সৈয়দ নাজমুল আহসান
বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, থাকবে। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে। তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়ে উঠছিল বিস্ফোরণোন্মুখ। মেজর জিয়া নজর রাখছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা আর সৈনিকদের ওপর। জিয়ার ওপরও পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা নজরদারি চালাচ্ছিল।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ চট্টগ্রামে বিহারিরা হামলা করে বাঙালিদের এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে। এরপর থেকেই চট্টগ্রামে ব্যাপক গোলযোগের সূচনা হয়। বাঙালি হত্যা ও বাঙালিদের দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন শমসের মবিন চৌধুরী এবং মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী জিয়াকে জানান, জিয়া যদি অস্ত্র তুলে নেন তাহলে তারাও দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। তাদের কথা শুনে জিয়া উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন।
৪ মার্চ, ১৯৭১ সাল। মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন অলি আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে ধরে নেন। পরে তারা নিয়মিত মিলিত হয়ে নিজেদের প্রস্তুতি চালিয়ে যান। এ লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণও করতে থাকেন। এভাবেই আসে ৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল। এ দিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণাকে গ্রিন সিগন্যাল ধরে নিয়ে জিয়া এবং তার সমমনারা সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৩ মার্চ ইয়াহিয়ার আলোচনা ব্যর্থ হলে জিয়া এবং সমমনারা নিজেদের প্রস্তুতিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান।
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চে স্টেডিয়ামে লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী, মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি, মেজর আমিন চৌধুরী গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীকে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করা হয়। দুই দিন পর এম আর চৌধুরী ইপিআরকে সঙ্গে নেয়ার প্রস্তাব দেন। জিয়া এবং সমমনারা ইপিআর বাহিনীকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। ২১ মার্চ তারিখে জেনারেল হামিদ খান আসেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। চট্টগ্রামে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নই তার এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল। ২৪ মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকা চলে আসেন।
২৫ ও ২৬ মার্চে মধ্যবর্তী কালো রাতের ১টার সময় মেজর জিয়ার কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়া জিয়াকে নির্দেশ দেন নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপোর্ট করতে। জিয়ার পক্ষে তা মানা সম্ভব ছিল না। কারণ পরিস্থিতি দেখে জিয়ার মনে হচ্ছিল হয়তোবা জেনারেল আনসারী তাকে চিরকালের শেষ স্বাগত জানানোর জন্য চট্টগ্রামের বন্দরে প্রতীক্ষায় আছেন। তবু ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে জিয়া বন্দরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। জিয়ার বাহিনী বন্দরের পথে বের হয়। আগ্রাবাদে তাদের থামতে হয়। পথে ছিল ব্যারিকেড। এই সময়ে সেখানে আসেন মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী। চৌধুরীর সঙ্গে জিয়ার কানে কানে কথা হয়। সেখানে ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে বার্তা এসেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালিকে তারা হত্যা করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের এই ধরনের ঘৃণ্য কর্মকা- জিয়াকে বিদ্রোহী করে তোলে। এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত সময়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জিয়া বলেন, ‘উই রিভোল্ট। আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি (মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী) ষোলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তÍানি অফিসারদের গ্রেফতার কর। অলি আহমদকে বলো ব্যাটালিয়ন তৈরি রাখতে। আমি আসছি।’
ধীরস্থির চিত্তের অভিজ্ঞ সমরনায়ক জিয়া কথা শেষে নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে যান। পাকিস্তানি অফিসার, নৌবাহিনীর চিফ পোস্ট অফিসার ও ড্রাইভারকে জিয়া কিছুই বুঝতে না দিয়ে জানান, তাদের আর বন্দরে যাওয়ার দরকার নেই।
এতে তাদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে জিয়া তার পাঞ্জাবি ড্রাইভারকে ট্রাক ঘুরাতে বলেন। ভাগ্য ভালো, সে জিয়ার আদেশ মানে। ট্রাক ঘুরিয়ে তারা আবার চলতে থাকে। ষোলশহর বাজারে পেঁৗঁছেই জিয়া গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে একটা রাইফেল তুলে নেন। পাকিস্তানি অফিসারটির দিকে তাক করে হাত তুলতে বললে তিনি জিয়ার কথা মানেন এবং অস্ত্র ফেলে দেন। জিয়া কমান্ডিং অফিসারের জিপ নিয়ে তার বাসায় যান। বাসার বেল টিপতেই কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরেই বেরিয়ে আসেন। ক্ষিপ্র গতিতে জিয়া তার ঘরে ঢুকে পড়েন এবং গলাশুদ্ধ তার কলার টেনে ধরেন। দ্রুতগতিতে আবার দরজা খুলে জিয়া কমান্ডিং অফিসারকে বাইরে টেনে আনেন। বলেন, ‘বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে? এই আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। এখন লক্ষ্মী সোনার মতো আমার সঙ্গে এসো।’ চালাক কমান্ডিং অফিসার (জানজুয়া) বিদ্রোহী জিয়ার কথা মানতে বাধ্য হন। জিয়া জানজুয়াকে ব্যাটালিয়নে নিয়ে আসেন।
অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে জিয়া মেজর শওকতকে ডাকেন এবং তাকে জানান যে, তারা বিদ্রোহ করেছেন। শওকত এবং জিয়া হাতে হাত মিলান। জিয়া ব্যাটালিয়নে ফিরে দেখেন জিয়ার পূর্বের নির্দেশ মেনে ইতোমধ্যেই সব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারকে বন্দী করে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। জিয়া অফিসে গিয়ে চেষ্টা করেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী আর মেজর রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু পারেন না। সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারপর রিং করেন বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ জানান ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, কমিশনার, ডিআইজি, আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা যুদ্ধ করবে। টেলিফোন অপারেটর জিয়ার অনুরোধ রক্ষা করেন। সময় ছিল অতি মূল্যবান। জিয়া ব্যাটালিয়নের অফিসার জেসিও আর জওয়ানদের ডাকেন। তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তারা সবই জানত। জিয়া সংক্ষেপে সব বলেন এবং তাদের নির্দেশ দেন সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। তারা সর্বসম্মতিক্রমে হৃষ্টচিত্তে জিয়ার আদেশ মেনে নেন। জিয়া তাদের একটা সামরিক পরিকল্পনা দেন তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। এভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসে লেখা হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১, রক্ত আকরে লেখা একটি দিন।
এরপর ১৯৭১ এর ২৭ মার্চ। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালিদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালাচ্ছিল। স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালিরা খুঁজে পাচ্ছিল না নেতাদের। অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল মুক্তির সংগ্রামে। হাতাশা নেমে আসছিল তাদের মনে। বাঙালিদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বন্দী পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে গেছেন আত্মগোপনে। দিশাহারা নিরস্ত্র বাঙালি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল।
এমন দুঃসময় ভাবিয়ে তোলে জিয়াকে। জিয়া মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে দ্রুত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালিদের সশস্ত্র হওয়ার সাহস জোগান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বীরত্বব্যঞ্জক কণ্ঠে মেজর জিয়াউর রহমান ‘‘আমি মেজর জিয়া বলছি” বলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
জিয়ার সেই ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ
This is Shadin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, on behalf of Bangobondhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People’s Republic of Bangladesh has been established. I have taken command as the temoporary Head of the Republic. I call upon all Bangalis to rise against the attack by the west Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours.
জিয়ার এই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান নিরস্ত্র বাঙালিদের মনে সাহস সঞ্চার করে। তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আরো বেশি বিদ্রোহী করে তোলে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ঝড় ওঠে। ‘আমি মেজর জিয়া’ বলছি কথাটি তখন যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রেরণার অন্যতম উৎস।
স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর জিয়ার এই অনন্য অবদান ইতিহাস স্বীকৃত। এটা তো সহজ কথা যে, মেজর জিয়ার মতো ধীরস্থির আর যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী একজন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে জীবন বাজি রেখেই স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালিদের সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ করতে ঝুঁকি নিয়েই সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা সেদিন যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের যে বারবার অনুপ্রাণিত করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণেও। প্রধানমন্ত্রী তার প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘আপনারা এই ঘোষণা প্রথম শুনতে পান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার কণ্ঠে’’।
জিয়ার এই স্বাধীনতা ঘোষণাকে পরবর্তীতে মূল্যায়ন করে ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডি এক ভোজসভায় বলেছিলেন, ‘Your position is already assurecd in the annals of the history of your country as a brave freedomfighter, who was the first to declare the independence of Bangladesh.
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন