বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ভারত পরিচিত হলেও আরেকটি ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে দেশটির। সেটি জাতপাতের দেশ হিসাবে। এটি মূলত সামাজিক বিভাজনজনিত কারণে হলেও সরকারীভাবে এর স্বীকৃতি থাকায় সিডিউল কাস্ট (এস সি) ও অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণীর (ও বি সি) অন্তর্ভুক্ত লোকেরা ন্যূনতম অধিকার লাভ করে থাকেন। কিন্তু ভারতের মুসলমানরা দেশের অন্যান্য পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ের চেয়েও অনেক পিছিয়ে রয়েছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায়। ১৯৪৭ সালে প্রধানত হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় ভিত্তিতে এককালের বৃটিশ-শাসিত অবিভক্ত ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার পর থেকেই ভারতীয় মুসলমানদের এ দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা শুরু হয়েছে।
স্বাধীন ভারতের কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে (পাটিশন) কখনও মনে প্রাণে সমর্থন করতে না পারলেও ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তাদের প্রত্যাশার বিপরীতে মুসলিম লীগের জয় হওয়ায় ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে বাধ্য হন। এর ফলে মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের আংশিক বাস্তবায়ন হিসাবে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল মিলে পাকিস্তান নামের একটি নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করেন।
একটি বৈরী রাষ্ট্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন প্রায় দেড় হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি স্বতন্ত্র ভুখÐ মিলে একটি রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় নেই বললেই চলে। তদুপরি তদানীন্তন পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের বাসস্থান তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান হওয়া সত্তে¡ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রাজধানী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান দপ্তর প্রভৃতি সকল গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় প্রায় শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে একটা বঞ্চনা বোধ কাজ করতে থাকে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।
প্রথমে সমস্যা দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। আগেই বলা হয়েছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের অধিবাস ছিল পূর্বাঞ্চলে এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অথচ উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দু ভাষীদের অধিক্যের সুবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীদের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে গোপনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা চালানো শুরু হয়ে যায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্টভাষা প্রশ্নে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই নতুন রাষ্ট্রের পোষ্ট কার্ড, এনভেলপ, মানিঅর্ডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজীর পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার থেকে। এই পটভূমিতেই ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায় ১৯৪৭ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস নামের সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে।
এই পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিন জন : তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ। অধ্যাপক আবুল কাসেম তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে আন্দোলনের মূল বক্তব্য তুলে ধরেন এভাবে : (এক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে হবে বাংলা। (দুই) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি : বাংলা ও উর্দু।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার বিরোধিতা করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তিসহ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অন্য দিকে তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাসেম শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিয়েই বসে ছিলেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, বৈঠক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা সভা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে। ১৯৪৭ সালেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে শিল্পী সাহিত্যিক শিক্ষাবিদদের স্বাক্ষরসহ মেমোরেÐাম পেশ করা হয় সরকার সমীপে। ১৯৪৭ সালেই ভাষা আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ অধ্যাপক (পরবর্তীতে ড.) নূরুল হক ভূঁইয়াকে কনভেনর করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছাত্রদের একাংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ নামের একটি ছাত্র সংস্থা গঠন করে। এই সংস্থা জন্মলগ্ন থেকেই তমদ্দুন মজলিসের সূচিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। এর পর তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্র লীগের যুগপৎ সদস্য জনাব শামসুল আলমকে কনভেনর করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সময়ে পাকিস্তান গণপরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষায় বক্ততা দানের দাবী উত্থাপন করলে সে দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহŸান করা হয়।
রেল শ্রমিকরা এ ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করায় ঐ দিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে কোন ট্রেন রওনা হতেই সমর্থ হয়নি। ঢাকার পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। সকাল থেকেই সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে পিকেটিং চলাতে অনেক অফিসার ও কর্মচারী সেদিন সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতেই সক্ষম হননি। তখন সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে পাকা দেয়াল ছিল না। ছিল কাঁটাতারের বেড়া। অনেক পিকেটার কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সচিব ও অন্যদের অফিসে উপস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণের অপরাধে পুলিশ পিকেটারদের উপর লাঠিচার্জ করে। অনেক পিকেটারকে গ্রেপ্তারও করা হয়। পুলিশের এই লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তারীর খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে জনগণ সেক্রেটারিয়েট এলাকায় জড়ো হন বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে। ফলে এক পর্যায়ে সমগ্র সেক্রেটারিয়েট এলাকা বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্র পরিণত হয় এবং সর্বত্র একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
এ অরাজক পরিস্থিতি চলতে থাকে ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ মার্চ পর্যন্ত। এতে তদানীন্তন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ভয় পেয়ে যান। কারণ ১৯ মার্চ কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় সফরে আসার কথা। তিনি এসে যদি ঢাকার অরাজক অবস্থা দেখতে পান, তাহলে নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে তাঁর ধারণা ভাল থাকার কথা নয়। তাই নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ তারিখে নিজে উদ্যোগী হয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে তাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গ্রেপ্তার হওয়া আন্দোলনকারীদের মুক্তি দেয়া হলে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।
এরপর কায়েদে আজম যথা সময়ে ঢাকা সফর করেন এবং রেস কোর্স ময়দানে এক জনসভায় এবং কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে বক্তৃতা দেন। উভয় স্থানে তিনি পাকিস্তানের সংহতির জন্য উর্দুর প্রতি তাঁর সমর্থন পুর্নব্যক্ত করেন। উভয় স্থানে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়। রেসকোর্সের বিরাট জনসমাবেশে কে কোথায় প্রতিবাদ জানায় তা খেয়াল না করলেও সমাবর্তনে তার মুখের সামানে প্রতিবাদ হওয়ায় তিনি অবাক হয়ে যান। কারণ এই তরুণ ছাত্ররাই মাত্র কিছুদিন আগে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরদিন তিনি ছাত্র নেতাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে অটল থাকায় আলোচনায় নিস্ফল প্রমাণিত হয়।
তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে ঐ বছর (১৯৪৮) ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আর কোন প্রকাশ্য বক্তব্য দেননি। বরং মৃত্যু শয্যায় তাঁর চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে দু:খ প্রকাশ তিনি করে এক পর্যায়ে বলেন, আমি জীবনে দুটি বড় ভুল করেছি। একটি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে অন্যের কথায় বিশ্বাস করে। কারণ ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনাকালে তাদের বক্তব্যে যথেষ্ট যুক্তির প্রমাণ পেয়েছি। আমার আরেকটি ভুল ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করা। পাঞ্জাবীদের মধ্যে যে মনোভাব আমি লক্ষ্য করেছি তাতে লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল অধিক বাস্তবতা সম্মত। এসব তথ্য আমরা জানতে পেরেছি বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে।
এসব পুরাতন কথা এখানে উল্লেখ করার কারণ পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবতা স্মরণ করা এবং ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর বাস্তবতার প্রতি পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ভারতের বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে যে দলটি নেতৃত্ব দান করে সেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও হিন্দু প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি লোক দেখানো একটা উদারতাও ক্রিয়াশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে যে দলটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তারা মুসলমানদের বিরোধিতায় কোন রাখ ঢাকের প্রয়োজন অনুভব করে নাই। এদের যে মূল নেতা নরেন্দ্র মোদী তিনি যখন গুজরাটের মুখ্য মন্ত্রী ছিলেন, তখন এক মুসলিম বিরোধী ডাঙ্গায় ২০০০ মুসলমানদেরকে হত্যা করা হয়েছিল। এই দলের এক নেতা সম্প্রতি বলেছেন ভারতের অন্য নাম হিন্দুস্তান, এ দেশে মুসলমানদের বাস করার কোনো অধিকার নেই।
পরিশেষে বলতে হয় ভারতের ১২০ কোটি মানুষের মধ্যে মুসলিমরা হচ্ছে শতকরা ১৪ ভাগের বেশী। কিন্তু তারা রয়েছে দুর্ভাগ্যজনক অবস্থান। কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের তুলনায়ই নয়, সিডিউল কাস্ট (এস সি) ও অন্যান্য পশ্চাৎ পশ্চাৎপদ শ্রেণীর (ও বি সি) মতো সরকারীভাবে স্বীকৃত পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়গুলোর চেয়েও অনেক পিছিয়ে আছে মুসলিমরা। রাষ্ট্রের ছদ্মবেশী সেকুলারিজমের ফলে ধর্মের ভিত্তিতে কোটা সংরক্ষণে সংবিধানে বাধা রয়েছে। কিন্তুু এসসি এসটি ও ওবিসিরা হিন্দু হলেও তাদের ব্যাপারে সাংবিধানিক দোহাই না দেয়া হলেও মুসলমানদেরকে এই সুবিধাটি দিতে অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন