শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

শিক্ষা, উৎপাদন, উন্নয়নে ফরিদগঞ্জ এবং দক্ষিণ এশীয় হাইওয়ে প্রসঙ্গে

এহসানুল কবির | প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ৭১% আর পাকিস্তানে ৫১%। যদি প্রশ্ন করা হয়, দেশের ভেতর এই শিক্ষিতের হার কোথায় বেশি? এমন একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকের হয়তো মাথা ঘামাতে হবে। এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ঢাকা শহর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বাগেরহাট এবং ফরিদগঞ্জ। বর্তমানে ফরিদগঞ্জ চাঁদপুরের একটি উপজেলা। এখানে কলেজ রয়েছে সাতটি। হাইস্কুল প্রায় ৭৫টি। মাদরাসা, মক্তব আর কিন্ডার গার্টেন স্কুলের সংখ্যা প্রায় তিনশ’। গত শতকের আগে বাংলাদেশে কলেজ ছিল মোট ৯টি। আজ সেখানে একটি থানা সদর ফরিদগঞ্জে কলেজ রয়েছে সাতটি।
তৎকালীন পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষিত করার লক্ষে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তেমনি ফরিদগঞ্জকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার ব্যাপারে একজন মহান ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের অলক্ষে প্রশংসনীয় ভ‚মিকা রেখে গেছেন। তিনি হলেন মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান। ফরিদগঞ্জের আনাচে-কানাচে সর্বত্র স্কুল নির্মাণে তার কৃতিত্ব ছিল অনন্য। তাই হয়তো সরকারের মন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, নামকরা চিকিৎসাবিদ, প্রকৌশলী, ধর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী, জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, প্রথিতযশা সাংবাদিক, শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী, দেশবরেণ্য আলেম এবং জাতীয় পর্যায়ের অনেক খ্যাতিমান জ্ঞানী-গুণী মানুষের জন্মস্থান এই ফরিদগঞ্জ।
প্রাচীনকালের সমতট অর্থাৎ আজকের বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের পূর্ব অঞ্চলে প্রবেশের ‘গেটওয়ে’ ছিল চাঁদপুর। ডাকাতিয়ার প্রবল স্রোতধারার সাথে মিশে গেছে বহু আরব বণিকের কাহিনী। নদীর তীরে ইসলাম ধর্মের প্রভাব সেই কাহিনীই বর্ণনা করে। এক সময় পর্তুগিজরা এই ফরিদগঞ্জে স্থাপন করে তাদের বাণিজ্যকুঠি- যা আজ সাহেবগঞ্জ নামে খ্যাত। তাদের নীল কুঠির ভগ্নপ্রায় অট্টালিকার চিহ্ন এখনও বর্তমান। কপার সালফেট (নীল)-এর পরই ডাচ ব্যবসায়ীদের কারণে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে ফরিদগঞ্জেও পাট চাষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফরিদগঞ্জবাসীর জীবন-জীবিকার তখনকার অবলম্বন ছিল ধান ও পাট চাষ। পাট ব্যবসায়ী বলে পরিচিত তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের ফরিদগঞ্জের বেশ কিছু পরিবার খ্যাতি অর্জন করে। পাটের মহলদার হওয়ার কারণে এই অঞ্চলের অনেকের পারিবারিক উপাধি পাটওয়ারী। বাংলাদেশের অতি চালাক-চতুর লোককে আজও বলা হয়, পাটওয়ারী বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। সেই সোনালি আলোর বর্তমান বেহাল অবস্থায় এখন তারা বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে রূপালী মাছের চাষ। ডাকাতিয়া নদীর প্রবাহধারার আশপাশে মরানদী, খাল, নালা-ডোবায় ছোট বড় পুকুরে যেমনি তেমনি মেঘনার তীরবর্তী চরাঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মৎস্য খামার। এর ফলে বিপুল সংখ্যক লোকের জীবন-জীবিকা এখন মৎস্য চাষের সাথে জড়িত। উৎপাদিত মাছ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীর মানুষের চাহিদা পূরণেও উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করছে।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনে কম খরচের জন্য একদা সদরে ইস্পাহানি ডাকাতিয়া নদী পুনর্খননের প্রস্তাব করেছিলেন। ডাকাতিয়ার আজ জীর্ণদশা। কিন্তু ৭০-এর দশকের শেষের দিকে, ইচলি-রায়পুর ও ফরিদগঞ্জ-হরিনাঘাট সড়ক নির্মাণের ফলে বড় বড় ফেরিতে করে মেঘনার ওপারে শরিয়তপুরের চেয়ারম্যান বাড়ি ঘাটে প্রতিনিয়ত শত শত ট্রাক পারাপার করছে। এর ফলে বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও বেনাপোল হয়ে কলকাতা পর্যন্ত এক যুগান্তকারী পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সম্ভব। চট্টগ্রাম থেকে কোনো পণ্যবাহী ট্রাক ফেনী-কুমিল্লা-ঢাকা হয়ে পদ্মা ব্রিজ বা যমুনা ব্রিজ পার হতে যে সময় এবং খরচ লাগে বা লাগবে তার অনেক কম খরচে, কম সময়ে একটি ট্রাক বেনাপোলে পৌঁছে যাবে। একদা মিসরের সুয়েজখাল মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণ এশিয়া, দূরপ্রাচ্যের সাথে ইউরোপের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজতর করেছিল। তেমনি ফরিদগঞ্জ-হরিনাঘাট সড়ক ও নদীপথের এই যোগাযোগ ব্যবস্থাটি দক্ষিণ এশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থায় সময় ও দূরত্ব হ্রাসের মাধ্যমে নতুন হাইওয়ে বলে পরিচিতি লাভ করতে পারে।
এক সময় ফরিদগঞ্জে সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণে সাড়া জাগিয়েছিল বিভাগ পূর্বকালে আবিদুর রেজা চৌধুরী। তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মোচনের সূচনালগ্নে ভ‚মিকা রেখেছিলেন ওলিউল্লাহ নওজওয়ান। ৭০ এ প্রাদেশিক পরিষদে রাজা মিয়া আর ৭৩ এ শফিউল্লা নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাওলানা এম এ মান্নান ও পরে আলমগীর হায়দার খান একাধিকবার এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আজ রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের ফলে জনগণের চোখে সমীহীন হতাশা ছাড়া কোন কিছুই পরিলক্ষিত হয় না। অল্পজ্ঞানী, অদুরদর্শী, রুচিহীন, শিষ্টাচারবহির্ভূত, শিক্ষার মর্মবাণী ও মানববিদ্যা বিবর্জিত একদল জাঁকজমকপূর্ণ লোক রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, শিক্ষাঙ্গন থেকে ক্রীড়াঙ্গন সর্বত্র জেঁকে বসেছে। এদের কারণে রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়নি উন্নত কালচার বা শিক্ষার। বরং সৃষ্টি হয়েছে মোসাহেবী পরশ্রীকাতরতা ও গুঢ় মনোবাঞ্ছার কদর্যতার। আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাক্সক্ষা সমগ্র জাতির। প্রচলিত মারিং-কাটিং, জবর-দখল, বলপূর্বক, উচ্ছেদ, মারদাঙ্গা রাজনীতির পরিবর্তে শিষ্ঠাচারের রাজনীতিতে প্রবর্তিত হলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকে ফরিদগঞ্জ আসনে মনোনয়ন পেতে পারেন ঢাকা-ট্যাকসেস বারের দুই-দুইবারের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আব্বাস উদ্দিন। এলাকার জনগণ এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের সাথে তার সম্পৃক্ততার উদহারণ রয়েছে প্রবল আকারে। তেমনি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমানও দৃশ্যপটে হাজির হতে পারেন। জাতীয় পার্টি এখানে ম্রিয়মান।
মরহুম মাওলানা মান্নানের একান্ত প্রচেষ্টায় এখানে প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধশ্রমটি সচল এবং কার্যকারীভাবে সক্রিয়। দেশের অন্যান্য স্থানে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত বিলুপ্তির পথে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতির ব্যর্থতা বেদনাদায়ক। এই প্রেক্ষাপোটে মানুষ আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাচ্ছে স্বজন ও স্বজাতির সেবায় নিবেদিত সৎ ও যোগ্য মানুষের জন্য।
লেখক: বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক বিশেষ সহকারী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন