এই চিন্তায় ধাবিত হচ্ছে।
সরল অর্থে বলতে গেলে সবুজ অর্থনীতি হলো সেই অর্থনীতি যা মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে অন্যদিকে পরিবেশগত ঝুঁকি কমাবে এবং অভাব দূর করবে। সরকার সবুজ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বেশ কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইটভাটা থেকে বায়ু দূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে পুরনো ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে সংশ্লিষ্ট দফতরকে র্নিদেশনা প্রদান করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটার অর্থ এমন ইটভাটা যা জ¦লানি সাশ্রয়ী ও উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন হবে। সরকারের নির্দেশে ব্যাংকগুলো পুরনো ইটভাটা তৈরির জন্য এখন ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। নবায়নযোগ্য জ¦ালানি আইন অনুমোদন করা হয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ ও ব্যায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সকল জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপন করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ¦ালানির উপর প্রথম ৫ বছর আয়কর মওকুফ করা হয়েছে। জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহী করতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্জ্য থেকে জৈবসার তৈরির প্রকল্প চালু করে ইতোমধ্যেই আমরা কার্বন ক্রেডিট লাভ করেছি। দূষণ নিয়ন্ত্রণে এনফোর্সমেন্ট ও মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে সবুজ অর্থনীতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নযন হলেও সবুজ অর্থনীতির তেমন সম্প্রসারণ হয়নি। বেকারদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। সবার আগে পরিকল্পনাহীন আবাসন ও শিল্পকারখনা নির্মাণের নামে কৃষি জমি নষ্ট ও নদী নালা ভরাট-দখল-দূষণ বন্ধ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে- কৃষি, বন, মৎস্য ও পনির উপর পর্যাপ্ত বিনিয়োগই পারবে সবুজ অর্তনীতির বেশির ভাগ যোগান দিতে। এ ছাড়া সবুজ অর্থনীতির যোগানদাতা হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, বর্জ্য পুনঃব্যবহার, দালান কোঠা নির্মাণ, যানবাহন, পর্যটন ও শহর বিনির্মাণ খাতে প্রচুর সম্ভাবনা আছে।
পৃথিবীর বহু দেশের মাথাপিছু জিডিপি পরিবেশের নিয়ামক ভেদে ৪০০০ থেকে ৩৫,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু জিডিপি হচ্ছে প্রায় ১৭০০ মার্কিন ডলার। অর্থনীতির স্বাভাবিক ইউ-টার্ন পর্যন্ত পৌঁছাতে আরো একশত বছর বাংলাদেশের জন্য পর্যাপ্ত কিনা তা অর্থনীতিবিদরাই বলতে পারবেন। তবে এতটুকু বলা যায়, নিশ্চিতভাবে যদি আমরা আমাদের দ্রæত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিবেশের সুস্থতাকে এখনি সংযুক্ত না করি তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। মনের মধ্যে স্বপ্ন লালন করে বসে থাকলে সবুজ অর্থনীতি স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে, বাস্তবে এর খোঁজ মিলবে না। দেশ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে বুঝা যায়, আমাদের পরিবেশের সুস্থধারা সবকিছুই একদিন শেষ হয়ে যাবে। আমরা আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারব না। বন ধ্বংস, জীব বৈচিত্র্য ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া, পানি ও মাটি দূষণ, বর্জ্য অপসারণসহ নানা সমস্যা বিদ্যমান। খাদ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক অসমতাও লক্ষ করছি। তাছাড়া বৈশি^ক জলবায়ু পরির্বতনের প্রভাবে পৃথীবির সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এখনই সতর্ক না হলে পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। এর থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশেকে সবুজ অর্থনীতিতে প্রবেশ করা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। গবেষেকদের বিভিন্ন গবেষণায় যে বিষয়টি উঠে এসেছে সেটি হল, সবুজ অর্থনীতিতেই খুব দ্রæত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয় এবং দারিদ্র্য বিমোচনসহ শক্তি ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করা যায়। এক জরিপে দেখা গেছে, গত ৪০ বছরে পৃথিবীর মোট সম্পদ যা আছে তার উপর মানুষের চাহিদা না কমে বরং আরো দ্বিগুণ বেড়েছে। তার তুলনায় খাদ্যস্ফীতি বাড়েনি। গোটা দশেক রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে হবে কারণ ঐসব রাষ্ট্র সম্পদশালী। কিন্তু জনসংখ্যা তাদের বেশি নয় এজন্য তাদের অর্থনীতি কখনো বাধাগ্রস্ত হয় না। বাংলাদেশ সহ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের জনসংখ্যা বাদবাকি বিশে^র জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি কিন্তু তারা সম্পদশালী নয়। এজন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে খুব সাবধানে বিশেষ করে পরিবেশ ও প্রতিবেশ অনুকূলে রেখে সবুজ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমি যে কথাটি বলতে চাচ্ছি, সেটি হলো বনজ সম্পদ রক্ষা এবং পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ না করা। যদি করা হয় তাহলে সবুজ অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। সিডর, আইলা, নার্গিস এধরনের ঝুঁকি আগামী ২৫ বছরে আরো বাড়বে বলে সংকেত দেওয়া আছে। ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রচুর বনায়ন প্রয়োজন, সুন্দরবনের মতো আরো ২০টি বনাঞ্চল তৈরি করতে হবে। বনভূমিই পারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ঠেকিয়ে দিতে। দুঃখজনক যে, আমরা প্রতিদিন প্রচুর বৃক্ষ কাটছি। মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে সহ¯্রাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আরো কাটা হবে। এমনিতেই ঢাকাতে আবাসন এতো ঠাসাঠাসিভাবে নির্মিত হয়েছে যেখানে নির্মল বায়ু ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। বৃক্ষের সমারহ এবং খালবিল নদীনালা না থাকলে কখনোই জলবায়ু প্রাণিজগতের পক্ষে অবস্থান করবে না। এটা হল ¯্রষ্টার সৃষ্টির আদি রহস্য। সবুজ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বায়ুমন্ডলকে উষ্ণ রাখা যাবে না। উষ্ণ বায়ুমন্ডলে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন কম হয়। কারণ সেখানকার মাটি অর্নুভর ও শক্ত বা কঠিন থাকে। বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করতে হয় যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে বিশ^ব্যাপী যে গ্যাস (গ্রিন হাউজ গ্যাস) নির্গমন হচ্ছে তা বায়ুমন্ডলের স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি। যদি একজন মানুষের যে পরিমাণ ভার বহন করার ক্ষমতা আছে তার চেয়ে ৩০% ভাগ বেশি বহন করতে দেওয়া হয়, তাহলে যে পরিস্থতি তৈরি হবে, বর্তমান পৃথীবিকেও তার ক্ষমতার থেকে অধিক ভার বহন করতে দিয়ে একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছি আমরা। সবুজ অর্থনীতির এই কনসেপ্টটি বিপদসংকুল পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার সবুজ সংকেত দিচ্ছে। উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগই পারবে এই সবুজ অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান জাতি হিসেবে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সবার আগে তাই ভাবতে হবে কোনোভাবেই পরিকল্পনাহীন আবাসন বা শিল্প প্রতিষ্ঠার নামে কৃষি জমি নষ্ট ও নদী নালা ভরাট-দখল-দূষণ বন্ধ করতে হবে।
সবুজ অর্থায়নে যুক্ত হয়েছে তিন পণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন যোগ্য খাতের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলে নতুন এই তিন পণ্য যুক্ত। এখন এই তহবিলে পণ্য সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৭ এ। নতুন যুক্ত হওয়া পণ্য তিনটি হল: সবুজ শিল্প (গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি) প্রতিষ্ঠা, সোলার পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলন ও সরবরাহ প্রকল্প এবং কল-কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সবুজ শিল্প স্থাপনে মিলবে সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকা। বস্ত্র ও পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রকল্পে পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার ঋণ। সোলার প্রকল্প ঋণ পাবে সমবায় সমিতি, যৌথ বা একক ভিত্তিতে ব্যবহারকারী পরিবার বা প্রতিষ্ঠান অথবা যৌথ কারবারী প্রতিষ্ঠান। এক কথায় বলা যায়, পরিবেশকে উপেক্ষা করে পৃথিবীতে কিছুই করা যায় না।
পরিশেষে বলবো, পরিবেশের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কাজ করছে কিনা তা দেখাশোনার জন্য একঝাঁক তরুণকে নিয়োগ দিতে হবে, পাশাপাশি শাস্তির বিধান রেখে পরিবেশ আদালত গঠন করতে হবে। এসব কাজ তড়িৎভাবে করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশকে সবুজ অর্থনীতির দেশে পরিণত করা হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের কৃষি জমি যাতে না কমে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের অবস্থান যেন আর খারাপ না হয়, ভূমির ক্ষয়রোধ, নদী ভাঙ্গন, জমির উর্বরতা রক্ষায় আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। ক্যামিক্যল জাতীয় সার ব্যবহার না করে কৃষিজাত পণ্যের বর্জ্যকে সার হিসেবে ব্যবহার করলে খাদ্যে বিষক্রিয়া দ্রæত হ্রাস পাবে এবং বিদেশে রপ্তানি বাণিজ্যও বৃদ্ধি পাবে। এভাবেই সবুজ অর্থনীতি আমদের দেশের চেহারায় আমূল পরিবর্তন এনে দেবে।
লেখক: গ্রন্থকার, গবেষক এবং কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন