আগামী সপ্তাহের শেষের দিকে রাতের তাপমাত্রা ক্রমাগত নিচে নেমে যেতে পারে। এরফলে ফের শৈত্যপ্রবাহ ও হিমেল হাওয়া বইতে পারে আগামী সপ্তাহে। গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় সর্বশেষ আবহাওয়া পূর্বাভাসে একথা জানা গেছে। একজন বিশেষজ্ঞ জানান, এখন পুরোদমে শীতকাল মাঘ মাস। সুদূর উত্তরের সাইবেরিয়া ও হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চল থেকে হিমশীতল বায়ুমালা বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম ও শ্রীমঙ্গল এলাকা দিয়ে তীব্রবেগে ধেয়ে আসছে। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বাকাশের হিমশীতল জেটবায়ু নিচে স্থলভাগের দিকে নামছে। তাছাড়া বঙ্গোপসাগরে আপাতত কোনো ধরনের চাপ বা অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়নি। এই তিন কারণে বর্তমানে দেশে শীতের দাপট অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে তাপমাপক পারদে শীতের অবস্থানে গত কয়েক দিনে কিছুটা উন্নতি হলেও বাস্তবে উত্তরী হাঁড় কনকনে হাওয়ার কারণে শীতের কষ্ট জনজীবনকে এখনও ভোগাচ্ছে। সেই সাথে মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। শীত ও কুয়াশার ঘোরে মানুষের কর্মঘন্টা বিনষ্ট হচ্ছে। উৎপাদনশীলতা লোপ পাচ্ছে। শীতজনিত বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে বিশেষ করে শিশু-বৃদ্ধরা। শীত ও কুয়াশার কারণে যানবাহন চলাচল বিলম্বিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল রংপুর বিভাগের রাজারহাটে ৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সিলেটে ২৪.৭ ডিগ্রি সে.। দেশের অধিকাংশ জায়গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২০ থেকে ২২ ডিগ্রি সে.। ঢাকায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২২.২ এবং ১০.৬ ডিগ্রি সে.।
আজ (মঙ্গলবার) সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, টাঙ্গাইল ও ফরিদপুর অঞ্চলসহ খুলনা, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু শৈত্য প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী দুই দিনে আবহাওয়ার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এর পরের ৫ দিনের শেষভাগে রাতের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পারে।
বন্ধ ফেরি চলাচল :
শিবচর (মাদারীপুর) সংবাদদাতা জানান, ঘনকুয়াশায় শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে ৯ ঘন্টা ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। ঘন কুয়াশার কারনে গত রোববার রাত সাড়ে ১২ টা থেকে এ নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসময় মাঝ পদ্মায় ৬ টি ফেরিসহ নৌরুটের সকল ফেরি উভয় ঘাটে নোঙ্গর করে রাখা হয়। এসময় প্রচন্ড শীতে যাত্রীরা চরম দূর্ভোগের শিকার হন। কূয়াশার প্রকোপ কমলে সোমবার সকাল সাড়ে ৯ টার দিক ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়। তবে দীর্ঘ সময় ফেরি বন্ধ থাকায় উভয় ঘাটে ৪ শতাধিক যানবাহন আটকে দীর্ঘ লাইনের সৃষ্ঠি হয় । এসময় যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন।
বিআইডবিøউটিসি কাঠালবাড়ি ঘাট ম্যানেজার আঃ সালাম বলেন, ঘনকুয়াশার কারনে দীর্ঘ সময় ফেরি বন্ধ থাকায় ঘাট এলাকায় বেশ কিছু যানবাহন আটকে পড়েছে। আমরা যাত্রীবাহী পরিবহন, এ্যাম্বুলেন্স ও কাঁচামালবাহী ট্রাক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপার করছি।
মানুষের দুর্ভোগ
সরকার রবিউল আলম বিপ্লব, পীরগাছা (রংপুর) থেকে জানান, ‘নদীর হ্যাল (ঠান্ডা) বাতাস ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে হু হু করি ঘরোত ঢুকে। এই হ্যালত বুঝি মুই আর বাঁচপ্যার নম।’ গতকাল সোমবার রংপুরের পীরগাছা উপজেলার চর রহমত এলাকায় শীতে জুবুথুবু বৃদ্ধা আমেনা বেওয়া(৬৫) বলেছেন এ কথা। এসময় ময়লা, ছেঁড়া একটি শাড়ি গায়ে বৃদ্ধা আমেনা বেওয়া শীতে থরথর করে কাঁপছিলেন।
একই গ্রামের সুরমা বেওয়া (৭৫) বলেন, তোমরা হামার গরিব মানুষের দুঃখের কথা পেপারত নেকি দেও, হামরা কত কষ্টে আছি। যাতে হামরা এই হ্যাল কাটপ্যার জন্য একটা কম্বল পাই। চর ছাওলা গ্রামের কাদের আলী (৫৮) বলেন, এবার যে শীত শুরু হইছে তাতে গরিব মানুষ গরম কাপড়ের অভাবে খুব কষ্ট পাচ্ছে। চর তাম্বুলপুর গ্রামের দিন মজুর মইন উদ্দিন (৫০) বলেন, ভাই’ ১০/১২ দিন থাকি খুব ঠান্ডা পড়ছে। ঠান্ডার কারণে কাম-কাজ চলেনা। এমনিতে হামরা গরিব মানুষ কাম- কাজ না করলে প্যাটোত ভাত যায়না। তার ওপর শীতের ঠান্ডায় গরম কাপড় না থাকায় দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে পরিবারের চার জন মানুষ ছেঁড়া খ্যাতা (কাঁথা) গাওত দিয়া খুব কষ্টে আইত কাটাই। চর তাম্বুলপুরে বাঁধের ধারে আশ্রিত প্রায় দুই শতাধিক পরিবারে শীতের কষ্টের চিত্র আরও করুন চিত্র। এখানকার সবাই দিনমজুর। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় তাদের কাম-কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এমনিতে তাদের ঘরে খাবার নেই। তার ওপর শীতের কামড় যেন, মরার ওপর খড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনমজুর ওসমান গনির স্ত্রী নাহার বেগম(৪৫) বলেন, কয় দিন থাকি যে ঠান্ডা পড়ছে তাতে না খ্যাঁয়া থাকার কষ্ট সহ্য করা যায় কিন্ত এ শীতের কামড় সহ্য করা যায়না। এ অবস্থা শুধু চর ছাওলা, চর তাম্বুলপুর গ্রামের মানুষেরই নয়, এ অবস্থা চর রহমত, চর শিবদেব, চর গাবুড়া, চর রামশিং, চর দৌলত, চর হাগুড়িয়া হাসিম ও চর কাশিয়া বাড়িসহ গোটা উপজেলার লক্ষাধিক দুঃস্থ ও ছিন্নমূল অসহায় মানুষের।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাউজুল কবির বলেন, এবার সরকারি ভাবে এখন পর্যন্ত উপজেলার ৯ টি ইউনিয়নের জন্য ৭ হাজার কম্বল বরাদ্দ পাওয়া যায়। যা দুঃস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
মোঃ লিহাজ উদ্দীন মানিক, বোদা (পঞ্চগড়) থেকে জানান, পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলাসহ আশ-পাশ এলাকার হাড় কাঁপানো শীত আর ঘন কুয়াশার ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন কৃষি শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষগুলো। ঠান্ডার কারণে খেটে খাওয়া মানুষ কাজ করতে পারছেন না। হাতের আঙ্গুল অবশ হয়ে থাকছে। ঘন কুয়াশার কারণে স্বাভাবিক যান চলাচলেও বিঘœ ঘটছে গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত পশু স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। গত ২ সপ্তাহের টানা শৈত্যপ্রবাহে জবুথুবু হয়ে পড়েছে স্থানীয় মানুষজন। গরীর মানুষেরা শীত নিবারণের জন্য কম্বল পেতে সরকারি, বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভীড় করছেন। সরকারি, বে-সরকারি ভাবে যে শীতবন্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানা গেছে। শাক সবজির দাম দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে আলু ২৫ টাকা, বেগুন ৩০ টাকা, ফুলকপি ২৫ টাকা, বাধা কপি ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ আগে আলু ১০ টাকা, বেগুন ১০ টাকা, ফুল কপি ১৫ টাকা, বাধা কপি ১০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি দাম বৃদ্ধি পেয়ে পিয়াজের। বর্তমানে ১ কেজি পিয়াজ ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
উলিপুর(কুড়িগ্রাম)থেকে জানান, কুড়িগ্রামের উলিপুরে বুরো বাংলাদেশ এর উদ্যোগে ৫০০ শত শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের এ.আর পাবলিক স্কুল এন্ড প্রাইভেট কেয়ার বিদ্যালয় মাঠে বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হায়দার আলী মিঞা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ রুহুল আমীনসহ সংস্থার অন্যন্য কর্মকর্তাবৃন্দ ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন