প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্ত দুনিয়ার কোনো না কোনো স্থানে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব। এগুলো লিখে বা বলে শেষ করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তাই সেদিকে মনোনিবেশ না করাই সমীচীন। তবে অজস্র-অসংখ্য ঘটনার মধ্যে গত ৩১ ডিসেম্বর ইনকিলাবের আন্তর্জাতিক পাতার ৭-৮ম কলামে প্রকাশিত দুইটি খবরে সকলেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। শেষের খবরের শিরোনামটি হচ্ছে: শিখদের জন্য খুলে দেয়া হলো মসজিদ। আরো চমৎকৃত শিরোনাম একই কলামে: ১৩ হাজার বছর জেল, কী অপরাধে। দুটি খবরের ওপর আমাদের আলোচনা হবে ভিন্ন ভিন্ন। প্রথমে মসজিদ খুলে দেয়া নিয়ে।
বিশ্বের নানা স্থানে শহরে নগরে নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ, ইসলামদ্রোহীদের নানা স্থানে মসজিদে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া এবং মুসলমানদের মসজিদে প্রবেশে বাধা দান নামাজ আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং আজান নিষিদ্ধ বা তাতে বাধা সৃষ্টি ইত্যাদি সংক্রান্ত খবরাখবর প্রচার মাধ্যমগুলোতে অহরহ প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার অবকাশ রয়েছে, তবে শিখদের জন্য মসজিদ খুলে দেয়ার খবরটি ব্যতিক্রমধর্মী, মানবতা বোধের চরম অভিব্যক্তি বলে মনে হলেও এ সম্পর্কে বলার কথাও আছে।
প্রথমে প্রকাশিত খবরটির প্রতি একটু নজর দেয়া যাক। এনডিটিভি এর খবরে বলা হয়েছে:
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে ঐতিহাসিক লাল মসজিদ শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য খুলে দিয়েছে মুসল্লিরা। ভিন্ন ধর্মের মানুষদের তিন বেলা খাওয়ার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মসজিদটি। ভারতের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, পাঞ্জাবের ফতেহ গড় সাহিবে শিখদের শহীদী জোড় মেলায় উপস্থিত দর্শনার্থীদের খাবার স্থান সংকুলান করতে লাল মসজিদ খুলে দেয়া হয়।
শহীদ শব্দটি ইসলামের নিজস্ব, মুসলমানদের ক্ষেত্রেই তার ব্যবহার নির্ধারিত। শহীদ মুসলমানদের মধ্যেই হয়ে থাকে, কোরআন ও হাদীসে যাদের বিশেষ মর্যাদা-সম্মান সুপ্রতিষ্ঠিত। কোনো অমুসলিম সে মর্যাদা-সম্মানের অধিকারী হতে পারে না, এমনকি মুসলমানদেরকেও গড়ে শহীদ বলা যাবে না।
উল্লেখিত খবরে শহীদী জোড় মেলায় শিখদের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। এ শহীদী জোড় মেলা কী তা বলা হয়নি। এ মেলায় কী হয় তাও বলা হয়নি। ইসলামের সাথে শিখদের এ মেলার কী সম্পর্ক যাতে যোগদানের সুবিধার জন্য মসজিদে শিখ তীর্থযাত্রীদের স্থান করে দিতে হবে? এটি কোন ইসলামী উদারতা?
খবরে আরো বলা হয়, তিনদিন মসজিদটির একাংশ ব্যবহার করতে পারবে শিখরা। এ বিষয়ে চরন জিত সিং নামে একজন শিখ ধর্মাবলম্বী বলেন, মুসলিমরা স্বেচ্ছায় আমাদের এই অনুমতি দিয়েছে। তিনদিন হলো আমরা এখানে লঙ্গরখানা খুলেছি। দুই গ্রামের মানুষ এখানে খাচ্ছে। গ্রামের বাসিন্দারা পালা করে খাবার পরিবেশন করছে। মসজিদে শিখদের লঙ্গরখানার পরিণত করার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। আরো মজার বিষয় হচ্ছে: লাল মসজিদের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সৈয়দ মুহাম্মদ সাদিক রাজা বলেন, শিখদের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমরা গর্বিত। এখানে বাসিন্দারা মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে। অতীতে রাজনীতিবিদরা আমাদের মধ্যে ফাটল ধরিয়েছে।
শিখপ্রেমিক এ মানব দরদী মসজিদ পরিচালক আল্লাহর প্রশস্ত জমিকে এতই সংকীর্ণ দেখলেন যে, শিখমেলার যাত্রীদের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, তাদের লঙ্গরখানা বানিয়ে দেয়ার জন্য আর কোথাও স্থান পেলেন না, লাল মসজিদ আল্লাহর ঘরের তালা খুলে দিলেন। এরূপ মানবপ্রেমিক মসজিদ পরিচালক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হলে তাতে বিস্মিত হবার কিছু থাকবে না। বিষয়টি সম্পর্কে ভারতীয় উলামা মুফতিয়ানে কিরাম কী বলেন তা জানতে ইচ্ছে হয়। মসজিদের যেসব পরিচালক কর্তৃপক্ষ মসজিদের মর্যাদা, সম্মান এভাবে ভূলুন্ঠিত করে মুসলিম সমাজ তাদেরকে কীভাবে গ্রহণ করবে? মানবতার নামে এরূপ স্বেচ্ছাচারিতা কীভাবে মসজিদ পরিচালনা কমিটির পক্ষে সম্ভব তা ভাবাই যায় না।
২
দুনিয়াতে প্রথম মানব বাবা আদম থেকে এখন পর্যন্ত দশ বারো হাজার বছরের বেশি হওয়ার কথা নয়। মানুষের অপরাধকর্ম জন্মের পূর্বে সংঘটিত হতে পারে না, সুতরাং অপরাধের শাস্তি তার পরের বিষয়। একজন অপরাধীর শাস্তি যদি তেরো হাজার বছর হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে, পরবর্তী তেরো হাজার বছর শেষ হতে আরো কতকাল অপেক্ষা করতে হবে। এমন অপরাধীর তেরো হাজার বছর সাজা ভোগ করার রেকর্ড বিশ্ব ইতিহাসে এই প্রথম কিনা তা বলা কঠিন হলেও এক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের একটি আদালতের নাম গ্রীনিচ বুকে অবশ্যই স্থান লাভ করার যোগ্য। এটি বিগত বছরের ইতিহাসের সেরা একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা হিসেবে গণ্য হবে। ‘১৩ হাজার বছর জেল, কী অপরাধ’ শীর্ষক প্রকাশিত খবরটিকে একটি স্বাপ্নিক গল্প, কাহিনী হিসেবে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। কেননা খবরটি আন্তর্জাতিক শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম বিবিসির সূত্রে প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি নিম্নরূপ:
‘প্রতারণার দায়ে থাইল্যান্ডের এক ব্যক্তিকে ১৩ হাজার ২৭৫ বছর কারা দন্ডাদেশ দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত। প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে ঠকিয়ে পুদিত কিতি থরা দিলক (৩৪) নামের ওই যুবক এক হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিবিসির খবরে বলা হয়, অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে একটি ভূয়া স্কিমে লোকজনকে অর্থ বিনিয়োগ করতে বলেন পুদিত। আদালতে তার অবৈধ দেনাও দুই হাজার ৬৫৩ জনের সঙ্গে প্রতারণার প্রমাণ মিলেছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন- পুদিত নিজেও। ফলে সাজা অর্ধেক কমিয়ে ছয় হাজার ৬৩৭ বছর ছয় মাসে কমিয়ে এনেছেন আদালত। প্রতারণা ও প্রতারিতের সংখ্যা যত অধিক হোকনা কেন, এ ঘনঘন প্রতারণার একই অপরাধ। ঐ দেশের বিচার ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রতারণার সাজা জেল জীবনের মেয়াদ বাড়তে থাকে। এ ঘটনায় অপরাধীর শাস্তি সংশোধন ও মানুষের শিক্ষা লাভের জন্য অপরাধের ধরন করণ অনুযায়ী শাস্তির বিধান করা হয়। ’
থাইল্যান্ডের উল্লেখিত আদালতের রায় নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই, কিন্তু এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী সাজার যৌক্তিকতা সম্পর্কে যে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে তা অবশ্যই আলোচনার বিষয় হতে পারে, তা যে কোনো দেশেই হোকনা কেন। মানুষ অপরাধ করলে এবং তা প্রমাণিত হলে প্রত্যেক দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধীকে সাজা ভোগ করতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক আইনও রয়েছে। ইসলামী দন্ডবিধির কথা বাদ দিলেও বলা যায়, নানা দেশে দন্ডবিধি নানা রকমের সে ব্যাপারেও আমাদের বলার কিছু নেই, তবে আমাদের বলার বিষয় হচ্ছে, দন্ডবিধির প্রয়োগ হয়ে থাকে জীবিত অপরাধীর ক্ষেত্রে। অপরাধের ঘৃণ্যতা অনুযায়ী তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে অপরাধী দুনিয়ার শাস্তি থেকে মুক্ত হয়ে যায়, সাধারণতঃ এরূপ মনে করা হয়ে থাকে। পরকালীন শাস্তির বিষয়টি ভিন্নরূপ, তাতে মানুষের কোনো হাত নেই।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, মৃত ব্যক্তির লাশের উপর অত্যাচার চালানো কিংবা কবর হতে লাশ উত্তোলন করে লাশের অবমাননা করা দুনিয়ার প্রচলিত দন্ডবিধির আওতাভুক্ত বলে কেউ বলবে না। এরূপ দৃষ্টান্ত যুগে যুগে দেশে দেশে ছিল এবং কবরের পৃষ্টদেশে লাঠিপেটা করার দৃষ্টান্তের অভাব নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের ছোট বেলায়, এদেশে কাবুলিওয়ালাদের দৌরাত্ম্য দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে। ওরা গ্রামীণ এলাকাগুলোতে গিয়ে দরিদ্র লোকদেরকে সুদে ঋণ প্রদান করতো এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সুদে-আসলে উসূল করতো, আসলের জন্য পীড়াপিড়ি না করলেও সুদের অর্থ অবশ্যই শোধ করতে হতো। এব্যাপারে ওরা বলতো, হামকু আসল নাই সুদ চাহিয়ে। আর যারা কাবুলিওয়ালাদের ঋণের সুদ পরিশোধ না করেই মৃত্যুবরণ করতো, শুনেছি ওরা এসে ঋণগ্রহীতা মৃত ব্যক্তির কবরের সন্ধান করতো এবং কবরের ওপর ওদের হাতে ধারণ করা দীর্ঘ লাঠির আঘাত করে প্রস্থান করতো। মৃত ব্যক্তির এরূপ কল্পিত শাস্তি মূলতঃ আক্রোশ, ক্ষোভ, ঘৃণা বা প্রতিশোধের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। এর সাথে দন্ডবিধির কোনো সম্পর্ক নেই।
মুসলমানসহ যেসব জাতিকে কবরে দাফন করার প্রথা প্রচলিত, নানা কারণে তাদের লাশ উত্তোলন করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয় অথবা লাশের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালানো হয়ে থাকে। এরূপ কার্যকলাপ দন্ডবিধি বা অপরাধ কর্মের দুনিয়াবী সাজা নয়, নিছক প্রতিশোধ বা ক্ষোভ ঘৃণা স্বরূপ এবং মৃতদেহের প্রতি অবমাননাকর আচরণ মাত্র। এতে মৃত ব্যক্তির বিদেহী আত্মার ওপর ক্ষোভের কোনো প্রভাব বিস্তার করে কি না জীবিতদের তা অবগত হবার ক্ষমতা নেই।
আমরা অপরাধীকে দীর্ঘমেয়াদী সাজা প্রদানের কথাই বলছিলাম। আগেকার যুগে মানুষ সহস্রাধিক বছর পর্যন্ত জীবিত থাকতো। কিন্তু বর্তমান যুগে সে তুলনায় মানুষের আয়ূ অতি নগণ্য, বড়জোরে দেড়শ’ বছর বাঁচে।
এমতাবস্থায় কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধীকে যদি শত শত বা হাজার হাজার বছর জেলের সাজা দেয়া হয়, তাহলে অপরাধীর কারাজীবন শত বছরের আগেই পরিসমাপ্ত হতে পারে, তার দুনিয়াবী সাজার মেয়াদও তাতে শেষ হয়ে যায়। তাহলে অবশিষ্ট সাজার মেয়াদ মরণদশায় ভোগ করার যৌক্তিকতা কোথায়? বরং ঐ অসমাপ্ত সাজা প্রহসন ছাড়া আর কী হতে পারে? কঠোর ও চরম শাস্তি মৃত্যুদন্ড এটি কার্যকর হওয়ার পরও অথবা অপরাধী স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করলে এমনিই তার প্রতি আরোপিত দন্ড অকার্যকর হয়ে যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন