বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্য হচ্ছে, যার শেষ ভালো তার সব ভালো। কারণ, মানুষ দূর অতীতের চেয়ে সাম্প্রতিক বা নিকট অতীতকেই মূল্যায়ণ করে বেশি। তাই মানুষ তার কর্মের শেষ প্রান্তকে স্মরণীয় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। তবে সব চেষ্টা সফল হয় এমন নয়। বিধি বাম বলে একটি কথা আছে। তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান সরকারের। কয়ক বছর যাবত উন্নয়নের মহাসড়কের বাদ্যযন্ত্র শুনতে শুনতে দেশবাসী ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তবুও সেই ক্যাসেট বাজানো বন্ধ হয়নি। বাজানো হচ্ছে অনবরতই। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সেই ঝলমলে রঙ্গিন বেলুনকে ফুটো করে দিচ্ছে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে। যেমন: উন্নয়ন অন্বেষণ ২০১৭ সালের বার্ষিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনায় উল্লেখ করেছে: (১) গত পাঁচ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের উপর থাকলেও দরিদ্রতা দূরীকরণের হার হ্রাস পেয়েছে এবং আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে (অর্থাৎ এই ত্বরিত প্রবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কাক্সিক্ষত সুফল বয়ে আনতে পারেনি)। (২) দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ২০০৩-২০১০ সাল পর্যন্ত ৩.১% আর ২০১১-২০১৬ সাল পর্যন্ত ১.৮%। অর্থাৎ ঘরে ঘরে চাকুরি দেওয়ার প্রতিশ্রæতির পরিবর্তে ঘরে ঘরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। (৩) ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি গড়ে এক শতাংশেরও কম। বর্তমান অর্থবছর শেষে এই স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হতে পারে, যা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে আরও ব্যাহত করতে পারে। (৪) দেশে রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা জিডিপি’র ২২% পর্যন্ত হলেও বস্তুত রাজস্ব আদায়ের গড় প্রবৃদ্ধিগত পাঁচ বছরে ১৩.৯৬%। যা এর আগের পাঁচ বছরে (২০০৭-১২) ১৮.৪% ছিল। (৫) দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। যেমন: ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি এবং ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ডলার (পরবর্তী বছরে তাও আরো বৃদ্ধি পেয়েছে)। (৬) জিডিপির অন্যতম খাত কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার কমছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৫০%। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ৩.৪% হয়েছে। তবে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়লেও সেবা খাত স্থবির হয়েছে।
সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনটি জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত হয়েছে পরের দিন তথা ১/১/১৮ তারিখে। অপরদিকে, ২/১/১৮ তারিখে প্রকাশিত ক্যাব বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৭ এ উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭ সালে আগের বছরের তুলনায় সব ধরনের চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ২০.৪০%। তুলনামূলকভাবে মোটা চালের দাম সরু চালের চেয়ে বেশি বেড়েছে। সব মিলিয়ে ২০১৭ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮.৪৪% এবং পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.১৭%। বৃদ্ধির এই হার আগের বছরের চেয়ে বেশি। রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবার তথ্য পর্যালোচনা করে এই হিসাব করা হয়েছে। এই হিসাব শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয়বহির্ভূত। ২০১৬ সালে জীবযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪৭% ও পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি প্রায় ৫.৮১%। ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের ওপরে জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির প্রভাব আরও বেশি হারে পড়েছে। অন্তত ২০১৭ সালে এই মানুষেরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল পায়নি। গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে পেঁয়াজের। দেশি পেঁয়াজে দাম বেড়েছে ৪০.৯৯% ও আমদানি করা পেঁয়াজে বেড়েছে ৫৭.৫৪%। শাকসবজির গড়ে দাম বেড়েছে ২৪.২৮%। তরল দুধে বেড়েছে ২০.৩৬%, গরুর মাংস ১৯.৭২%। চিনি ও গুড়ে গড়ে দাম বেড়েছে ১২.৮% ও লবণে বেড়েছে ১১.০৩%। ভোজ্যতেলে ১০.৭৮%, চা-পাতায় বেড়েছে ১০.৩২%। এ ছাড়া দেশি শাড়ি কাপড়, গুঁড়োদুধ, মাছ, ডালডা, ঘি, মুরগি, ডিম, আটা-ময়দা প্রভৃতি জিনিসের দাম বেড়েছে।
অতি স¤প্রতি ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বিশ্বের সেরা বিনিয়োগবান্ধব ১৫৩টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭তম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানের নিচে পড়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের নিচের একমাত্র দেশটি হল যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশ উপযুক্ত স্থান নয় বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, বিনিয়োগের সুরক্ষার অভাব ইত্যাদি কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশমুখী হতে চান না বলে উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’-এর সক্ষমতা জরিপেও বাংলাদেশকে একদম নিচের দিকে ফেলা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীর সুরক্ষার অভাব, ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে নানা ঝুটঝামেলা, প্রতিবন্ধকতা, দুর্নীতি ইত্যাদিকে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্বব্যাংকও সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ একদম নিম্নমানের! তাছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নপর্যায়ে। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভুটান, ভারত, শ্রীলংকা, এমনকি পাকিস্তানও এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যখন ৬-৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সক্ষম হয়ে তা আরও বর্ধিত করে চলেছে, আমরা তখন মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েই দন্তপাটি বিকশিত করছি। অথচ স্বল্প মজুরি এবং সর্বাধিকসংখ্যক মজুরপ্রাপ্তির সহজলভ্যতার কারণে আমাদের দেশেই বেশি বিদেশি বিনিয়োগ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি- এ দুটি প্রধান কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। গত সেপ্টেম্বর, ২০১৭-তে এফএওর বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে ‘ফসলের সম্ভাবনা ও খাদ্য পরিস্থিতি: ত্রৈমাসিক বৈশ্বিক প্রতিবেদন’ ও ‘চাল পূর্বাভাস-২০১৭’ শীর্ষক দুটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মধ্যে দানাদার খাদ্য (চাল ও গম) আমদানিতে এখন শীর্ষস্থানীয় দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৭ লাখ মেট্রিক টন চাল-গম আমদানি করবে। বাংলাদেশের পরই বিশ্বের অন্য শীর্ষ আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে- ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মাদাগাস্কার, নাইজেরিয়া, ইরাক, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ইরান ও চীন। বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকেই প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ টন করে চাল ও গম আমদানি করে থাকে। ২০১৬ সালে আমদানি কমলেও ২০১৭ সালে তা রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে গেছে, যা বিশ্বের প্রধান চাল আমদানিকারক দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। আমদানিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার আগে দেশে চাল ও গমের দামও ধারাবাহিকভাবে বেড়ে সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রতিবেদন-২০১৭ মতে, বসবাসযোগ্যতার বিচারে বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। ঢাকার চেয়ে খারাপ তিনটি শহর হচ্ছে- দামেস্ক, ত্রিপলি ও লাগোস। এই তালিকা তৈরিতে যে ৪০টি সূচক ব্যবহার করা হয়, তার প্রায় সব কয়টিতেই ঢাকার অবস্থান নিচের দিকে। এরূপ আরো অনেক বিষয় উল্লেখ করার মতো আছে। কিন্তু নিবন্ধের কলেবর সীমিত করার স্বার্থেই তা সম্ভব নয়।
বর্তমান বছর সরকারের শেষ বছর। নিয়ম অনুযায়ী এক বছর হাতে আছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে অর্থনীতির ব্যারোমিটার কি উপরে উঠবে, নাকি আরো নিচে নামবে, এমন প্রশ্ন উদয় হয়েছে সব মহলেই। প্রাকৃতিক পরিস্থিতি যদি অনুকূল থাকে, তাহলেও উন্নতির ব্যারোমিটার উপরে যাওয়ার কথা নয়। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা অস্থিতিশীল হয়ে উঠে সব দেশেই। আর এ দেশে একটু বেশিই হয়। আর যদি তা হয়, তাহলে শান্তি তো বিঘিœত হবেই। সেই সাথে সব ক্ষেত্রের উৎপাদনও ব্যাহত হবে। এবার জাতীয় নির্বাচনের পরিস্থিতি আরো জটিল। কারণ, প্রধান বিরোধী দল ও তার জোট নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনঢ়। তাদের আশংকা, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বচানে গেলে গত মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনের মতোই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তাই নির্বাচনে অংশ নেয়া, না নেয়া সমান কথা। অন্যদিকে, বর্তমান সরকার সংবিধান মতে তথা বর্তমান সরকারের অধীনেই এবং পার্লামেন্ট বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনঢ় রয়েছে। ফলে কার অধীনে জাতীয় নির্বাচন হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে চরম অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে তা সহজেই অনুমেয় এবং তা বছরের মধ্য সময় থেকেই হতে পারে। তাই ইতোমধ্যেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় রকমের শংকা দেখা দিয়েছে। বর্তমান আইনশৃংখলা পরিস্থিতি খারাপ, পরিবেশ দূষণ ভয়াবহ, রেকর্ড ভঙ্গকারী বেকারত্ব, মাদকে দেশ সয়লাব ইত্যাদি বিষয়ে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় মরার উপর খারার ঘায়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। সর্বপরি ভারতের আসাম রাজ্যের বাংলাভাষী মানুষ তথা মুসলমানদের সংকটও উঁকি মারছে। রোহিঙ্গা বিষয়টি পুরাতন এবং তাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে যদিও তার বাস্তবায়ন নিয়ে বিশ্ববাসী সন্দিহান। আর আসামের মুসলমানদের বিষয়টির ভবিষ্যৎ কী তা এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ, সাড়ে তিন কোটি মানুষের ৪০%-ই মুসলমান। তাদের অবৈধ বলে দাবি করছে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা ও সরকারি দল বিজেপি। ইতোমধ্যেই বৈধ নাগরিকদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে ১ কোটি ৩৯ লাখ মুসলমানকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। সেখানে তালিকার বাইরের লোক থাকতে পারবে না। এর পর আরো ২টি তালিকা প্রকাশিত হবে এবং তাতেও বহু মানুষ তালিকার বাইরে থাকবে তা নিশ্চত। আর সেই লোকদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে বলে সেখানকার মানুষের মধ্যে মহাআতংক সৃষ্টি হয়েছে। সে মানুষগুলোর বাংলাদেশ ছাড়া যাওয়ার আর কোন যায়গা নেই বলে এ দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। সে বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি এ দেশে প্রবেশ করে, তাহলে রোহিঙ্গার চেয়েও মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হবে নিঃসন্দেহে। তাই এই বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং বিষয়টি নিয়ে এখনই ভারতের সাথে কথা বলা আবশ্যক বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন