বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

কিংবদন্তি বিচারপতি মাহবুব মোরশেদ

ড. আশরাফ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বিশিষ্ট আইন বিশারদ, মুক্ত বুদ্ধি চিন্তার নায়ক, আরবি, ফার্সি ও ইংরেজি ভাষায় অনন্য মেধার অধিকারী সর্বোপরি একজন হৃদয়বান বাঙালি ধীরস্থির সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ আবদুস সালিক ব্রিটিশ যুগের একজন বিসিএস ছিলেন এবং অন্যান্য জেলা ছাড়াও একদা বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন। তার মহিয়সী মা ছিলেন ইসলামী শিক্ষা ও ধর্মের পাবন্দ সৈয়দা আফজালুন্নেছা বংশসূত্রে ছিলেন মরহুম শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের আপন ছোট বোন। বিচারপতি মোরশেদ ১৯২৬ সালে রাজশাহী বিভাগের সকল পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়ে প্রথম বিভাগে বিভাগীয় বৃত্তিসহ প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ হন এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে ১৯৩০ সালে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রথম বিভাগে এমএ ও আইন পাস করে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত গমন করেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ম্যাগাজিনের প্রথম মুসলমান সম্পাদক ছিলেন এবং পরে কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ছিলেন অন্যতম সংগঠক। এছাড়াও তিনি সে যুগের বিখ্যাত গার্ডিয়ান এবং স্টেটসম্যান পত্রিকায় স্বাধীন চিন্তার প্রবন্ধ লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে তিনি শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৪ সালে অনন্য বিচার বিভাগীয় প্রজ্ঞা এবং সততার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধান বিচারপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।
আতাউর রহমান খান তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বারবার শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন বিচারের মধ্যে বিচারের ভাষার মধ্যেও যে একটা আর্ট আছে, ‘গণতন্ত্রই মানুষের সর্বোচ্চ অধিকার’ এ কথা মনে রেখেই তিনি সর্বদা তার ঐতিহাসিক বিচার বিভাগীয় রায় দিয়েছেন। কারো নির্দেশ বা ইশারায় তিনি পেছন ফিরে তাকাননি। তার বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা, বক্তব্য তিনি বিচারকের তুলাদন্ডের সঙ্গে সুমধুর করতেন হাফিজ, জামী, নিজামী, রুমী ও রবীন্দ্র-নজরুলের, কখনো দেশবন্ধু বিত্তরঞ্জন, শেরেবাংলা, হেকিম আজমল খান, আলী ভ্রাতৃদ্বয় তথা বিখ্যাত মনীষীদের অমর বাণী মুহুর্মুহু উদ্ধৃত করে। মওলানা মোহাম্মদ আলীর বিখ্যাত উক্তি : ‘তোমরা যদি আমাদের স্বাধীনতা না দাত্ত তবে এই বিলেতের মাটিতেই কবর দিতে হবে পরাধীন দেশে আর ফিরে যাব না।’- এটি ছিল তার অতি প্রিয়তম উদ্ধৃতি।
বিচারপতি মোস্তফা কামালের ভাষায় : তিনি আইনকে ইতিহাসের মাপকাঠিতে দর্শনের তুলনামূলক বিচারে ওজন করে দিতে পারতেন। আইন তার কাছে নিছক কতকগুলো বিধিব্যবস্থা ছিল না, আইনের সাথে যে ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, দর্শন ও কার্যকারিতা সক্রিয় তিনি তার মূলে সহজে ও অবাধে বিচরণ করতে পারতেন। সামগ্রিকভাবে এই উপমহাদেশে শাসনতান্ত্রিক আইনের এমন নিপুণ কলাকার দুর্লভ।
একজন বিচারপতি সম্বন্ধে আরেকজন বিচারপতির এই সমীক্ষা নির্ভুল। বিভিন্ন সভা-সমিতি ও সেমিনারে বিচারপতি মোরশেদের এই ভাষাই আমার শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি যখন যে বিষয়েই বক্তৃতা করতেন মনে হয়েছে এই বিষয়ের তিনিই যেন সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা ও বিচারক। এর কারণ সম্ভবত ছিল সাহিত্য নয়- শুধু জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই নিজস্ব দর্শনের আলোকে বিষয়টিকে মৌলিকভাবে নিজের মতো করে দেখার মধ্যে। তার আর একটি অতি প্রিয় উদ্ধৃতি ছিল শেকসপীয়র থেকে নেয়া : ‘সিংহের মতো শক্তি থাকা ভালো কিন্তু সেই শক্তি দুর্বলের ওপর পতিত হলে তা তো হয় অত্যাচার।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন