শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

শিশুর প্রতি যথোচিত গুরুত্ব প্রদান করতে হবে

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইসলামী জীবনদর্শনে মানব সন্তান তথা মানব শিশু হচ্ছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নিয়ামত ও আমানত। শিশু পৃথিবীর আলোয় আগমনের পূর্ব থেকেই অনেকগুলো মৌলিক অধিকার লাভ করে। শিশুর অধিকার প্রদান ও সুরক্ষায় ইসলামী আইন ও দর্শন আপোসহীন। আজকের জাতিসংঘ বা বিশ্ব শিশুদের যেসব অধিকার ও সুরক্ষার সনদ বা নীতি প্রণয়ন নিয়ে ভাবছে- সেসব বিষয় এবং শিশুর জন্য আরো অনেক কল্যাণকর বিষয় নিয়ে ইসলাম সপ্তম শতাব্দীতেই পরিপূর্ণ নীতিদর্শন উপস্থাপন করেছে।
পৃথিবীতে মানবজাতি আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধি। মানব জাতির বংশধারা সুরক্ষার জন্য মানব-মানবীর বৈধ দাম্পত্য জীবনের ফসল হচ্ছে মানব শিশু। এ শিশুরাই মানব প্রজন্মের ভবিষ্যৎ এবং পিতামাতা ও উম্মাহ’র সমৃদ্ধ জীবনের আশার আলো। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘ধন-সম্পদ ও শিশু-সন্তান পার্থিব জীবনের শোভা।’
এই মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্ব থেকেই যেসব অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে আসে ইসলাম শিশুর সেসব অধিকার সুরক্ষায় নিশ্চয়তা প্রদান করে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে তথা ইসলামী জীবন-দর্শনে শিশুর জন্মের পবিত্রতা, নিরাপত্তা, প্রতিপালন, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ এবং আদর্শ মানবরূপে গড়ে তোলার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। শিশুর অধিকার বিষয়ে আলোকপাত করার পূর্বে শিশুর পরিচয় তথা শিশু কাকে বলে বা কত বছর বয়স পর্যন্ত মানব সন্তানকে শিশু বলা হবে সে সম্পর্কে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। শিশু শব্দের আভিধানিক অর্থ- মানুষের শাবক। বিভিন্ন অভিধানে শিশু বলতে বোঝানো হয়েছে অনূর্ধ্ব আট কিংবা ষোল বছরের বালক, পরবর্তীকালে সমবয়সী বালক-বালিকাসহ অনূর্ধ্ব ১৬ বছরের মনুষ্য সন্তানকে।
শিশুর সামগ্রিক সংজ্ঞা নির্ণয়ে ও নিরূপণে জাতীয় নীতি, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ এবং জাতিসংঘ প্রদত্ত সংজ্ঞায় পার্থক্য দেখা যায়। জাতিসংঘ সনদের ধারা-১ এ ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককেই শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তাই শিশু সম্পর্কিত সকল আইন, নীতি ও অনুশীলন এ বয়সের মানব সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তাই ১৮ বছরের নিচে শিশু; যদি না দেশের আইন আরো কম বয়সের ব্যক্তিকে সাবালক হিসেবে অনুমোদন করে।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় পারিবারিক জীবনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দান করা হয়ে থাকে। কেননা সমাজ-ব্যবস্থার মুখ্য উপাদান পরিবার। পরিবার গঠিত হয় স্বামী-স্ত্রী, মাতা-পিতা ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে। পবিত্র প্রশান্তিময় দাম্পত্য জীবনের উষ্ণ আবেদন ঘন সান্নিধ্যের ফলশ্রুতি হলো শিশু-সন্তান। তাঁর দয়ার, কল্যাণে, স্নেহ-মমতার ফলেই গড়ে উঠেছে এ মায়াময় বিশ্ব-সংসার। দাম্পত্য জীবনে কেবল যৌন জীবনের পরম শান্তি, পারস্পরিক অকৃত্রিম নির্ভরতা ও পরিতৃপ্তিই চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। বরং মানব বংশ রক্ষাকারী সদ্যজাত শিশু-সন্তানদের আশ্রয়দান, তাদের সুষ্ঠু প্রতিপালন, সুরক্ষা এর পরম ও বৃহত্তম লক্ষ্যের অন্যতম। শিশু হচ্ছে সুসংবাদ ও সৌভাগ্যের পরম প্রাপ্তি। পবিত্র কুরআনে হযরত যাকারিয়া আ. ও তাঁর বৃদ্ধ বয়সের সন্তান ইয়াহইয়া আ.-এর প্রসঙ্গ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ওহে যাকারিয়া! আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি এক পুত্র সন্তানের; যার নাম হবে ইয়াহইয়া। ইতঃপূর্বে আর কাউকেই এ নামধারী করিনি।’
ইসলাম যে শিশু-সন্তানের প্রতি কত বেশি গুরুত্বারোপ করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় আল্লাহ তাআলার শিশুর নামে শপথের মধ্যে। আল্লাহ নিজেই শিশুর নামে শপথ করেছেন এভাবে- ‘না, আমি এ নগরীর নামে শপথ করে বলেছি, যখন তুমি এ নগরীতে অবস্থান করছো। আর শপথ করছি জন্মদাতার নামে এবং তার ঔরসে জন্মপ্রাপ্ত শিশু-সন্তানের নামে।’ শিশুদের অপরিসীম গুরুত্বের কারণে মহানবী স.-এর হৃদয় জুড়ে ছিল শিশুদের প্রতি প্রবল ভালবাসা ও স্নেহ-মমতা। তিনি বলেন, ‘তোমরা শিশুদের ভালবাসো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো।’ তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না, সে আমাদের কেউ নয়।’ মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ স. যখন বিজয়ী বেশে মক্কানগরীতে প্রবেশ করেন, তখন উটের উপর তাঁর সাথে ছিল এক শিশু এবং এক কিশোর। শিশুটি ছিলো রাসুলুল্লাহ স.-এর বড় মেয়ে জয়নাব রা.-এর শিশু পুত্র আলী রা. ও কিশোরটি ছিল উসামা রা.। নবী নন্দীনী ফাতিমা রা.-এর শিশু পুত্র হাসান ও হুসাইন রা.-কে রাসুলুল্লাহ স. যে কত গভীরভাবে ভালবাসতেন ইতিহাসে এর বহু ঘটনা উল্লেখিত আছে। রাসুলুল্লাহ স.-এর এ শিশুপ্রীতি কেবল নিজ পরিবারের বা অতি প্রিয় সাহাবীদের শিশুর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সকল শিশুর ব্যাপারেই তাঁর ছিল সমান দরদ। নবী স. শিশুদের কান্না শুনতে পেলে সালাত সংক্ষিপ্ত করে দিতেন এবং বলতেন, ‘আমি সালাত দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছায় দাঁড়াতাম, কিন্তু যখন কোনো শিশুর কান্না শুনতাম তখন সালাত সংক্ষিপ্ত করতাম যাতে মায়ের কষ্ট না হয়।’
হাদীসে আরো আছে, ‘একবার আকরা ইবনে হাবিস রা. রাসুসুল্লাহ স.-এর নিকট এসে দেখতে পেলেন, তিনি তাঁর দুই নাতি ইমাম হাসান ও হুসাইনকে চুমু দিচ্ছেন। তিনি নবী স.-কে বললেন, আপনি আপনার মেয়ের ছেলেদের চুমু দিচ্ছেন? আল্লাহর শপথ! আমার দশ দশটি সন্তান রয়েছে, এদের কাউকেই আমি কোনো দিন চুমু দেইনি। তখন রাসুলুল্লাহ স. তাকে বলেন, আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে রহমত ছিনিয়ে নিয়েছেন, তাতে আমার কি দোষ?’ ইহকালীন জীবনের জন্য যেমন শিশু সন্তানের গুরুত্ব রয়েছে, ঠিক পরকালীন জীবনের জন্যও শিশুদের গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। নিম্নোক্ত কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাঁদের সন্তানরাও ঈমানের পথে তাদের অনুসরণ করেছে, তাঁদের সে সন্তানদের আমরা তাঁদের সঙ্গে জান্নাতে একত্র করব।’
আল্লাহ তাআলা এখানে শিশু সন্তানকে সুসন্তান ও ঈমানের অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘সদা প্রস্তুত জান্নাতে তারা প্রবেশ করবে, আর তাদের পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে যারা পুণ্যবান হবে তারাও।’ এদের জন্য ফিরিশতাদের একটি প্রার্থনা উল্লেখ করে কুরআনে এসেছে, ‘ওহে আমাদের রব! তুমি তাদেরকে সদা প্রস্তুত জান্নাতে প্রবেশ করাও, যার প্রতিশ্রæতি তুমি তাদের দিয়েছ।’ শিশুর সাথে সদাচরণ করতে হবে। আর এটা ঈমানের পূর্ণতার গ্যারান্টি হিসেবে বিবেচিত। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত; রাসুলুল্লাহ স. বলেন- ‘মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ ঈমান সে লোকই লাভ করেছে যার চরিত্র সর্বোত্তম এবং যিনি পরিবারের লোকদের সাথে কোমল আচরণকারী।’
আল্লাহ নিজেই যখন নেককার সন্তানদের জান্নাতী পিতা-মাতার সঙ্গে পরকালে একত্রে বসবাস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তখন সন্তানদের নেককার হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব। উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে শিশু-সন্তানের গুরুত্বের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদের মূলনীতিসমূহে শিশুর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিধৃত হয়েছে। সনদে বলা হয়েছে, ‘শিশু বিষয়ক যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে শিশুর মা-বাবা, দেশের সংসদ, আদালত এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষসমূহ শিশুর সর্বত্তোম স্বার্থ রক্ষার নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে।’ বস্তুত মানব শিশু তথা সকল প্রাণীর বাচ্চা এমনকি উদ্ভিদ জগতের জন্ম ও সৃষ্টি কৌশল আল্লাহর এক সীমাহীন কুদরত। মানবীয় প্রচেষ্টা এখানে অকার্যকর। পৃথিবীতে মানব প্রজন্মের ধারা এবং নারী ও পুরুষের ভারসাম্য রক্ষার্থে আল্লাহ তাআলার কুদরতের অন্যতম সৃষ্টি এ মানব প্রজন্ম তথা মানব শিশু। মানব শিশুর জন্মদান মানুষের ইচ্ছায় হয় না, এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে থাকে।
মানব শিশুর গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে তাদের প্রতি যথার্থ আচরণ ও ব্যবহার করা সকলের দায়িত্ব। আধুনিক ভোগবাদী চিন্তাধারায় মানুষের সুখ-শান্তি ও ভোগের আকাঙ্খায় মানব শিশুর প্রতি নানা রকম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। অনেক দম্পতি স্বাস্থ্যহানি ও ভোগের সুযোগ কমে যাবে মনে করে সন্তান গ্রহণ করতে চায় না। অনেকে তো বিয়ে করতেও রাজি নয়। তারা চায় বিবাহ বন্ধনহীন জীবন। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ও মুসলমানের সুসন্তান কামনাই স্বাভাবিক। একজন ভালো মানুষ অবশ্যই শিশু-সন্তানের উজ্জ্বল সমৃদ্ধ জীবন কামনা করে। কাজেই একজন ভালো মানুষের কাছে মানব শিশুর গুরুত্ব অপরিসীম।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন