বাংলাদেশের নারীরা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। উন্নয়নের মূল ধারাতেই ঘটেছে এ অগ্রগতি। তবে যতটা প্রত্যাশিত ছিল ততটা নয়। কখনো বিভ্রান্তিকর রাষ্ট্রীয় নীতিমালা গ্রহণ, কখনো নীতিমালা প্রণয়ন বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেয়া- নানা কারণে নারী উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে, যদিও নারী উন্নয়নে সাড়া জেগেছে, বেড়েছে সচেতনতা, সেই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে চলছে নারী উন্নয়ন। নারী উন্নয়নের এ গতি আসে মূলত ১৯৯৫ সালে বেইজিং চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের পর, ওই সম্মেলনে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের ১৮৯টি দেশ নারী উন্নয়নের ১২টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে। নারী উন্নয়নের পথে যে ১২টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়, দারিদ্রের স্থান তার শীর্ষে।
নারী উন্নয়নের প্রধান বাধাই হচ্ছে দারিদ্র। অর্থনীতিবিদদের মতে, দারিদ্র বহুমাত্রিক। শুধু নারী হওয়ার কারণে দরিদ্রদের মধ্যে নারীর অবস্থান দরিদ্রতর। ব্যাংকগুলো নারীকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং অন্যান্য তথ্যভাÐারে নারীর প্রবেশাধিকার একেবারেই সীমিত। বাংলাদেশে এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে ৩৮.৭ শতাংশ মানুষ। নারী উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি হচ্ছে নারী শিক্ষা ও নারী প্রশিক্ষণ। প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের ভর্তির হার বেড়েছে এমনকি এ হার ছেলেদের তুলনায় বেশি। বৃত্তিমূলক শিক্ষায়ও এগিয়ে আসছে মেয়েরা (২৬%)। পাবলিক পরীক্ষায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করছে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে নারী উন্নয়নের পথে আরেকটি বড় বাধা। সাম্প্রতিককালে ক্ষমতায়নকে তাই নারী উন্নয়নকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। নারীকে তাই ক্ষমতায়নের বিভিন্ন স্তরে নারীর যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করা জরুরি।
নারী-পুরুষ নিজ অবস্থানে সমুজ্জ্বল। পরিবার ও সমাজে কন্যা-জায়া-জননী হিসেবে নারীর ভ‚মিকা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। একই সঙ্গে নারীর মানবিক মর্যাদা ও ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। আসলে একটি আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষের আলাদা আলাদা ভ‚মিকার কথা চিন্তাও করা যায় না। নারী-পুরুষ কেউ কারও প্রতিপক্ষ তো নয়ই, বরং একে অপরের পরিপূরক। সমকালীন বিশ্বে নারী নেতৃত্ব অনেকটাই সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ কথা আরও সত্যি। এ দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারী। সরকার, প্রশাসনসহ বিভিন্ন পেশায় নারীদের অবস্থান সুদৃঢ়। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও নারীরা অগ্রগণ্য। কিন্তু তারপরও কোন কোন ক্ষেত্রে নারী এখনও বৈষম্যের শিকার। নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেলেও দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীসমাজ এখনও অনেকটাই পিছিয়ে। যৌতুকসহ নানাবিধ কারণে এখনও অনেক নারীকে নির্যাতিত হতে হয়, কখনও কখনও জীবনও দিতে হয়। কর্মক্ষেত্রেও নারীর বৈষম্য সেভাবে কমেনি। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকারও নারী, এমন অভিযোগ প্রায়শই ওঠে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী। আর কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তো সেই অতীত থেকে।
এদেশে এখনো নারীদের সমস্যা বহুবিধ। পরিবার, সমাজ, বাইরের কর্ম জগৎ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মান্ধতা এবং অশিক্ষার কারণেও নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নারীর মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈষম্য আমরা দেখছি। এছাড়া যৌতুক, বাল্যবিবাহ, একাধিক কন্যাসন্তানের জš§দান নিয়ে স্ত্রী তালাক, পারিবারিক সহিংসতা, এসিড নিক্ষেপ বা হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার ঘটনাক্রমেই বাড়ছে। নারীর সত্যিকার উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে। নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন