শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

ইয়াবায় সর্বনাশ

মো. ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ভয়ংকর মাদক ইয়াবা। এখন বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরের অলিতে-গলিতে সর্বত্র হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। আর এ জিনিসটি অতি সহজে হাতের নাগালে পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের সব পেশাশ্রেণির লোকেরা এর সাথে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ বিক্রি করে, কেউ সেবন করে। আবার অনেকে বিক্রিও করে সাথে সেবনও করে। নারী-পুরুষ সবাই এখন এর সাথে জড়িত হয়ে গেছে। কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরাও বাইরে নেই। এ মাদকের ছোবল আমাদের দেশের যুবসমাজকে একবারেই ধবংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছে। আর এ মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধের মাত্রাও বেড়ে গেছে অনাকাক্সিক্ষতভাবে। গলা কেটে হত্যা, ছিনতাই করতে গিয়ে শিশু খুন, স্ত্রীকে খুন করে পরে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও সা¤প্রতিক সময়ে ঘটেছে। আলোচিত এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে ভয়ংকর মাদক ইয়াবার প্রভাব।
গত এক বছরের অপরাধ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাদকের কারণে দুই শতাধিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। আর এর অর্ধেকেরও বেশি খুনের কারণ ইয়াবাসংশ্লিষ্ট। ইয়াবাসেবী ও কারবারিরাই ব্যাপক মাত্রায় ছিনতাই, হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, চুরি ও ডাকাতিতে জড়িত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দেড় মাসে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া ১০টি হত্যাকান্ডসহ বড় ধরনের সব কটি অপরাধে জড়িতরা ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবাসেবীরা ক্রমেই ব্যাপকভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। সা¤প্রতিক সময়ের সবচেয়ে মর্মান্তিক অপরাধের ঘটনাটি ঘটে গত ১৮ ডিসেম্বর। রাজধানীর দয়াগঞ্জে এক নারীর ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। হ্যাঁচকা টানে ওই নারীর কোল থেকে পড়ে ছয় মাস বয়সের শিশু প্রাণ হারায়। গত ১৫ ডিসেম্বর মহাখালীর আরজতপাড়ায় ৩৮/এ নম্বর বাড়িতে ৮০ বছরের অসুস্থ অনিল গোমেজের সামনে তাঁর স্ত্রী মিলড্রেড গোমেজ মিলুকে গলা কেটে খুন করা হয়। এ ঘটনায় ১৮ ডিসেম্বর পুলিশ জামির, পারভেজ ও নাঈম নামের তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, মহাখালী বস্তি এলাকার ওরা তিনজনই ইয়াবায় আসক্ত। মাদকের টাকার জন্যই ওরা অনিল গোমেজের বাসায় যায়। তারা রাতভর বাড়ির ছাদে বসে ইয়াবা সেবন করে। সকালে বাসায় ঢুকে মিলুকে হত্যার পর লুট করে পালিয়ে যায়। গত ৮ অক্টোবর ওয়ারীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র খন্দকার আবু তালহা। গত ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর শুক্রাবাদে নির্মাণাধীন ভবন থেকে নৌ প্রকৌশলী রফিকুল হাসান রিমনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই খুনের তদন্তেও ইয়াবা কারবারিদের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন মতে, ইয়াবায় আসক্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্রে ২০১৬ সালে যারা চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের ৩১.৬১ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবায় আসক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। ইয়াবায় আসক্তরা হেরোইনে আসক্তদের মতোই বিপজ্জনক। ২০-২৫ বছরের তরুণরাই এই নেশার জগতে দ্রæত ঢুকে পড়ছে। নেশাসক্ত এসব তরুণ-তরুণী পরিবারের জন্যও অশান্তির বড় কারণ হয়ে উঠেছে। অনেকে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে।
সব ধরনের মাদকাসক্ত স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আলাদা স্বভাবের হয়ে থাকে। সেই আলাদা স্বভাবের একটি হলো অপরাধপ্রবণতা। এ কারণে মাদককে বলা হয়, অপরাধের মা (মাদার অব ক্রাইম)। তবে ইয়াবার উপাদান এমফিটামিন ভয়ংকর ক্ষতি করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু থাকে না। হ্যালুসিনেশন হয়। ‘প্যারানয়েড ডিল্যুশন’ বা সন্দেহপ্রবণতা দেখা দেয়। ইয়াবাকে বলা হয়, ‘মাইন্ড অলটারিং ড্রাগস’। এই মাদক সেবনে সাময়িক উদ্দীপনা বাড়ে, ঘুম কমে যায়, বিরক্তি বাড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার প্রবণতা বাড়ে। ফলে হত্যা-নির্যাতনের মতো নৃশংস কাজ করে ইয়াবাসেবীরা।
ইয়াবায় আসক্তদের কারণে গত ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট মালিবাগের চামেলীবাগে এক ফ্ল্যাটে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তাঁদের মেয়ে ঐশী রহমান। ১৮ বছরের ওই তরুণী ইয়াবায় আসক্ত ছিল। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর ফকিরাপুলে পানির ট্যাংকির পাশ থেকে সুমি নামে এক তরুণীর আট টুকরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তদন্তে জানা যায়, এই হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল ইয়াবাসেবীরা। ২১ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গৃহবধূ সাজেদা আক্তার মীমকে হত্যা করে তার ইয়াবায় আসক্ত স্বামী শামিউল ইসলাম। ১৫ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী পশ্চিম মাতুয়াইলে মাদকাসক্ত বাবা সুমন তার শিশুসন্তান শাহীনকে (৭) দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। গত ৬ অক্টোবর সোমা আক্তারকে গলা কেটে হত্যার পর তার স্বামী মনির আত্মহত্যার চেষ্টা করে। গত ৩০ জুলাই রামপুরায় সাহানা নামের এক গৃহবধূকে হত্যা করে ইয়াবায় আসক্ত স্বামী। গত ২৯ জুলাই রাজধানীর শাহজাদপুরে আত্মহত্যা করেন মডেল অভিনেত্রী রিসিলা বিনতে ওয়াজ। গত ৮ অক্টোবর কদমতলীর মুজাহিদনগরে ইমরান হোসেন ও বনানীতে মোকারাম আদিল নামের মাদকাসক্ত দুই তরুণ আত্মহত্যা করে। গত বছরের ২৯ অক্টোবর জুরাইনে বৃদ্ধ মোহর আলীকে গলা কেটে হত্যা করে তাঁর ইয়াবায় আসক্ত ছেলে সুমন।
মাদকের সঙ্গে অপরাধের বড় সম্পর্ক রয়েছে। আর প্রচলিত মাদকই অপরাধের বড় কারণ। একেক সময় একেক ধরনের মাদক আসে। এখন ইয়াবার প্রাদুর্ভাব। ফলে ইয়াবার সরবরাহ কমানো বা বন্ধ করা জরুরি। এতে অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে। ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ। এই মাদকের কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। অনেক টাকার অপচয় হচ্ছে। আমরা মনে করি, ইয়াবা কেন্দ্রিক অপরাধ প্রতিরোধে বড় কাজ হলো সরবরাহ বন্ধ করা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন